প্রকৃতির মৌলিক বল এবং তাদের ঐক্যের সন্ধান ৩
পর্ব ৩
এর আগের দুটো পর্বে আমরা মহাকর্ষ, বিদ্যুত্চুম্বকীয় ও সবল নিউক্লীয় বল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বাকি আছে দুর্বল নিউক্লীয় বল। চলতি পর্বে এই বল এবং চারটি মৌলিক বলের মধ্যে কোনো সম্পর্ক সূত্র আছে কি না, কোনোভাবে তাদের ঐক্যবদ্ধ রূপ আমরা দেখতে পাব কি না, তা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ঘটনা অনেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। আলফা (হিলিয়াম নিউক্লিয়াস), বিটা (ইলেকট্রন) ও গামা (ফোটন) বিকিরণের মতো ঘটনা বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন নয়। আলফা ও গামা বিকিরণের ব্যাখ্যা দিতেও কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু নিউক্লিয়াস থেকে বিটা কণা বা ইলেকট্রন কেন নির্গত হয়, তা ব্যাখ্যা করা সহজ ছিল না। কারণ, নিউক্লিয়াসে ইলেকট্রন থাকে না, থাকে বেশ কিছুটা দূরে তাদের নিজস্ব কক্ষপথে। তাহলে নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রন বিকিরণ হবে কেন? ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার জন্য রীতিমতো বৈপ্লবিক এক ধারণার প্রবর্তন করলেন ওলফগ্যাং পাউলি, ১৯৩০ সালে। তিনি বললেন, নিউট্রন ভেঙে গিয়ে প্রোটন, অ্যান্টি-নিউট্রিনো ও ইলেকট্রন উত্পন্ন হয়। এই অ্যান্টি-নিউট্রিনো ও ইলেকট্রনই বেরিয়ে আসে নিউক্লিয়াস থেকে। আবার অন্য ঘটনাও ঘটে। অর্থাৎ প্রোটন ভেঙে গিয়ে নিউট্রন, নিউট্রিনো ও পজিট্রন উত্পন্ন হয়। কেন এই ধারণাকে বৈপ্লবিক বলছি? কারণ, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম পজিট্রন ও অ্যান্টি-নিউট্রিনো নামের দুটো কণার কথা বলা হলো, যারা আসলে কণা নয়, প্রতিকণা (antiparticle)। পজিট্রন হলো ইলেকট্রনের প্রতিকণা এবং এর ভর ইলেকট্রনের সমান হলেও এটি ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট। পজিট্রন শব্দটি এসেছে ‘পজিটিভ ইলেকট্রন’ শব্দযুগল থেকে। তেমনি নিউট্রিনোর প্রতিকণা হলো অ্যান্টি-নিউট্রিনো। সত্যি বলতে কী, এই নিউট্রিনো কণার ধারণাটিও ছিল একেবারেই নতুন। কারণ, এই কণাটি কোনো ধরনের বস্তুর সঙ্গেই মিথস্ক্রিয়া করে না, ফলে একে খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। এই ধারণা প্রবর্তনের দুই বছরের মাথায় পজিট্রনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে পরীক্ষাগারে। কিন্তু প্রায় ৮৫ বছর পরও নিউট্রিনোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই বিটা কণা বা ইলেকট্রন বিকিরণের জন্য অতি অবশ্যই আরেকটি বল সক্রিয় থাকে। বলা বাহুল্য, সেই বলটি নিউক্লীয় বল, তবে সবল নিউক্লীয় বলের মতো শক্তিশালী নয়। যেহেতু নিউক্লীয় বল হয়েও সে সবল বলের মতো শক্তিশালী নয়, তাই তার নাম দেওয়া হলো দুর্বল নিউক্লীয় বল! দুর্ভাগ্যজনক নাম তার। দেখা গেল, অন্য সব বলের মতো এই বলের মিথস্ক্রিয়ার জন্যও কণার ভূমিকা আছে। দেখা গিয়েছে W I Z বোসন নামক দুই ধরনের কণার বিনিময়ের ফলে একধরনের কোয়ার্ক অন্য ধরনের কোয়ার্কে পরিণত হয়। আরেকটু এগিয়ে বলি, এই যে নিউট্রন ভেঙে গিয়ে প্রোটন, অ্যান্টি-নিউট্রিনো ও ইলেকট্রন উত্পন্ন হয়, তারপর অ্যান্টি-নিউট্রিনো আর ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে, কিন্তু প্রোটন তো রয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসে প্রোটনসংখ্যা বেড়ে যায় না? হ্যাঁ, যায় তো! আর প্রোটনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ওই নিউক্লিয়াসটি ভিন্ন একটি রাসায়নিক মৌলে পরিণত হয়। তার মানে, নক্ষত্রের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মৌল উত্পাদনে দুর্বল নিউক্লীয় বলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একইভাবে সুপারনোভা বিস্ফোরণেও এই বলের দারুণ ভূমিকা রয়েছে। যা হোক, দুর্বল নিউক্লীয় বল আসলে কতটা দুর্বল? তুলনা করলে বলা যায়, এটি সবল নিউক্লীয় বলের ১০ লাখ ভাগের ১ ভাগ শক্তিশালী।
এই হলো প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের কাহিনি। কিন্তু এই চারটি বল আলাদা থাকে কেন? তাদের কি কোনো সম্পর্কসূত্র নেই? বিজ্ঞানীরা ধারণা করলেন, হ্যাঁ, আছে। প্রকৃতির এই চারটি বল কোনো এক সুদূর অতীতে একসঙ্গেই ছিল, মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের জন্মের পর কোনো এক সময় আলাদা হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়েই জন্ম হলো নতুন তত্ত্বের—গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিয়োরি (জিইউটি) এবং থিয়োরি অব এভরিথিং । সমস্যা হলো, এই ধরনের গবেষণার জন্য পরীক্ষাগারে উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চশক্তি তৈরির প্রয়োজন হয়। কারণ, আদি মহাবিশ্বে এ দুটোই অতিমাত্রায় বেশি ছিল। ঠিক কোন অবস্থা থেকে বলগুলো আলাদা হলো, সেটি বোঝার জন্য সেই অবস্থাটি তো তৈরি করতে হবে! কিন্তু সেটি কীভাবে সম্ভব? ১৯৬৩ সালে শেলডন গ্ল্যাশো, আবদুস সালাম ও স্টিভ ওয়াইনবার্গ হিসেব করে দেখালেন, প্রায় ১০০ গিগা ইলেকট্রনভোল্ট (100 GeV) শক্তিতে (গিগা মানে ১০৯) এবং ১০১৫ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় দুর্বল নিউক্লীয় বল ও বিদ্যুত্চুম্ব্বকীয় বল মিলে গিয়ে একটিমাত্র বলে পরিণত হবে, যার নাম ইলেকট্রোউইক বল। ব্যাপারটা প্রমাণের জন্য দ্বারস্থ হতে হলো কণা-ত্বরক যন্ত্রের। একমাত্র সেখানেই উচ্চশক্তি ও উচ্চ তাপমাত্রা তৈরি করা সম্ভব। হ্যাঁ, তাঁদের এই ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষাগারে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।
ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখা যাক। প্রকৃতির মৌলিক বল নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনা নতুন নয়। একসময় ভাবা হতো, প্রকৃতিতে তিনটি মৌলিক বল আছে—মহাকর্ষ বল, বৈদ্যুতিক বল ও চুম্বকীয় বল। ১৮৬০-এর দশকে ম্যাক্সওয়েল বিস্তারিতভাবে দেখালেন, বৈদ্যুতিক বল ও চুম্বকীয় বল আসলে আলাদা নয়, তারা উভয়ে মিলে একটিমাত্র বল আর তার নাম বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল। ম্যাক্সওয়েলের আগেও বিদ্যুৎ ও চুম্ব্বকীয় বলের মধ্যে সম্পর্কসূত্র খুঁজেছেন আরও কেউ কেউ, সে কথা দ্বিতীয় পর্বে বলেছি। তার মানে বলগুলোর ঐক্যবদ্ধ রূপ নিয়ে ভেবেছেন উনিশ শতকের বিজ্ঞানীরাও। বিশ শতকের গোড়ার দিকে পরমাণুর গঠন-সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রণীত হলো, আবিষ্কৃত হলো নিউক্লিয়াস। তখনো কিন্তু নিউক্লীয় বল সম্বন্ধে কিছু জানা ছিল না। ফলে ভাবা হতো, দুটো মাত্র মৌলিক বল আছে প্রকৃতিতে—মহাকর্ষ ও বিদ্যুত্চুম্বকীয়। ১৯৩০-এর দশকে সবল ও দুর্বল নিউক্লীয় বলের তত্ত্ব এল, মৌলিক বলের সংখ্যা দুটো থেকে চারটাতে গিয়ে ঠেকল, চলতে লাগল নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কিন্তু ওই যে ঐক্যবদ্ধ রূপ খোঁজার চেষ্টা, সেটা তো আর থেমে রইল না। এরই ধারাবাহিক ফল হিসেবে দেখা গেল, দুর্বল নিউক্লীয় বল ও বিদ্যুত্চুম্বকীয় বল মিলে তৈরি হয় ইলেকট্রোউইক বল। এবার তাহলে কটি মৌলিক বল হলো? তিনটে। মহাকর্ষ, ইলেকট্রোউইক ও সবল নিউক্লীয় বল। গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিয়োরির লক্ষ্য হলো, ইলেকট্রোউইক ও সবল নিউক্লীয় বল দুটোর ঐক্যবদ্ধ রূপ আবিষ্কার করা। এ রকম আরও একটা ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে 1019 GeV শক্তিতে সবল নিউক্লীয় বল ও ইলেকট্রোউইক বল মিলে যাবে। যদি মিলে যায়ই, তাহলে তার নাম কী হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি, যেহেতু ব্যাপারটা প্রমাণ করা যায়নি। ধরা যাক, নাম দেওয়া হলো টেঞ, সে ক্ষেত্রে মৌলিক বলের সংখ্যা দাঁড়াবে দুটো। মহাকর্ষ ও টেঞ!
এই মহাকর্ষ নিয়েই যত সমস্যা। চরিত্রের দিক থেকে এই বলটির সঙ্গে অন্যান্য বলের দুস্তর ব্যবধান। একে যে কীভাবে অন্যদের সঙ্গে মেলানো যায়, সেটি এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই কাজটি করার জন্য আরেকটি তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, যার নাম থিয়োরি অব এভরিথিং। ধারণা করা হয়েছে, সব কটি মৌলিক বল মিলে একটিমাত্র বলে পরিণত হবে 1019 GeV -তে। এই ধরনের বিপুল শক্তিস্তর আসলে আদি মহাবিশ্বে ছিল। যদি এই ধরনের অতি উচ্চশক্তিস্তর তৈরি করা যায়, তাহলে হয়তো আমরা দেখতে পাব, প্রকৃতির চারটি মৌলিক বল মিলেমিশে একাকার হয়ে একটিমাত্র বলে পরিণত হয়েছে। বলা বাহুল্য, সেই অজানা রূপের নামকরণ এখনো হয়নি। ধরা যাক, তার নাম হবে থিওরি অব এভরিথিং! এবং তখন এই একটিমাত্র বল দিয়েই জগতের সব ধরনের মিথস্ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করা যাবে। যা হোক, এ ধরনের উচ্চশক্তিসম্পন্ন যন্ত্র তৈরি করা এখন পর্যন্ত স্বপ্নই রয়ে গেছে। ফলে কবে যে মৌলিক বলগুলোর ঐক্যবদ্ধ রূপ আমরা দেখতে পাব, তা-ও অজানাই থেকে গেছে। তবে ঐক্যবদ্ধ রূপ না দেখতে পেলেও ক্ষতি নেই। কারণ, এই বলগুলো সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে মহাবিশ্বকে বর্ণ-গন্ধময় করে তোলার জন্য। আমরা তাদের দেখি আর না দেখি, তার তোয়াক্কা না করেই তারা বন্ধুর মতো আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
এই সিরিজের আগের লেখা: