প্রফেসর বার্ণের নিদ্রাভঙ্গ – ৪

‘কিন্তু একটা কথা প্রফেসর,’ চেঁচিয়ে উঠলেন নিমায়ের, ‘আমরা সবাই তো আর আত্মহত্যাকারী পাগল নই!’

‘সে কথা ঠিক,’ শুষ্ক হেসে বললেন বার্ণ, ‘কিন্তু একটি মাত্র পাগলেই এত ক্ষতি করতে পারে যে হাজার বিজ্ঞ লোকেও তা ঠেকাতে পারবে না। আমি ঠিক করেছি, নতুন মানুষের আগমনের সময় নিজে হাজির থাকব। আমার যন্ত্রের টাইম রিলের ভেতরে একটা তেজষ্ক্রিয় কার্বন আইসোটোপ ফিট করা আছে, এর অর্ধায়ু হলো আট হাজার বছর।’ সুরঙ্গটার দিকে দেখালেন বার্ণ। ‘১৮০ শতাব্দীর পর এর রিলে শেষ হয়ে যাবে; তখন আইসোটোপের বিকিরণ এত ক্ষীণ হয়ে আসবে যে ইলেকট্রোস্কোপের প্লেট দুটো পরস্পর সংযুক্ত হবে ও তাতে বিদ্যুৎ সার্কিট চালু হয়ে যাবে। সে সময় নাগাদ এই বন্ধ্যা মরুভূমি কিন্তু ফের গাছপালায় ভরা অর্ধগ্রীষ্মমণ্ডলে পরিণত হবে। নতুন মানুষের পক্ষে এই জায়গাই হবে সবচেয়ে অনুকূল।’

লাফিয়ে উঠলেন নিমায়ের। উত্তেজিতভাবে বলতে লাগলেন, ‘বেশ, যুদ্ধপ্ররোচকরা নয় উন্মাদ, কিন্তু আপনি কী বলবেন আপনার এই সংকল্পটাকে? আঠারো হাজার বছর ধরে আপনি জমে মরে থাকতে চান?’

‘শুধু জমে মরার কথা বলছেন কেন?’ শান্তভাবে আপত্তি করলেন বার্ণ, ‘এ হলো প্রত্যাবর্তনশীল মৃত্যুর একটা পুরো প্রক্রিয়া: শৈত্য, নিদ্রায়ন, অ্যান্টিবাওটিকস...’

‘কিন্তু এ যে আত্মহত্যা!’ নিমায়ের বললেন, ‘কিছুতেই আপনি আমায় বোঝাতে পারবেন না। এখনো সময় আছে, ভেবে দেখুন।’

চিন্তিতভাবে বার্ণ বললেন, ‘বিশ্বাস করতে যাওয়াটা ভয়ঙ্কর। কিন্তু আমি শুধু বিজ্ঞানই নই, মানুষও বটি। নিজের চোখেই দেখতে চাই আমি...থাক, এবার ঘুমানো যাক। কাল আমাদের কাজ কম নয়।’

‘না, অন্য যে কোনো জটিল পরীক্ষার চেয়ে বেশি ঝুঁকি এতে নেই...আপনি তো জানেন, ৪০ বছর আগে সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলে চিরন্তন বরফের তল থেকে একটা ম্যামথের শবদেহ আবিষ্কৃত হয়েছিল। মাংস এমন চমৎকার সংরক্ষিত ছিল যে সাগ্রহে তা খেতে শুরু করেছিল কুকুরেরা। ম্যামথের দেহ যদি একটা আপতিক, প্রাকৃতিক পরিস্থিতির মধ্যে বহু হাজার হাজার বছর ধরে তাজা থাকতে পারে, তাহলে বৈজ্ঞানিকভাবে হিসাব করা, পরীক্ষিত পরিস্থিতির মধ্যে আমি টিকে থাকতে পারব না কেন? আর আমাদের হালের ওই অর্ধপরিবাহী থার্মো-এলিমেন্টগুলো খুব সহজে নির্ভরযোগ্য রূপে তাপকে বিদ্যুতে পরিণত করবে। সেই সঙ্গে শৈত্যও সৃষ্টি করবে। আঠারো হাজার বছরের মধ্যে আমায় ডোবাবে না বলেই ভরসা করি।’ কাঁধ ঝাঁকালেন নিমায়ের।

‘থার্মো-এলিমেণ্টরা আপনাকে ডোবাবে না, তা ঠিক। তাদের গঠন খুব সহজ, গর্তের ভেতরকার পরিস্থিতিটা তাদের পক্ষে খুব উপযোগী হবে; তাপের তারতম্য খুব কম, জলীয় বাষ্প নেই...ম্যামথটা যতদিন টিকে ছিল প্রায় তত বছরই টিকে থাকতে পারবে এগুলো। কিন্তু অন্য যন্ত্রপাতিগুলো? আঠারো হাজার বছরের মধ্যে তাদের কোনো একটা যদি অচল হয়ে যায় তাহলে...’

আড়িমুড়ি ভেঙে বার্ণ নক্ষত্রভরা আকাশের পটে গা এলিয়ে দিলেন।

‘অন্য যন্ত্রপাতিগুলোর এতদিন ধরে কাজ করতে হবে না। তাদের কাজ শুধু দুবার—কাল সকালে, তারপর ফের আঠারো হাজার বছর পরে, পৃথিবীতে নতুন প্রাণী পর্যায়ের শুরুতে। বাকি সময়টা তারা আমার সঙ্গেই সেলে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে।’

‘একটা কথা বলুন প্রফেসর...আপনি...সত্যিই কি মানুষজাতির লোপ হবে বলে বিশ্বাস করেন।?’

চিন্তিতভাবে বার্ণ বললেন, ‘বিশ্বাস করতে যাওয়াটা ভয়ঙ্কর। কিন্তু আমি শুধু বিজ্ঞানই নই, মানুষও বটি। নিজের চোখেই দেখতে চাই আমি...থাক, এবার ঘুমানো যাক। কাল আমাদের কাজ কম নয়।’

খুব ক্লান্ত হলেও নিমায়েরের ভালো ঘুম হল না রাতে। হয়তো গরমের জন্যে, হয়তো-বা প্রফেসরের কথা শুনে মস্তিষ্ক তাঁর অতি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, ঘুম আসছিল না। সূর্যের প্রথম রোদ তাঁবুতে এসে পড়া মাত্র সাগ্রহে উঠে পড়লেন তিনি। বার্ণ শুয়েছিলেন পাশেই। সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেললেন।

‘শুরু করব নাকি?’

সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে শরতের বালুকা ঝঞ্ঝা শুরু হবে...বিদায়...আমার দিকে অমন করে চাইবেন না, আপনাদের সবার চেয়ে আমি বেশি দিন বেঁচে থাকব!’

গর্তের একেবারে তলাটা বেশ ঠাণ্ডা, সেখান থেকে আশ্চর্য নীল আকাশের একটা টুকরো দেখা যাচ্ছিল কেবল। তলে গিয়ে সরু গর্তটা চওড়া হয়ে গেছে। এখানেই ফিট করে রাখা হয়েছে সব যন্ত্রপাতি গত কয়েকদিন ধরে। নিমায়ের আর প্রফেসর বসিয়েছেন এগুলোকে। সেখান থেকে থার্মো- এলিমেন্টের শক্ত সব কেবল গেছে সুরঙ্গের বালুময় দেয়ালে।

সেলের যন্ত্রপাতিগুলো বার্ণ শেষ বারের মতো পরীক্ষা করে দেখলেন। বার্ণের নির্দেশ মতো নিমায়ের সুরঙ্গের ওপরে ছোটো একটা গর্ত করে সেখানে বিস্ফোরক রেখে তার নামিয়ে দিলেন সেল পর্যন্ত। সবকিছু ঠিক করার পর দুজনে ওপরে উঠে এলেন। সিগারেট ধরিয়ে প্রফেসর চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন:

‘মরুভূমি আজ চমৎকার দেখাচ্ছে, তাই না? কিন্তু প্রিয় সহকারী—আর কী। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমি আমার জীবন সাময়িকভাবে ছিন্ন করে দেব, রসবোধহীনের মতো আপনি যাকে বলেন আত্মহত্যা। ব্যাপারটা সহজ করে দেখুন। জীবন একটা প্রহেলিকা—মানুষ অনবরত তার অর্থ বের করার চেষ্টা করছে। কালের অন্তহীন ফিতায় একটা ছোট্ট টিক। একটা টিক না হয়ে দুটো টিক হোক না আমার জীবনটা...নিন, এবার বিদায় জানিয়ে কিছু বলুন। আপনার সঙ্গে এমনি আলাপ তো বিশেষ হয় না।’

নিমায়ের তাঁর ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইলেন একটু।

‘সত্যি, জানি না কী বলব...আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না আপনি এই কাণ্ড করবেন। ভয় হচ্ছে বিশ্বাস করতে।’

‘হুম, এই তো, আমার উৎকণ্ঠা আপনি কমিয়ে দিলেন।’ বার্ণ বললেন, ‘কেউ যখন দুশ্চিন্তা করার মতো থাকে, তখন আর এত ভয়ঙ্কর লাগে না। যাক, বিচ্ছেদক্ষণটা বিলম্বিত করে পরস্পরের বিষাদ বাড়িয়ে লাভ নেই। আপনি যখন ফিরে যাবেন, তখন হেলিকপ্টারের ওই দুর্ঘটনা ঘটাবেন, যা আগেই কথা হয়ে গেছে। আমি না বললেও বুঝতে পারছেন নিশ্চয়, এ পরীক্ষায় গোপনীয়তা অনিবার্য। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে শরতের বালুকা ঝঞ্ঝা শুরু হবে...বিদায়...আমার দিকে অমন করে চাইবেন না, আপনাদের সবার চেয়ে আমি বেশি দিন বেঁচে থাকব!’

(চলবে…)

মূল: ভ্‌লদিমির সাভ্‌চেঙ্কো

অনুবাদ: ননী ভৌমিক

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রগতি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘গ্রহান্তরের আগুন্তুক’ থেকে নেওয়া।