প্রফেসর বার্ণের নিদ্রাভঙ্গ – ৩

আগের পর্ব

‘তা খুবই সম্ভব,’ বললেন নিমায়ের।

‘আর তুষার যুগ দেখা দিল কেন? শুধু এই গোবি মরুভূমিটা নয়, সাহারা পর্যন্ত একদিন মোটেই মরুভূমি ছিল না, উদ্ভিদ আর জীবজন্তুতে ভরা ছিল, তা কেন? তার একটি মাত্র যুক্তিসঙ্গত অনুমান সম্ভব—পৃথিবীর অক্ষের স্থান পরিবর্তনের সঙ্গে তুষার যুগের যোগাযোগ আছে। লাটিম ঘোরার সময় যেমন হয়, পৃথিবী ঘোরার সময়েও তেমনি তার অক্ষটা সরে যেতে থাকে—মৃদু, অতি মৃদু আবর্তন করতে থাকে—ছাব্বিশ হাজার বছরে পুরো একটা চক্র। এই দেখুন, একটা দেশালাইয়ের কাঠি নিয়ে প্রফেসর বালির ওপর একটা উপবৃত্ত আঁকলেন, ‘তার নাভি বিন্দুতে সূর্য আর উপবৃত্ত রেখার ওপর বাঁকা অক্ষের পৃথিবী। জানেন তো, পৃথিবীর অক্ষ উপবৃত্তের সঙ্গে ২৩৩০ কোণ রচনা করে নুয়ে থাকে। আর পৃথিবীর এ অক্ষ আবার নিজেই একটা শঙ্কু রচনা করে ঘোরে, এই রকম ধরনে...মাপ করবেন, বহুকাল থেকেই এসব কথা জানা, তারপরেও ব্যাপারটা আমার পক্ষে জরুরী। আসলে প্রশ্নটা অক্ষের নয়—পৃথিবীর অক্ষ বলে একটা আলাদা জিনিস তো কিছু নেই। ব্যাপারটা এই যে হাজার বছরের মধ্যে সূর্যের আপেক্ষিকে পৃথিবীর অবস্থান বদলে যায়।

‘এখন চল্লিশ হাজার বছর আগে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ ছিল সূর্যের দিকে এগিয়ে আর এখানে এই উত্তরে বরফ এগিয়ে আসতে থাকে। বিভিন্ন জায়গায়, খুব সম্ভবত মধ্য এশিয়ায় এক জাতের নর-বানর দেখা দেয়, ভূপদার্থিক পরিস্থিতির কঠোর প্রয়োজনে জোট বাঁধতে বাধ্য হয় তারা। প্রেসেসনের অর্থাৎ অক্ষের এই আবর্তনটার সময় প্রথম সভ্যতা দেখা দেয়। ১৩ হাজার বছর পরে সূর্যের আপেক্ষিকে উত্তর গোলার্ধ ও দক্ষিণ গোলার্ধের অবস্থান উল্টে যায়, তখন দক্ষিণ গোলার্ধেও মানুষের জাত দেখা দেয়...

আরও পড়ুন
সূর্য অস্ত গেছে, শুরু হয়েছে তপ্ত রাত। দ্রুত কালো হয়ে উঠছে কৃষ্ণ-নীল আকাশ, তাতে ফুটে আছে ঝাপসা স্তন্ধ কয়েকটা তারা। মরুভূমিটাও কালো হয়ে উঠেছে—আকাশের সঙ্গে তার তফাৎ কেবল ওই তারা কটিতে।

‘উত্তর গোলার্ধে ফের তুষার যুগ শুরু হবে ১২-১৩ হাজার বছর পরে। এ বিপদের সঙ্গে যোঝার যথেষ্ট শক্তি ও সামর্থ্য এখন মানুষের আছে, যদি...যদি অবশ্য মানুষ তখনো টিকে থাকে। কিন্তু আমার ধারণা টিকবে না। আধুনিক বিজ্ঞান যে ক্রমবর্ধমান গতি সম্ভব করে তুলেছে তাতে আমরা আমাদের অবলুপ্তির দিকেই ধাবিত হচ্ছি... দুটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছে আমার জীবনে, প্রথমটায় ছিলাম সৈন্য হিসাবে, দ্বিতীয়টায় ময়দানে। পরমাণু ও হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষায় আমি উপস্থিত থেকেছি। তারপরেও তৃতীয় মহাযুদ্ধ যে কী দাঁড়াবে সেটা কল্পনাও করতে পারি না। ভাবতেও ভয় লাগে। আরও খারাপ এই যে, এমন লোকও আছে যারা একেবারে বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতায় হিসেব করে বলে দেন এত মাসের পর যুদ্ধ বাধবে। শত্রুর শিল্প কেন্দ্রের ওপর পুঞ্জীভূত পরমাণু আঘাত। সীমাহীন সব তেজষ্ক্রিয় মরুভূমি। বৈজ্ঞানিকের মুখে এসব কথাই শোনা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, তেজষ্ক্রিয় বিকিরণে মাটি জল বাতাসকে সবচেয়ে কার্যকরীভাবে কী করে বিষাক্ত করা যায়, তারই হিসেব করছেন তাঁরা। সম্প্রতি একটি আমেরিকান বৈজ্ঞানিক লেখা পড়েছি, তাতে প্রমাণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ পরিমাণ তেজস্ক্রিয় মাটি উৎক্ষিপ্ত করতে হলে একটা পরমাণু বোমাকে অন্তত ৫০ ফুট মাটি ভেদ করতে হবে। এ একেবারে বৈজ্ঞানিক বিভীষিকা! হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে উঠে দাঁড়ালেন বার্ণ।

সূর্য অস্ত গেছে, শুরু হয়েছে তপ্ত রাত। দ্রুত কালো হয়ে উঠছে কৃষ্ণ-নীল আকাশ, তাতে ফুটে আছে ঝাপসা স্তন্ধ কয়েকটা তারা। মরুভূমিটাও কালো হয়ে উঠেছে—আকাশের সঙ্গে তার তফাৎ কেবল ওই তারা কটিতে।

শান্ত হয়ে এলেন প্রফেসর, চিন্তিত, প্রায় নিরাবেগ একটা সুরে কথা শুরু করলেন তিনি। আর সেই একঘেয়ে সুরে তিনি যা বলছিলেন তা শুনে অত গরমের মধ্যেও কেঁপে উঠলেন নিমায়ের।

আরও পড়ুন
লোকে লড়াইয়ের সুযোগ ছেড়ে দিচ্ছে—এটা তো জীবনে কখনো দেখিনি...তাই প্রেসেসনের পাক শেষ হওয়ার সময় আমাদের এ গ্রহে একটিও চিন্তা করার মতো প্রাণী বেঁচে থাকবে না।

‘...পরমাণু বোমায় সম্ভবত গোটা পৃথিবীটা ভস্মীভূত হবে না। তার দরকারও পড়বে না; কিন্তু বিশ্বের আবহাওয়াকে অত্যধিক তেজষ্ক্রিয়তায় তা আচ্ছন্ন করবে। আর শিশুর জন্মের ওপর তেজস্ক্রিয়তার যে কী প্রতিক্রিয়া তা তো আপনি জানেন। মানুষজাতির যেটুকু টিকে থাকবে, তারা কয়েক পুরুষ ধরে যাদের জন্ম দিয়ে যাবে তারা নতুন, অবিশ্বাস্য রকমের জটিল জীবন পরিস্থিতির পক্ষে একেবারেই অনুপযুক্ত হবে। হয়তো আরও ভয়াবহ আরও নিখুঁত গণ আত্মহত্যার অস্ত্র আবিষ্কার করে বসবে লোকে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যত দেরি করে শুরু হবে ততই ভয়াবহ হবে তা। লোকে লড়াইয়ের সুযোগ ছেড়ে দিচ্ছে—এটা তো জীবনে কখনো দেখিনি...তাই প্রেসেসনের পাক শেষ হওয়ার সময় আমাদের এ গ্রহে একটিও চিন্তা করার মতো প্রাণী বেঁচে থাকবে না। যুগের পর যুগ সূর্য প্রদক্ষিণ করে যাবে আমাদের গ্রহ, কিন্তু সে গ্রহ এই মরুভূমিটার মতোই শূন্য ও নিথর, বন্ধ্যা বালির দিকে হাত বাড়িয়ে দেখালেন প্রফেসর, ‘মরচে ধরে ক্ষয়ে যাবে লোহা, ধূলোয় মিশে যাবে ঘরবাড়ি। তারপর নতুন একটা তুষার যুগ শুরু হবে, আমাদের এ হতভাগ্য সভ্যতার মৃত অবশেষগুলো মুছে যাবে পুরু বরফে...আর সেই শেষ! ধুয়ে মুছে নতুন এক মানবজাতির জন্যে তৈরি হবে পৃথিবী। অন্য সব প্রাণীর বিকাশ আমরা বর্তমানে অবরুদ্ধ করে রাখছি, তাদের শিকার করি, মারি, বিরল সব জাতের প্রাণীদের নিঃশেষ করি... পৃথিবী থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে মুক্ত প্রাণীজগত সংখ্যায় ও উৎকর্ষে দ্রুত বাড়তে থাকবে। নতুন তুষার যুগ আসার সময় উচ্চতর বানরেরা চিন্তা করতে পারার মতো যথেষ্ট বিকশিত হয়ে উঠবে। এভাবেই দেখা দেবে নতুন এক মানবজাতি—আশা করা যাক, আমাদের মতো দুর্ভাগ্য তাদের সইতে হবে না।’

(চলবে…)

মূল: ভ্‌লদিমির সাভ্‌চেঙ্কো

অনুবাদ: ননী ভৌমিক

* সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘প্রগতি প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘গ্রহান্তরের আগুন্তুক’ থেকে নেওয়া।

আরও পড়ুন