হৈটি টৈটি - দ্বিতীয় পর্ব

‘হাতির সঙ্গে আলাপ করে দেখবেন! এমন কথা জন্মেও শুনিনি।’ হাত উল্টিয়ে বলে উঠলেন শত্র্ম

(পূর্ব প্রকাশের পর)

৪. ভাগনার বাঁচালেন

হতাশ হয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন শত্র্ম। মনে মনে ভাবছিলেন, ‘সর্বনাশ হয়ে গেল, সমূহ সর্বনাশ! হাতিটা যা ক্ষতি করেছে, তার খেসারত দিতেই আমার সব সম্পত্তি চলে তো যাবেই, তার ওপর হৈটি টৈটিকে গুলি করে মারবে ওরা। এ লোকসানের আর চারা নেই।’

এই সময় ট্রেতে করে একটি কাগজ নিয়ে এল একজন পরিচারক। বলল, ‘টেলিগ্রাম৷’

‘তা ছাড়া আর কী!’ ভাবলেন ম্যানেজার। ‘হাতিটি মারা পড়েছে তারই খবর নিশ্চয়...কিন্তু একি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে টেলিগ্রাম? মস্কো থেকে? আশ্চর্য! কে পাঠাল?’

‘ম্যানেজার শত্র্ম, বুশ সার্কাস, বার্লিন

এইমাত্র হাতির পালিয়ে যাওয়ার খবর পড়লাম কাগজে স্টপ হাতিটাকে মারার আদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহারের অনুরোধ করুন পুলিশকে স্টপ একটা লোক পাঠিয়ে হাতিকে এই খবর দিন কোলন উদ্ধৃতি সেপিয়েন্স ভাগনার বার্লিনে আসছেন বুশ সার্কাসে ফিরে এসো স্টপ উদ্ধৃতি শেষ তারপরও কথা না শুনলে গুলি করে মারতে পারেন স্টপ প্রফেসর ভাগনার।’

আরও একবার টেলিগ্রামটা পড়লেন শত্র্ম।

‘কিছুই মাথায় ঢুকছে না। বোঝা যাচ্ছে প্রফেসর ভাগনার হাতিটিকে জানেন, টেলিগ্রামে লিখেছেন তার পুরোনো নাম সেপিয়েন্স। কিন্তু প্রফেসর বার্লিনে আসছেন, এ কথা শুনে হাতিটা ফিরবে বলে কেন ভাবছেন তিনি?...কে জানে, যা-ই হোক, হাতিটাকে বাঁচানোর ক্ষীণ একটা চান্স অন্তত পাওয়া যাচ্ছে।’

কাজে নামলেন ম্যানেজার। বেশ কিছুটা কষ্টের পর ‘সামরিক অপারেশন বন্ধের’ জন্য পুলিশ কর্তার সম্মতি পাওয়া গেল। অবিলম্বে বিমানযোগে ইয়ুঙ্গকে পাঠানো হলো হাতির কাছে।

একেবারে রীতিমতো সন্ধিদূতের মতো একটা সাদা রুমাল উড়িয়ে হাতির দিকে এগোলেন ইয়ুঙ্গ।

শুরু করলেন, ‘শ্রদ্ধেয় সেপিয়েন্স, প্রফেসর ভাগনার অভিনন্দন পাঠিয়েছেন। শিগগির বার্লিনে পৌঁছাবেন তিনি, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। সাক্ষাৎ হবে বুশ সার্কাসে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ফিরে গেলে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না।’

হাতিটা মন দিয়ে শুনে কী ভেবে শুঁড়ে করে ইয়ুঙ্গকে তুলে নিল তার পিঠের ওপর। তারপর উত্তরের সড়ক ধরে গজেন্দ্রগমনে চলতে লাগল বার্লিনের দিকে। ইয়ুঙ্গের ভূমিকাটা দাঁড়াল দ্বিবিধ, একদিকে যুদ্ধ-জামিন, অন্যদিকে রক্ষক হাতির পিঠের ওপর মানুষ বসে থাকায় কেউ গুলি করতে সাহস করবে না।

হাতি আসছিল হেঁটে; কিন্তু প্রফেসর ভাগনার ও তার সহকারী দেনিসভ এলেন উড়ে। তাই বার্লিনে তারা পৌঁছালেন হাতির আগেই। সঙ্গে সঙ্গেই তারা দেখা করতে গেলেন শত্রমের সঙ্গে।

‘আপত্তি কী? রিংকে সে কথা আগেই বলেছি। দেখা, শোনা, ঘুরে বেড়ানো, নিশ্বাস নেওয়া—এসবের জন্য রিং এতই উৎসুক যে সে একটা শুয়োর-কুকুর হতেও রাজি

সার্কাস ম্যানেজার ততক্ষণে টেলিগ্রাম পেয়েছেন যে প্রফেসর ভাগনারের নাম শুনেই হাতি বাধ্য ও বশীভূত হয়েছে, হেঁটে আসছে বার্লিনের দিকে। ম্যানেজারকে ভাগনার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা বলুন তো, হাতিটিকে পেলেন কীভাবে, তার ইতিহাস জানেন কিছু?’

‘আমি ওকে কিনেছি নিক্স নামের এক লোকের কাছ থেকে, নারকেল তেল আর বাদামের কারবারি। থাকে মধ্য আফ্রিকার কঙ্গোয়, মাথাদি শহরের খানিকটা দূরে। সে বলে, তার ছেলেমেয়েরা যখন বাগানে খেলা করছিল, তখন হঠাৎ একদিন এসে হাজির হয় হাতিটা, নানা রকম আশ্চর্য আশ্চর্য খেলা দেখায় সে, পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়, নাচে, লাঠি লোফালুফি করে, একবার মাটিতে দাঁত বিঁধিয়ে সামনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায় আর পেছনের পা আর লেজ নাচাতে থাকে ভারি মজার ভঙ্গিতে। নিক্সের ছেলেমেয়ে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকে। ছেলেরাই তার নাম দেয় হৈটি টৈটি, জানেন তো, ইংরেজিতে কথাটার মানে বলা যেতে পারে “রগুড়ে”, মাঝেমধ্যে অব্যয় হিসেবেও ব্যবহার করা হয়, যেমন “লাগ, লাগ” বা “বাহবা, বাহবা!” নামটা অভ্যাস হয়ে যায় হাতিটার, আমাদের মালিকানায় আসার পর ওই নামই আমরা রেখে দিই। খুবই আইনসংগতভাবে কেনা হয়েছে, কেউ কোনো আপত্তি তুলতে পারে না।’

‘আপত্তি তোলার কোনো ইচ্ছা আমার নেই,’ বললেন ভাগনার, ‘আচ্ছা, হাতিটার গায়ে কোনো বিশেষ চিহ্ন আছে কি?’

‘মাথায় কতগুলো মস্ত ক্ষতচিহ্ন আছে। মি. নিক্সের ধারণা, হাতিটা ধরার সময় কিছুটা জখম হয়ে থাকবে। স্থানীয় লোকদের হাতি ধরার পদ্ধতিটা বেশ বর্বর। ক্ষতগুলোর জন্য ওকে তেমন ভালো দেখায় না, দর্শকদের অস্বস্তি হতে পারে, তাই থুপিওয়ালা একটা সিল্কের নকশা তোলা টুপি পরানো হয় মাথায়।’

‘তাহলে আর সন্দেহ নেই যে এটা সেই হাতিই।’

‘তার মানে?’ জিজ্ঞাসা করলেন শত্র্ম।

‘ওই সেপিয়েন্স, আমার যে হাতিটা হারিয়ে গিয়েছিল। বেলজিয়ান কঙ্গোয় একটা বৈজ্ঞানিক অভিযানে আমি ওকে ধরেছিলাম, আমিই ট্রেনিং দিই ওকে। কিন্তু একদিন সে বনে গিয়ে আর ফিরে আসে না। অনেক চেষ্টা করি, কিন্তু খুঁজে আর পাওয়া যায় না।’

‘তার মানে, হাতিটা আপনার সম্পত্তি বলে দাবি তুলতে চাইছেন নাকি?’ জিজ্ঞাসা করলেন সার্কাসের ম্যানেজার।

‘আমি কোনো দাবি তুলছি না, কিন্তু সম্ভবত হাতিটাই তুলবে। আসল ব্যাপার হলো, নতুন কতগুলো পদ্ধতিতে আমি হাতিটাকে ট্রেনিং দিই, আর সত্যিই আশ্চর্য ফল পাওয়া যায় তাতে। ওর মানসিক ক্ষমতার অসাধারণ বিকাশ তো আপনি নিজেই দেখছেন। ওটা আমারই কাজ। এ-ও বলব যে সেপিয়েন্স বা আপনারা ওকে এখন যা বলে ডাকেন, সেই হৈটি টৈটির বলা যেতে পারে, খুব একটা প্রবল রকমের ব্যক্তিত্ববোধ আছে। আপনাদের সার্কাসের খেলায় হাতিটার অদ্ভুত নৈপুণ্যের কথা যখন আমি খবরের কাগজে পড়ি, তখন সঙ্গে সঙ্গেই স্থির করি ও আমারই সেপিয়েন্স; পড়া, হিসাব করা, লেখা—এ কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। কেননা, এসব বিদ্যা আমিই তাকে শেখাই। হৈটি টৈটি যত দিন শান্তিতে ছিল, বার্লিনবাসীদের আনন্দ দিচ্ছিল আর বোঝা যাচ্ছিল, নিজেও সে তার ভাগ্যে অসুখী নয়, তত দিন হস্তক্ষেপ করার কোনো প্রয়োজন আমি দেখিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করল হাতিটা, তার মানে কিছু একটা কারণে সে বিরক্ত হয়েছে। তাই ঠিক করলাম, ওর সাহায্যে যেতে হবে। এবার নিজের ভাগ্য নিজে বেছে নেওয়ার অধিকার তাকে দিতে হবে। এ অধিকার তার আছে। মনে রাখবেন, আমি সময়মতো না এলে বহু আগেই মারা পড়ত হাতিটা; আমাদের দুজনের কেউই তাকে পেতাম না। আমি শুধু এটুকু আশা করি যে আপনি এবার বুঝতে পারছেন যে জোর করে আপনি হাতিটাকে নিজের কাছে ধরে রাখার চেষ্টা করলে কিছু ফল হবে না। তবে ভাববেন না যে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য আপনার কাছ থেকে হাতিটিকে নিয়ে নেওয়া। আমি শুধু তার সঙ্গে একটু কথা কইব। খুবই সম্ভব যে আপনি যদি আপনার ব্যবস্থা একটু বদলান, যার জন্য সে অত চটেছে, সেটা দূর করেন, তাহলে হয়তো সে আপনার কাছেই থাকতে রাজি হবে।’

‘হাতির সঙ্গে আলাপ করে দেখবেন! এমন কথা জন্মেও শুনিনি।’ হাত উল্টিয়ে বলে উঠলেন শত্র্ম।

‘হৈটি টৈটির মতো হাতিও তো কখনো দেখা যায়নি,’ জবাব দিলেন প্রফেসর, ‘ভালো কথা, বার্লিনে আসতে তার দেরি কত?’

‘এই সন্ধ্যাতেই, বোঝা যায়, আপনার সঙ্গে দেখা করতে সে ব্যগ্র। টেলিগ্রাম পেয়েছি যে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার বেগে সে আসছে।’

সেই সন্ধ্যাতেই সার্কাস অনুষ্ঠানের পর প্রফেসর ভাগনারের সঙ্গে দেখা হলো হৈটি টৈটির। রঙ্গভূমিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন শত্র্ম, ভাগনার আর দেনিসভ; খেলোয়াড়দের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকল হৈটি টৈটি, তখনো পিঠে তার ইয়ুঙ্গ। ভাগনারকে দেখেই সে ছুটে এল তার কাছে, শুঁড় বাড়িয়ে যেন করমর্দন করল। তারপর ইয়ুঙ্গকে নামিয়ে ভাগনারকে তুলে নিল পিঠে। প্রফেসর হাতির মস্ত কানটা তুলে ধরে ফিসফিসিয়ে কী বললেন। হাতি মাথা নেড়ে তার শুঁড়ের ডগাটা দ্রুত নাড়িয়ে গেল প্রফেসরের মুখের কাছে। এই নড়নচড়নগুলো মন দিয়ে লক্ষ করতে লাগলেন ভাগনার। গোপনীয়তাটা শত্রমের ভালো লাগল না।

অধৈর্যের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা কী ঠিক করল হাতিটা?’

‘ছুটি নেওয়ার ইচ্ছা জানাল হাতিটা, সেই অবকাশে জরুরি কতগুলো জিনিস সে আমাকে বলতে চায়। ছুটির পর সে সার্কাসে ফিরতে রাজি, কিন্তু এক শর্তে: অভদ্র আচরণের জন্য হের ইয়ুঙ্গকে ক্ষমা চাইতে হবে তার কাছে, প্রতিশ্রুতি দিতে হবে আর কখনো দৈহিক বল প্রয়োগ তিনি করবেন না। হাতির গায়ে অবশ্য লাঠির বাড়ি লাগে না, কিন্তু নীতিগতভাবে সে কোনো রকম অপমান সহ্য করতে রাজি নয়।’

‘আমি...মেরেছি হাতিটাকে?’ অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞাসা করলেন ইয়ুঙ্গ।

‘ঝাড়ুর হাতল দিয়ে,’ বললেন ভাগনার, ‘এড়িয়ে গিয়ে লাভ নেই, হাতি মিছে কথা বলে না। হাতির প্রতি সৌজন্য দেখাতে হবে আপনাকে যেন ও...’

‘প্রজাতন্ত্রের সভাপতি বুঝি?’

‘একজন মানুষের মতো এবং সাধারণ মানুষ নয়, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন।’

‘একজন লর্ড,’ ব্যঙ্গভরে বললেন ইয়ুঙ্গ৷

‘খুব হয়েছে, থামুন,’ চেঁচিয়ে উঠলেন শত্র্ম, ‘আপনিই যত গন্ডগোলের মূল, এর জন্য শাস্তি পেতে হবে বলে রাখলাম। কখন...জনাব হৈটি টৈটিকে নিতে চান এবং কোথায় যাবেন?’

‘ওর সঙ্গে আমরা একটা পদব্রজ ভ্রমণে বেরোব,’ ভাগনার বললেন।

‘বেশ প্রীতিকর হবে সেটা। ওর চওড়া পিঠের ওপর দেনিসভ আর আমার দুজনেরই জায়গা হবে, আমাদের ও নিয়ে যাবে দক্ষিণ দিকে। সুইজারল্যান্ডের মাঠে চরে বেড়ানোর ইচ্ছা জানিয়েছে হাতি।’

সহকারী দেনিসভের বয়স মোটে ২৩, কিন্তু এই অল্প বয়সেই কতগুলো জীব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছে সে। ‘আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল,’ প্রফেসর বলেছিলেন তাকে আর নিজের গবেষণাগারে কাজে নেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। অপরিসীম খুশি হয়ে উঠেছিলেন তরুণ বৈজ্ঞানিক। সহকারীকে পেয়ে প্রফেসরও কম খুশি হননি, যেখানে যেতেন, সর্বদাই দেনিসভকে সঙ্গে নিতেন।

প্রথম দিন একত্রে কাজের সময়েই প্রফেসর বলেছিলেন, ‘দেনিসভ আকিম ইভানভিচ, উফ, কী লম্বা নাম। প্রতিবার আপনাকে ডাকার সময় যদি আমায় প্রথামতো আকিম ইভানভিচ বলে ডাকতে হয়, তাহলে বছরে ৪৮ মিনিট ব্যয় করতে হবে। আর এই ৪৮ মিনিটে অনেক কিছু করা সম্ভব। তাই মোটেই কোনো নাম ব্যবহার করব না আমি, ডাকতে হলে শুধু ছোট্ট করে ডাকব “দেন”। আপনিও আমায় ডাকবেন “ভাগ”।’ সময় বাঁচানোর ওস্তাদ ছিলেন ভাগনার।

সকাল নাগাদ তোড়জোড় সব শেষ। ভাগনার আর দেনিসভ দুজনের জন্যই যথেষ্ট জায়গা ছিল হাতির চওড়া পিঠে। সঙ্গে রইল কেবল অত্যাবশ্যক কিছু জিনিস।

সময়টা অতি প্রত্যুষ হলেও বিদায় জানানোর জন্য শত্র্ম হাজির ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হাতিকে খাওয়াবেন কী?’

‘গ্রামে-শহরে খেলা দেখাব,’ জবাব দিলেন ভাগনার, ‘তার বদলে দর্শকেরা তার খাবার জোগাড় করবে। নিজেও খাবে, আমাদেরও খাওয়া জুটিয়ে দেবে সেপিয়েন্স। চললাম।’

মন্থর গমনে হেঁটে চলল হাতি। কিন্তু শহরের শেষ বাড়িটা পেছনে ফেলে খোলা সড়ক ধরতেই নিজেই গতি বাড়িয়ে দিল। চলল ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটার বেগে।

‘দেন, এবার হাতির ব্যাপারটা আপনাকেই দেখতে হবে। ওকে ভালো করে বোঝার জন্য ওর অসাধারণ অতীত ইতিহাসটা জানা দরকার। নোটবইটা নিন, আপনার জায়গায় আগে যিনি ছিলেন, সেই পেসকভের ডায়েরি এটি। আমার সঙ্গে তিনি কঙ্গোয় গিয়েছিলেন। একটা ট্র্যাজিক ঘটনা হয়েছিল তার, সেটা পরে কোনো একসময় বলব। আপাতত ওটা পড়ে দেখুন।’

ভাগনার হাতির মাথার দিকে আরেকটু এগিয়ে ছোট্ট একটা ডেস্ক পাতলেন। তারপর ডান-বাঁ দুই হাত দিয়েই দুটি নোটবুকে একই সঙ্গে লিখে চললেন তিনি। একই সঙ্গে অন্তত দুটি কাজের কম কখনো তিনি করতেন না।

‘এবার বলেন,’ প্রফেসর অনুরোধ করলেন, স্পষ্টতই হাতির উদ্দেশে। হাতি তার শুঁড়টা তুলে ধরল একেবারে ভাগনারের কানের কাছে, তারপর ছোট ছোট বিরতিসহ দ্রুত একটা ফিসফিসে আওয়াজ করে চলল: ‘ফ-ফফ- ফফফ-ফফফ...’

‘ঠিক মোর্স কোডের টরে টক্কার মতো...’ মোটা চামড়ায় বাঁধানো এক্সারসাইজ খাতাটা খুলতে খুলতে ভাবলেন দেনিসভ।

হাতি যা বলছিল, সেটা ভাগনার টুকে নিচ্ছিলেন তার বাঁ হাত দিয়ে। ডান হাত দিয়ে লিখছিলেন একটা বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ। সমানতালে হাঁটছিল হাতিটা, তার মসৃণ দুলুনিতে লেখায় প্রায় কোনো বাধা হচ্ছিল না। ইতিমধ্যে পেসকভের ডায়েরিতে মগ্ন হয়ে পড়লেন দেনিসভ। ডায়েরিটা এই—

৫. রিং কখনো মানুষ হয়ে উঠবে না

২৭ মার্চ। মনে হচ্ছে যেন ফাউস্টের কাজের ঘরে এসে পড়েছি। প্রফেসর ভাগনারের গবেষণাগারটি এক আশ্চর্য জায়গা। কী নেই এখানে! পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, ইলেকট্রো-টেকনোলজি, অণুজীববিদ্যা, শারীরস্থান, শারীরবৃত্ত...বোঝা যায়, জ্ঞানের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যাতে ভাগনার বা তাঁর অভিধা অনুসারে ভাগের আগ্রহ নেই। মাইক্রোস্কোপ, স্পেকট্রোস্কোপ, ইলেকট্রোস্কোপ—সাদাচোখে যা দেখা যায় না, তা দেখার জন্য যত রকমের স্কোপ আছে, সব কটিতে ভরা। শোনার জন্য একরাশ যন্ত্রপাতি: কর্ণাণুবীক্ষণে দিয়ে হাজার রকমের নতুন নতুন শব্দ শুনতে পারেন ভাগনার, ধরতে পারেন পুশকিনের ভাষায় ‘সামুদ্রিক সরীসৃপের জলাভ্যন্তরের গতি, দূর তৃণের জীবন ছন্দ।’ কাচ, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, রবার, চিনামাটি, এবনি, প্লাটিনাম, সোনা, ইস্পাত—এই নিয়ে নানা আকারের নানা ধরনের সমাহার। বকযন্ত্র, ফ্লাস্ক, কয়েল, টেস্টটিউব বাতি, স্পুল, স্পাইরাল, ফিউজ, সুইচ, বোতাম...এসবের মধ্যে দিয়ে ভাগনারের মানস জটিলতারই প্রতিফলন হচ্ছে নাকি? পাশের ঘর তো এক মূর্তিশালাবিশেষ। সেখানে নরদেহের ‘চাষ’ করেন ভাগনার, দেহবিচ্ছিন্ন একটা জ্যান্ত আঙুল, খরগোশের কান, কুকুরের হার্ট, ভেড়ার মাথা আর...মানুষের মস্তিষ্ক বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি। জ্যান্ত মস্তিষ্ক, তখনো তা ভাবছে! এর যত্ন করার ভার আমার ওপর। সে মস্তিষ্কের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রফেসর তার উপরিতলের ওপর তাঁর আঙুল রাখেন। বিশেষ একধরনের শারীরদ্রবণ দিয়ে পুষ্ট রাখা হয় তাকে, আমার কাজ হলো জিনিসটা তাজা রাখা। কিছুকাল আগে ভাগনার এই দ্রবণের উপাদানে অদলবদল করে মস্তিষ্কের ‘প্রখরীভূত’ পুষ্টি শুরু করেন। ফল হয় আশ্চর্য । দ্রুত বাড়তে থাকে মস্তিষ্ক, শেষ পর্যন্ত একটা মস্ত তরমুজের মতো হয়ে উঠল, খুব যে সুন্দর দেখাচ্ছিল, তা অবশ্য নয়।

২৯ মার্চ। কী নিয়ে যেন ভাগ মস্তিষ্কের সঙ্গে খুব জোর কথাবার্তা চালাচ্ছেন।

৩০ মার্চ। সন্ধ্যায় ভাগ আমাকে বললেন ‘মস্তিষ্কটা একজন তরুণ জার্মান বৈজ্ঞানিক রিংয়ের। আবিসিনিয়ায় মারা পড়ে লোকটি, কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন মস্তিষ্কটা এখনো বেঁচে আছে, চিন্তা করছে। কিন্তু কিছুকাল থেকে মস্তিষ্কটা বিষণ্ন হয়ে উঠেছে। মস্তিষ্কের জন্য যে চোখটা আমি করে দিয়েছিলাম, সেটায় ও খুশি নয়। শুধু দেখে তৃপ্তি হচ্ছে না ওর, শুনতেও চায়, শুধু এক জায়গায় পড়ে থাকতে ভালো লাগছে না, নড়েচড়ে বেড়াতে চায়। দুর্ভাগ্যবশত ইচ্ছাটা সে জানাল বড় দেরি করে। কিছুদিন আগে বললে এ ইচ্ছা পূরণ করা যেত। অ্যানাটমি থিয়েটারে একটা সুবিধামতো লাশ জোগাড় করে রিংয়ের মস্তিষ্ক তার মাথায় বসিয়ে দেওয়া যেত। লোকটা যদি মস্তিষ্কের রোগে প্রাণ হারিয়ে থাকে, তাহলে মাথায় একটা নতুন সুস্থ মস্তিষ্ক বসালেই সে প্রাণ ফিরে পেত। রিংয়ের মস্তিষ্ক তখন পেত একটা নতুন দেহ ও পুনর্জীবন। কিন্তু এই দেহ বিকাশের পরীক্ষাটা নিয়ে আমি ভারি মেতে উঠেছিলাম। এখন দেখতেই পাচ্ছেন রিংয়ের মস্তিষ্ক এত বড় হয়ে উঠেছে যে কোনো মানুষের মাথায় তা আঁটবে না। কখনো মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না রিং।

‘আপনি কি বলতে চান মানুষ ছাড়া অন্য কিছু সে হয়ে উঠতে পারবে?’

‘ঠিক তা–ই। যেমন হাতি হতে সে পারে। অবশ্য হাতির মাথার মতো অত বড় আকারে মস্তিষ্কটা এখনো পৌঁছায়নি, কিন্তু সেটা সময়ে সম্ভব। শুধু দেখতে হবে প্রয়োজনীয় আকারে মস্তিষ্কটা যাতে পৌঁছায়। শিগগিরই একটা হাতির মাথার খোল নিয়ে আসব আমি। মস্তিষ্কটা তাতে বসিয়ে তার তনু বাড়িয়ে চলব যত দিন না পুরো খোলটা ভরে যায়।’ তার মানে রিংকে আপনি হাতি করে তুলতে চান।

‘আপত্তি কী? রিংকে সে কথা আগেই বলেছি। দেখা, শোনা, ঘুরে বেড়ানো, নিশ্বাস নেওয়া—এসবের জন্য রিং এতই উৎসুক যে সে একটা শুয়োর-কুকুর হতেও রাজি। আর হাতি একটা উদার প্রাণী, সবল, দীর্ঘায়ু। ও, মানে রিংয়ের মস্তিষ্কটা, আরও ১০০-২০০ বছর বাঁচতে পারবে। খুব খারাপ কথা কি? রিং তার সম্মতি দিয়েছে...’

দেনিসভ ডায়েরি ছেড়ে ভাগনারকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার মানে, যে হাতিতে চেপে আমরা যাচ্ছি...’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার মস্তিষ্কটা মানুষের,’ লেখা না থামিয়েই বললেন ভাগনার, ‘পড়ে যান, আমাকে বাধা দেবেন না।’

দেনিসভ চুপ করল বটে কিন্তু তক্ষুনি ফের পড়তে শুরু করল না। যে হাতিতে তারা বসে আছে, তার মস্তিষ্ক মানুষের এই কথা কেমন বিদ্‌ঘুটে ঠেকল তার। কেমন একটা অপ্রাকৃত কৌতূহল, প্রায় সংস্কারাচ্ছন্ন একটা আতঙ্ক পেয়ে বসল তাকে।

৩১ মার্চ। হাতির করোটিটা আজ এল। প্রফেসর তাকে আড়াআড়ি করে করাতে কেটে ফেললেন।

বললেন, ‘মস্তিষ্কটা ভেতরে বসানোর জন্য এটা দরকার। অন্য একটা মাথার খোলে স্থানান্তরিত করার সময়েও এতে সুবিধা হবে। করোটির ভেতরটা দেখে অবাক লাগল; যে জায়গায় মস্তিষ্ক থাকার কথা, সেটা তুলনায় অনেক ছোট। অথচ বাইরে থেকে হাতিকে দেখায় যেন অনেক বেশি ‘মস্তিষ্কওয়ালা’।

ভাগ বললেন, ‘স্থল প্রাণীদের মধ্যে হাতির কপালের দেয়ালই সবচেয়ে বিকশিত। দেখছেন তো? খুলির পুরো ওপরাংশটাই ফাঁকা কক্ষ, সাধারণ লোকে ভাবে ওইটাই বুঝি মস্তিষ্কের জায়গা। আসল মস্তিষ্ক তুলনায় অনেক ছোট, হাতির মাথাটার অনেক পেছনে তা লুকানো, এখানটায়, কানের কাছে। সেই জন্যই সামনাসামনি মাথায় গুলি করলে তা প্রায়ই লক্ষ্যে পৌঁছায় না। হাড়ের কতগুলো দেয়াল ভেদ করে যায় বুলেট, কিন্তু মস্তিষ্ক অক্ষত থাকে।’

মস্তিষ্কের খোলের মধ্যে কতগুলো ফুটো করলাম আমরা দুজনে মিলে। এই ফুটো দিয়ে টিউব চালিয়ে পুষ্টিদ্রবণ খাওয়ানো হবে মস্তিষ্ককে; তারপর সাবধানে রিংয়ের মস্তিষ্কটা বসানো হলো আধখানা খোলে, ‘ফাঁকটা অবশ্যই তাতে পুরো ভরল না।’

‘ভাবনা নেই, যেতে যেতে ওটা বেড়ে উঠবে।’ বাকি আধখানা খুলি জুড়তে জুড়তে বললেন ভাগ।

সত্যি বলতে কি, ভাগনারের পরীক্ষা সফল হবে, এ ভরসা আমার বিশেষ ছিল না, যদিও তার অদ্ভুত সব আবিষ্কারের কথা আমি জানতাম। কিন্তু এটা একটা ভয়ানক রকমের জটিল ব্যাপার। বাধা অনেক। প্রথমত, একটা জ্যান্ত হাতি চাই। আফ্রিকা বা ভারতবর্ষ থেকে একটা হাতি নিয়ে আসতে অনেক খরচ। তার ওপর, কোনো কারণে হয়তো সে হাতি তেমন জুতসই না–ও হতে পারে। তাই ভাগ ঠিক করলেন রিংয়ের মস্তিষ্ক নিয়ে নিজেই যাবেন আফ্রিকার কঙ্গো দেশে। সেখানে একটা হাতি ধরে অকুস্থলেই মস্তিষ্ক স্থানান্তরের অপারেশন চালাবেন। মস্তিষ্ক স্থানান্তর! বলতে তো খুবই সোজা! কিন্তু এ তো আর এক পকেট থেকে আরেক পকেটে দস্তানা চালান করা নয়। সব স্নায়ুমুখে, শিরা–ধমনি এক এক করে বেছে সেলাই করতে হবে। জন্তুর দেহক্রিয়া মানুষের মতো হলেও অনেক তফাত আছে। এই দুই পৃথক ব্যবস্থাকে মিলিয়ে ভাগনার এক করবেন কী করে? আর এই জটিল অপারেশন করতে হবে আবার একটা জ্যান্ত হাতির ওপর...।

চলবে...

লেখক পরিচিতি: রুশ কল্পবিজ্ঞান লেখক আলেক্সান্দার বেলায়েভের জন্ম ১৮৮৪ সালে। পড়াশোনা করেছেন আইন বিষয়ে। কিন্তু বিজ্ঞানপ্রযুক্তি বিষয়ে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। তাঁর লেখা অ্যামফিবিয়ান ম্যান বা উভচর মানুষ সর্বকালের অন্যতম সেরা ও মানবিক কল্পবিজ্ঞান। হৈটি টৈটি তাঁর অন্যতম সেরা বিজ্ঞান কল্প গল্প। ১৯৪২ সালে মারা যান বেলায়েভ।

আরও পড়ুন