অতীতের ছায়া – ৩

ধূসর স্লেটে ঢাকা পাহাড়ের দীর্ঘ সারিগুলো পার হয়ে যাওয়ার পর মরুভূমির প্রাণশূন্য খাঁ খাঁ ভাবটা সবাই আরও বেশি করে অনুভব করতে লাগল। অজস্র বাঁক, ঘুর আর উৎরাই পেরিয়ে ধুলোমাখা গাড়ি তিনটে মিহি বালির সূক্ষ আচ্ছাদনে ঢাকা প্রাণহীন, সীমাহীন সমতলে এসে পড়তে আবার মনে হতে লাগল জগৎটা বুঝি হারিয়ে গেছে। মরুভূমির ওপর গরম হাওয়া কাঁপছে; তার কম্পিত স্রোত বৃথাই চেষ্টা করছে এই রুক্ষ দৃশ্যকে কোমল করে তুলতে, পর্দার আড়ালে ঢেকে রাখতে।

অভিযাত্রীরা তখন স্বপ্নে দেখছে—সুন্দর নীল হ্রদ, মনোরম সব কুঞ্জ, দূরে তুষারাবৃত পাহাড় চূড়ার চমক। কখনো কখনো ভোঁতানাক গাড়িগুলোর সামনেই তারা দেখতে পাচ্ছে সমুদ্র সানন্দে ছোট ছোট ঢেউয়ের বাড়ি মারছে আর তার কুয়াশায় ঢাকা ভূতুড়ে ঢেউগুলো আকাশে সাদা ফেনা ছিটিয়ে দিচ্ছে... কয়েক মিনিট পরেই আবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে বালির ওপারে, বহু দক্ষিণে ছেড়ে আসা শহরটার মতোই ঘন পাতায় ঘেরা সাদা সাদা কুঁড়েঘরের সারি। এমনকি এত বাস্তব আর স্পর্শগ্রাহ্য যে গাড়িগুলো একেক সময় হঠাৎ ভীষণ লম্বা হয়ে উঠছে, ফেঁপে ফুলে বিরাট আকার নিচ্ছে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। অস্তগামী সূর্যের রক্তলাল আলোয় সবার চোখে পড়ল আরেকটা ভূতুড়ে দুর্গের নীল আর সবুজ রঙের লম্বা মিনারেটের শেষ ছবিটুকু।

হেডলাইটের জোর আলো রাত্রির অনেক গভীরে ছড়িয়ে দিয়ে ‘বজ্র’ চলেছে অন্য গাড়িগুলোর আগে আগে। রাতে পথ চলা এখনো সম্ভব। সামনের গাড়িটা ধুলোর ঝড় উড়িয়ে চলেছে। ‘ডাইনোসর’ আর ‘সংগ্রামী’কে তাই অনেক পিছিয়ে পড়তে হয়েছে, ধূলোপথে যাবার যা নিয়ম।

আরও পড়ুন

ঘুমঘুমভাবে গুঞ্জন করে চলেছে ইঞ্জিনটা। ড্রাইভারের পাশে বসে নিকিতিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ‘ডাইনোসর’-এর জোর হর্ন শুনে তার ঘুম ভেঙে গেল।

‘বজ্র’ থেমে যেতে পেছনের গাড়ি দুটি এগিয়ে এল।

‘কী হয়েছে?’ নিকিতিন জিজ্ঞেস করল।

‘আর পারছি না,’ মিনমিন করে বলল “ডাইনোসর”-এর ড্রাইভার। ‘চোখের সামনে সারাক্ষণ ওই অদ্ভুত দৃশ্য…’

‘কেন?’

‘ও ঠিকই বলেছে, সের্গেই পাভলভিচ,’ মার্তিন মার্তিনভিচ ড্রাইভারের সমর্থনে বলল, ‘দিনের বেলা মরীচিকাদের দূরে দেখা যায়, এখন তার একেবারে নাকের সামনে এসে গেছে। ভয়ে গা শিউরে ওঠে।’

‘আমি যদি চালাতে পারি, তবে তুমিই-বা পারবে না কেন?’ সিনিয়র ড্রাইভার ধমকে উঠল।

‘তোমার “বজ্র” তো রয়েছে সামনে, আমাদের যে ধুলার পেছন পেছন যেতে হচ্ছে। আমাদের হেডলাইটে তোমার ওড়ানো ধুলায় যত সব অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখা যাচ্ছে। না, আমরা আর যেতে পারব না,’ বলল ‘সংগ্রামী’র ড্রাইভার।

‘যত বাজে কথা!’ সিনিয়র ড্রাইভার ক্ষেপে উঠল, ‘ধুলায় মাঝেমধ্যে নানা রকম ছায়া দেখা যায় বটে। কিন্তু তার জন্য তোমরা আর এগোতে পারবে না...’

‘তুমিই একবার চেষ্টা করে দেখো না! আমি সামনে যাচ্ছি,’ ক্ষুদ্ধভাবে বলল ‘ডাইনোসর’-এর ড্রাইভার।

‘ঠিক আছে।’ গোমড়া মুখ করে বলল সিনিয়র ড্রাইভার।

একটু পরেই নিকিতিনের মনোযোগ অলস হয়ে এল। হঠাৎ ড্রাইভার ভীষণ জোর স্টিয়ারিং হইল ঘুরিয়ে দিতে গাড়িটা একপাশে বেঁকে গেল। দুজনেই পরিষ্কার দেখতে পেল সামনে একটা মস্ত গোল গর্ত, তার ধারগুলোয় সাদা টালি বসানো। নিকিতিন অবাক হয়ে গিয়ে চোখ ঘষে নিল—গাড়ির আলোয় দেখতে পেল আবর্তিত ধুলোর আড়ালে উঁচু উঁচু বাড়ি

যে যার গাড়িতে ফিরে গেল। আবার ইঞ্জিনের গর্জন। লম্বা পেছনটা দোলাতে দোলাতে ‘বজ্র’কে ছাড়িয়ে ‘ডাইনোসর’ গতি বাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় ধুলার মেঘের ভেতর। সে ধুলো থিতিয়ে পড়া পর্যন্ত ‘বজ্র’ অপেক্ষা করে থাকে। তার সোনালি আলোয় কেবল চমকে ওঠে আলাদা-আলাদাভাবে ধূলিকণা। তারপর সেও এগিয়ে যায় ‘ডাইনোসর’-এর পথ ধরে।

নিকিতিনের তখন ব্যাপারটা দেখার বেশ কৌতূহল হয়েছে। উইন্ডস্ক্রিনটা ঘষে নিয়ে সে সামনের দিকে চেয়ে রইল। কয়েক মাইল চলার পরও যখন অস্বাভাবিক কিছু দেখা গেল না, ড্রাইভার তখন বিড়বিড় করে বকাবকি শুরু করল। গাড়িটা বেশ সহজভাবে এগিয়ে চলেছে। একটু পরেই নিকিতিনের মনোযোগ অলস হয়ে এল। হঠাৎ ড্রাইভার ভীষণ জোর স্টিয়ারিং হইল ঘুরিয়ে দিতে গাড়িটা একপাশে বেঁকে গেল। দুজনেই পরিষ্কার দেখতে পেল সামনে একটা মস্ত গোল গর্ত, তার ধারগুলোয় সাদা টালি বসানো। নিকিতিন অবাক হয়ে গিয়ে চোখ ঘষে নিল—গাড়ির আলোয় দেখতে পেল আবর্তিত ধুলোর আড়ালে উঁচু উঁচু বাড়ি। এত পরিষ্কার ছবি যে নিকিতিন চমকে উঠল। ড্রাইভার মুখ চেপে গালাগালি জুড়ে দিল।

আরও পড়ুন

বাড়িগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। মরুভূমি জুড়ে পড়ে রইল হলদে কালো ডোরাকাটা অলৌকিক এক নক্সা। মাটি দুভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ল এক কালো ফাটল। দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণ জোরে ড্রাইভার স্টিয়ারিং হুইল চেপে ধরে রইল। মরীচিকাদের সে পাত্তা দিতে চায় না। পরমুহূর্তেই সামনে উঠে এল একটা অসম্ভব রকম খাড়া খিলানওয়ালা সেতু। সেতুটা এত বাস্তব যে নিকিতিন উৎকণ্ঠার সঙ্গে ড্রাইভারের দিকে তাকাল। ড্রাইভার তার আগেই ব্রেক কষে দিয়েছে। ‘সংগ্রামী’ ওদিকে পেছন থেকে হর্ণ দিয়ে চলেছে। বিদ্রূপের ভঙ্গিতে অধীরতার ভান করছে। নিকিতিনের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। তারপর চোখ ধুয়ে নিয়ে জানালাটা খুলে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আবার চলতে শুরু করল। আবার আলোর সামনে নাচতে থাকে ধুলোর মরীচিকা। স্নায়ুর উত্তেজনা দ্রুত বেড়ে চলেছে। কাল্পনিক বিপদ এড়াতে গিয়ে ‘বজ্রের’ ব্রেকগুলো ক্রমাগত চিৎকার করে চলে। অবশেষে ড্রাইভার গুমরে উঠে থুতু ফেলে গাড়ি থামিয়ে দেয়। ‘ডাইনোসর’-এর কাছে তার হার মেনে নেয়। ধুলা থিতিয়ে গেলে ‘সংগ্রামী’ও এসে যোগ দেয়। সে অনেক আগেই পেছনে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

(চলবে…)

 

 

* ইভান ইয়েফ্রেমভ একজন রুশ জীবাশ্মবিদ ও কল্পবিজ্ঞান লেখক। জীবাশ্মবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ট্যাফোনোমি। ফসিলের প্যাটার্ন—কোনো প্রাণী কীভাবে পচে গিয়ে জীবাশ্মে পরিণত হয় এবং এ জীবাশ্মের প্যাটার্ন কীরকম—সেসব বিষয় নিয়ে এ শাখায় আলোচনা করা হয়। ইয়েফ্রেমভের বেশ কিছু বিজ্ঞান কল্পকাহিনির একটি অনুবাদ সংকলন প্রকাশিত হয় মস্কোর ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। ইভান ইয়েফ্রেমভ গল্প সংকলন নামের এ বইয়ের গল্পগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন শুভময় ঘোষ।