‘সব তৈরি?’
‘হ্যাঁ, সের্গেই পাভলভিচ। মাল তোলা শুরু করা যেতে পারে।’
‘মার্তিন মার্তিনভিচের কাছ থেকে কাজের হিসাব বুঝে নাও। ‘বজ্র’ হচ্ছে নেতা। তাতে পেট্রল আর যন্ত্রপাতি থাকবে। ‘ডাইনোসর’—পেট্রল, বোর্ড আর তাঁবুর উপকরণ। ‘সংগ্রামী’—জল, খাবারদাবার আর রবার।’
খোলা নিচু দরজাটা দিয়ে ভেতরে আসছে দুপুরের গরম নিঃশ্বাস। ডেস্কের কাগজগুলো নিকিতিন তার চামড়ার ব্যাগটায় ভরছে। খুব ব্যস্ত সে, কারণ একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে।
‘আসতে পারি?’ বাইরে থেকে শোনা গেল একটি মেয়ের গলা।
আলোয় ভরা দরজার কাঠামোয় দেখা গেল একটা ক্ষীণ কালো ছায়া। সাদা পোষাকে আলো পড়ে তার প্রান্তগুলো ঝকমক করছে। ভিতরের আধ-আলো, আধ-অন্ধকারটা সহ্য করার জন্য মেয়েটি একটু নিচু হয়ে চোখ কুঁচকাল। নিকিতিনেরও চোখে পড়ল আগের দিনের বেণীটা।
একটা অস্পষ্ট আনন্দের পূর্বাভাসে দ্রুততর হয়ে উঠল নিকিতিনের হৃৎস্পন্দন। ছোট স্যুটকেস হাতে মেয়েটির জন্য সে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিল।
‘মিরিয়াম—তারপর কী?’ নিকিতিন জিজ্ঞেস করল।
‘তাশ্মুরাদভা। তবে মিরিয়ামই যথেষ্ট, মৃদু হাসি হেসে বলল মেয়েটি।
‘মিরিয়াম, আমাদের অভিযানে অনেক সময় লাগতে পারে, আপনার পক্ষে খুব কষ্টকরও হবে। এতে আপনার ভয় নেই তো?’
কালো চোখ দুটিতে দুষ্টুমি চমকে উঠল, ‘মোটেই না। আপনাদের ব্যবস্থা এত ভাল যে আপনার দলের একজন বলেছে স্বাস্থ্যাবাসে এক মাস কাটানোর চেয়েও বেশি ফল পাওয়া যাবে আপনাদের অভিযানে।’
‘ঠিক আছে। যে গাড়ি আপনার পছন্দ তাতেই উঠে পড়ুন,’ নিকিতিন বলল।
‘আমি মারুসিয়ার সঙ্গে সংগ্রামীতে যেতে চাই।’
‘মেয়েদের একসঙ্গে হতে একটুও সময় লাগে না,’ মিরিয়ামের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এসে নিকিতিন হেসে বলল। তারপর হঠাৎ যোগ করে দিল, ‘ভাল কথা, আপনার সঙ্গে আগেও দেখা হয়েছে কাল রাতে এঙ্গেল্স্ স্ট্রীটে...’
নিকিতিন মাথা নেড়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল তার দিকে।
পথহীন স্তেপের বুক দিয়ে পরপর তিনটে গাড়ি দুলতে দুলতে, ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এগিয়ে চলেছে। চারদিকে দিগন্তবিস্তৃত স্তেপ, রোদে পোড়া, ধূসর, কাঁটাঝোপে ভরা। ঘোলাটে, বিবর্ণ আকাশ সমতলের ওপর যেভাবে নেমে এসেছে, দেখে ভয় করে। চারদিন ধরে ইঞ্জিনগুলো ছুটে চলেছে। শহর আর রেলপথ ছেড়ে চলে গেছে আড়াইশ মাইল দূরে। দীর্ঘ অর্ধচন্দ্রাকার বালিয়াড়ি, পাথুরে টিলা, সমান স্তেপ আর কাঁটাঝোপ, হলদে-সাদা নোনাজলের জলায় ভরা আড়াইশ মাইল পথ। গিয়ারের আর্তনাদ, ইঞ্জিনের একঘেয়ে গুঞ্জন, ড্রাইভারদের ক্লান্ত হাতের ঘামে নেয়ে ওঠা কালো স্টিয়ারিং হুইল।
একবার কেবল সন্ধ্যার বেশ পরে একটা লম্বা পাহাড়ের পেছনে বিজলী বাতির হাতছানি দেখা গিয়েছিল। গন্ধক কারখানার আলো। এখন কেবল ইতস্তত ছড়ানো স্থানীয় যাযাবরদের গোল আর পুরু ফেল্টের তৈরি আস্তানা ইয়ুর্তা ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
শেষ পাড়িটা হলো বেশ লম্বা। কারণ, নিকিতিন জোর চাঁদের আলো আর বাকি ভালো জমিটার পুরো সুযোগ নিতে চায়। ভাপা মাটির অজস্র মসৃণ, নগ্ন টুকরোগুলোকে চাঁদের আলোয় ছোট ছোট হ্রদের মতো দেখাচ্ছিল। গাড়িগুলো তার ওপর দিয়ে প্রাণপণ জোরে ছুটে চলল। রাতে মরুভূমিটাকে একইসঙ্গে যেমন রহস্যময় তেমনি সদয় মনে হতে লাগল।
নরম মাটির ঢিবির গায়ে গাড়িগুলো ধাক্কা খেয়ে ঘন ধুলো ওড়াতে শুরু করলে নিকিতিন থামার আদেশ দিল। গাড়ির পেছন দিকে ইলেকট্রিক বাল্ব ঝুলিয়ে দেওয়ায় ছাউনীটাতে বেশ জোর আলো হলো। কিন্তু জায়গাটা ভাল না—ঘন বরফের মতো এখানেও বালিতে সবার পা অনেক গভীরে ডেবে যেতে লাগল। শুকনো ঘাসের গোড়ায় জায়গাটা একেবারে খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে। নিকিতিন দেখতে পেল, সামনে চাঁদের আলোয় প্রায় অদৃশ্য লাইলি পাহাড়। পাথুরে মরুভূমির বুকে দাঁড়িয়ে পাহাড়টা ঘিরে রেখেছে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুদের সমাধিস্থল।
(চলবে…)