সের্গেই পাভলভিচ নিকিতিন পড়ার ঘরে ঢুকতেই অধ্যাপক সানন্দে বলে উঠলেন, ‘অবশেষে এলে! বরাবরকার মতো দেরীতে!’ নিকিতিন তরুণ জীবাশ্মবিদ। সাম্প্রতিক কতগুলো আবিষ্কারের সঙ্গে তার নামও যুক্ত আছে। অধ্যাপক বলে চললেন, ‘আমার কাছে আজ তুমিই যে প্রথম এলে, তা নয়। পূর্ব স্তেপ অঞ্চলের দুজন বিখ্যাত রাখাল মস্কোয় কৃষি প্রদর্শনীতে যাচ্ছিল। তারাও এসেছিল। এই দেখ তাদের উপহার, বিজ্ঞানীদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধার চিহ্ন। এর চেয়ে বড় খরমুজ কখনো দেখেছ? শুঁকে দেখ। খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে, তাই না? আমাদের রাখাল বন্ধুদের স্বাস্থ্য কামনা করি।’
‘আমায় কি এই কাজের জন্য ডেকেছিলেন, ভাসিলি পেত্রভিচ।’
‘আহা, অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন। বাঁ দিকের টেবিলটা একবার তাকিয়ে দেখ না।’
একটা ছাইরঙা কার্ডবোর্ডের ওপর গুছিয়ে রাখা ঘন খয়েরী রঙের মসৃণ সব বিরাট বিরাট পাথর হয়ে যাওয়া হাড়ের টুকরো। একটা হাড় তুলে নিয়ে নিকিতিন বারকয়েক নখ দিয়ে ঠুকল, তারপর হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। আটটা মোটা ভারী হাড়ের টুকরোর প্রতিটাকে সে এভাবে পরখ করে দেখল। হাড়গুলোর ভেতরে লোহা আর সিলিকন ঠাসা।
কঙ্কাল আর তার শরীরস্থান সম্পর্কে নিকিতিনের গভীর জ্ঞান। তাই সে হাড়গুলোর বাড়তি অংশগুলো মনে মনে বসিয়ে লুপ্ত জন্তুটার পুরো চেহারাটা আঁচ করতে পারল।
‘ও, হাড়ের ওপরের এই ঘন, পালিশ ত্বকটা হচ্ছে মরুভূমির ছাপ। তার মানে রাখালেরা মরুভূমির ওপরেই এদের পেয়েছে, মাটি খুঁড়ে নয়। ভাসিলি পেত্রভিচ, এগুলো ডাইনোসর! এরকম ভালো অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়নে এই প্রথম পাওয়া গেল। রাখালদের কিছু একটা পুরস্কার দেওয়া খুব দরকার।’
‘টাকা? হা হা! ওরা যে আমাদের মতো অধ্যাপকদের চেয়ে অনেক বড়লোক, তা তুমি জানো না? ওরাই তো বরং জিজ্ঞেস করছিল, ওদের যৌথখামার থেকে আমাদের জন্য কিছু করতে পারে কি না। এটা কেবল ওদের বৈজ্ঞানিক কৌতূহল। কাল ওরা তোমার কাছে আসবে। কিছু ‘সিলিআউ’ নিয়ে আসবে—এর মানে ওদের ভাষায়, বন্ধুত্বের উপহার। নাও, এসো, এবার খরমুজটা খেতে খেতে কথা বলা যাক।’
সুস্বাদু, সুগন্ধ খরমুজের একটা টুকরো হাতে নিয়ে নিকিতিন দেয়ালে টাঙানো ম্যাপটার কাছে নিচু হয়ে দাঁড়াল। দেখতে লাগল ফোঁটাকাটা বাঁ কোণটা। ফোঁটাগুলো হচ্ছে মরুভূমির বিপজ্জনক বালির প্রতীক। অধ্যাপক তাঁর আরাম কেদারায় বসে মাথা নুইয়ে নিকিতিনের আঙুল লক্ষ্য করে তাকিয়ে রইলেন।
‘ডাইনোসরের হাড়ের বিরাট জায়গাটা এখানেই কোথাও হবে,’ নিকিতিন বলল, ‘তাল্দি-সাইয়ের উৎস থেকে দুই শ মাইল। এই হচ্ছে বিস্সেক্তা, সবচেয়ে কাছাকাছি কূপ। আমাদের পথটা গেছে লাইনি পাহাড়ের দিকে, তারপর এগিয়ে গেছে পাথুরে মরুভূমি আর কিছু টুকরো স্তেপ অঞ্চলের ভেতর দিয়ে।’
উঠোনের বিজলি বাতিতে নিকিতিন দেখতে পেল, অভিযানের বাকি লোকেরা সবাই ভ্যানগুলোর চারপাশে জড়ো হয়েছে। সবাই খুব হাসছে।
‘আরিক’-এর জলের মৃদু কলস্বর। নিকিতিন পানির ধারে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে। বাড়ির চারপাশের গাছগুলোর ঘন সবুজ পাতার আড়ালে ছায়া আরও ঘন হয়ে উঠেছে।
সোজা সামনে সে দেখতে পেল ছায়ায় ঘেরা পথ পেরিয়ে আসছে সাদা ফ্রকপরা একটি ছিপছিপে মেয়ে। মেয়েটি ‘আরিক’টা লাফিয়ে পেরিয়ে পথ ধরে এগোতে লাগল। তার রোদে পোড়া পা দুটি মাটিতে প্রায় অদৃশ্য। তাই মনে হচ্ছে মেয়েটি যেন হাওয়ায় ভেসে আসছে। পিঠের ওপর পড়ে রয়েছে মোটা কালো বেণী। সাদা ফ্লকের ওপর আরও কালো দেখাচ্ছে। বেণীর ফাঁপানো প্রান্তটি নেমেছে কোমরের নিচে।
দ্রুত পায়ে চলে যাওয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নিকিতিন দাঁড়িয়ে পড়ল। একটুখানি ভেবে নিল। তারপর তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ল অভিযানের জন্য যে বাড়িটা নেওয়া হয়েছে, তার বড় কাঠের গেটের কাছে।
উঠোনের বিজলি বাতিতে নিকিতিন দেখতে পেল, অভিযানের বাকি লোকেরা সবাই ভ্যানগুলোর চারপাশে জড়ো হয়েছে। সবাই খুব হাসছে। এমনকি গোমড়ামুখো সিনিয়র ড্রাইভারের মুখে পর্যন্ত আকর্ণবিস্তৃত হাসি।
কালোচোখ মারুসিয়া নিকিতিনের কাছে এগিয়ে এল। মারুসিয়া হলো ল্যাবরেটরির সহকর্মী। সম্প্রতি সে পার্টি সংগঠকের পদে নির্বাচিত হয়েছে। মারুসিয়া বলল, ‘সের্গেই পাভলভিচ, আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? একটা সভা ডাকব বলে ভাবছি, অথচ আপনার দেখা নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সভা আপনিই শুরু হয়ে গেল।’
‘বেশ মজার সভা বলে মনে হচ্ছে!’ নিকিতিন হেসে ফেলল।
‘লরিগুলোর নাম দেওয়া হচ্ছে,’ মারুসিয়া জানাল।
‘নাম? লরির?’
‘চমৎকার। কমরেড নিকিতিন, আমার একটা উপকার তোমায় করতে হবে।‘ সম্পাদক একটু থেমে আবার বলল, ‘এই একটু আগেই আমি একটা সভায় গিয়েছিলাম।
‘চালকদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা হবে বলে ঠিক হয়েছে। মার্তিন মার্তিনভিচ বলেছে, প্রতিটি ভ্যানের একটা করে নাম থাকা চাই।’
‘নামগুলো শুনি!’
মার্তিন মার্তিনভিচ এগিয়ে এসে বলল, ‘তোমার ভ্যানটার নাম “বজ্র”, অন্য দুটোর নাম “সংগ্রামী” আর “ডাইনোসর”।’ মার্তিন মার্তিনভিচ খননের কাজে দক্ষ। জাতে সে লাতভীয়। বয়সও হয়েছে। চোখে গোল চশমা।
রাস্তায় একটা জোরাল হর্ন শোনা গেল। খোলা গেটের ওপর এসে পড়ল একটা ‘জিস্’ গাড়ির হেডলাইটের আলো। নিকিতিন এগিয়ে গেল আঞ্চলিক পার্টি কমিটির সম্পাদকের দিকে। তার সঙ্গে আগেও এই অভিযান নিয়ে নিকিতিনের দেখা হয়েছে।
‘তোমরা তো এখানে বেশ ভালোই আছ দেখছি,’ সম্পাদক বলল, ‘কবে যাচ্ছ?’
‘পরশু।’
‘চমৎকার। কমরেড নিকিতিন, আমার একটা উপকার তোমায় করতে হবে।‘ সম্পাদক একটু থেমে আবার বলল, ‘এই একটু আগেই আমি একটা সভায় গিয়েছিলাম। বিস্সেক্তার কাছে নাকি অ্যাসফল্টের সঞ্চয় আছে। আমার ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, জায়গাটা খুঁজে দেখা দরকার। মোট কথা, ভূবিদ্যা বিভাগের একজনকে তোমার দলের সঙ্গে নিতে হবে।’
নিকিতিনের মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল। সম্পাদক নিকিতিনের হাতে হাত গলিয়ে তাকে উঠোনের এক প্রান্তে টেনে নিয়ে গেল।
(চলবে…)