রাত্রিবাসের জন্য গাড়িগুলো থামা মাত্রই সব ভূতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট করে। রাত্রি তার দিগন্ত ভরে দিল কালো শূন্যতায়। মাথার ওপর বড় বড় তারার শান্ত জ্যোতি। পরিচিত তারকাপুঞ্জ দেখে সবাই আরাম বোধ করল। দিনের বেলা শুরু হবে ইঞ্জিনের শব্দ আর গাড়ির দুলুনি, সেই সঙ্গে আবার যত ভূতুড়ে ব্যাপারের আক্রমণ।
নতুন মরীচিকার অস্বচ্ছ দেয়ালের আড়ালে হঠাৎ আর্কার্লি পাহাড়ের কালো ছায়ারেখা চোখে পড়তে নিকিতিন অত্যন্ত স্বস্তি বোধ করল। বহুক্ষণ পর্যন্ত রেডিয়েটর-ক্যাপের ওপর দিয়ে দেখা গেল আর্কার্লির চূড়াগুলো। পাহাড়গুলো দ্রুত বেড়ে উঠে পুরো উত্তর-পশ্চিম দিগন্তটা ঢেকে ফেলেছে। পথপ্রদর্শক একটা পাহাড় দেখাল। পাহাড়টা ফাটলে ভরা, সামনের ঢালুটা চতুর্ভুজের আকার নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই ‘বজ্র’ ওদিকে ঘুরল। মাটিটা এখানে আর সমান নয়। তার পাথুরে বন্ধুরতা ক্রমে বাড়ছে।
আরেকটা সরু বাঁক ফিরে ‘বজ্র’ ব্রেকের বাঁধন চেপে রেখে ছুটে চলল একটা মস্ত সমতলভূমির দিকে। জায়গাটা একটা প্রাচীন পাহাড়ের নাব।
সমতলের পশ্চিম সীমান্তে বিষণ্ণ, কালো পাহাড়। ডানদিকের পাহাড়গুলোর খাড়া চড়াই উজ্জল লাল বালিপাথরে তৈরি। অনেক উঁচুতে উড়ছে দুটো ঈগল।
অভিযাত্রীদের নিয়ে পথপ্রদর্শক লাল পাহাড়ের ধার দিয়ে এগোতে লাগল উত্তরের দিকে। একজায়গায় এসে দেখা গেল পাহাড়ের লাল রং বদলে হয়েছে কালচে। এখানেই বিস্সেক্তার প্রাচীন কূপ।
এখানে ওখানে সমতলের সমান জমিতে সরু সরু নালি, আর যত্রতত্র অজস্র ছড়ানো মরুভূমির বার্নিশ লাগানো মসৃণ নুড়ি। নুড়িগুলোর জন্য মাটিটা অস্বাভাবিক কালো দেখাচ্ছে। তাদের ফাঁকে ফাঁকে সঞ্চিত স্বচ্ছ জিপসামের কেলাস রোদের প্রতিফলনে অজস্র ছোট ছোট আলোর ফুলকি তুলেছে।
‘থাম! থাম!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে নিকিতিন গাড়ি থেকে নেমে বেরিয়ে গেল।
হাড়গুলো অন্যরাও দেখতে পেয়েছিল। তারাও নিকিতিনের পেছন পেছন ছুটে গেল।
অভিযাত্রীরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে সমতলে ছড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার আর মজুররাও তাদের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে এই অভূতপূর্ব দৃশ্যে উৎসাহী হয়ে উঠল। অল্প কিছু হাড় রয়েছে মাটির ওপরে, বাকি সবটাই বালিপাথর আর নুড়ির নিচে পোঁতা
বাঁদিকে পড়ে আছে প্রস্তরীভূত গাছের দুটো লম্বা গুঁড়ি। তাদের সরলবর্গীয় কাঠ আর ডাল কড়া রোদে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। চারদিকে পড়ে আছে কালচে অথচ চকচকে বিরাট বিরাট হাড়।
অভিযাত্রীরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে সমতলে ছড়িয়ে পড়ল। ড্রাইভার আর মজুররাও তাদের উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে এই অভূতপূর্ব দৃশ্যে উৎসাহী হয়ে উঠল। অল্প কিছু হাড় রয়েছে মাটির ওপরে, বাকি সবটাই বালিপাথর আর নুড়ির নিচে পোঁতা। নালিগুলোতেও অনেক হাড় বেরিয়ে রয়েছে।
রাখালরা ঠিকই বলেছে। লুপ্ত প্রাণীর সমাধিক্ষেত্রেই তারা এসে পড়েছিল। এর আগে এ জাতের প্রাণীর এত বড় সমাধিক্ষেত্র আর পাওয়া যায়নি।
উপত্যকাটা কেমন যেন ভয়াবহ। কালো গরম, প্রাণহীন উপত্যকা, চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে বিরাট বিরাট হাড়। দেখে মনে পড়ে যায় পুরোনো সব উপকথা—ড্রাগনদের লড়াই, দৈত্যদের কবর, বিরাট প্লাবনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাক্ষসজাতি। এ রকম অসংখ্য দৈত্যাকার হাড় ছড়ানো জায়গাগুলোই হয়তো ওসব উপকথার উৎস।
উপত্যকায় অভিযাত্রীদের দ্বিতীয় দিন।
‘কী? এখনো যথেষ্ট পানি পাওয়া গেল না?’
‘না, সের্গেই পাভলভিচ।’
‘আরও খোঁড়, আরও গভীরে।’
‘আর যে পারা যাচ্ছে না। পাথরে এসে ঠেকেছি।’
‘পাথরে!’
কাগজপত্র ফেলে রেখে নিকিতিন সেদিকে ছুটল। মার্তিন মার্তিনভিচ ঠিকই বলেছে দেখে তার মন ভেঙে গেল। মনের হতাশা যথাসাধ্য চেপে রাখার চেষ্টা করে নিকিতিন ধীরে ধীরে ক্যাম্প ছেড়ে পাহাড়ের দিকে হাঁটতে লাগল। সব নতুন করে ভেবে দেখার জন্য সে এখন একা থাকতে চায়।
খবরটা সত্যি খারাপ—অভিযাত্রীদলের প্রয়োজনের পক্ষে বিস্সেক্তার জলসঞ্চয় খুব কম। দু-একজন মরুচর আর তাদের উটগুলোর পক্ষে অবশ্য এই পানিই যথেষ্ট। কিন্তু লোকজন, লরিতে ভর্তি একটা বিরাট অভিযাত্রীদলের পক্ষে তা অত্যন্ত সামান্য... এক শতাব্দী আগে হয়তো জলসঞ্চয়টার অবস্থা এরচেয়ে ভালোই ছিল। এখন কিন্তু শুকিয়ে এসেছে। আপদকালের জন্য যে জল আনা হয়েছে, তাই তবে এখন খরচ করতে হবে। কিন্তু ফিরতি পথের জন্য তো পানি চাই, সে পানি কোথায় পাওয়া যাবে? না, আরও পুবে যেতেই হবে, তা তার ফল যা-ই হোক না কেন। সেখানে হয়তো ভালো জলাশয় পাওয়া যেতে পারে। ওখান থেকে এই উপত্যকায়ও হয়তো জল নিয়ে আসা যাবে। কিন্তু লরিগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো পেট্রোল তবে আর থাকবে না।
অভিযাত্রীরা মুশকিলে পড়ে গেল। সব সরঞ্জামই রয়েছে, কিন্তু এই রোদে ফাটা পাথরের রাজ্যে তা কিছু কাজে আসবে না।