প্রিয় পুত্র আমার,
ডাক্তাররা বলেছেন, আমি আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাঁচব। আমার জীবদ্দশায় বিশ্ব বিশৃঙ্খল পারমাণবিক যুগ থেকে বর্তমান যুগের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় উন্নীত হয়েছে। এই উপলব্ধি নিয়ে আমি পরিতৃপ্ত মনে মারা যাচ্ছি।
গত দশ বছর ধরে আমি তোমাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় সব শিখিয়েছি। যদিও একটা চূড়ান্ত শিক্ষা দেওয়া এখনও বাকি।
আমার শয়নকক্ষের দেয়ালে একটি প্রশংসাপত্র ঝুলছে—‘এক কৃতজ্ঞ সরকার থেকে এমন এক সেবার জন্য দেওয়া হয়েছে, যা গোপনীয়তার কারণে এখানে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’
গত কয়েক বছরে তুমি আমাকে অনেকবার এই প্রশংসাপত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছ, কিন্তু প্রতিবারই আমি তোমার কথা এড়িয়ে গিয়েছি। কিন্তু এখন তোমাকে সত্যটা জানানোর উপযুক্ত সময় এসেছে।
আজ থেকে চার দশক আগে আমি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর একজন সাধারণ ক্যাপ্টেন ছিলাম। যুক্ত ছিলাম ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরেতে সশস্ত্র বাহিনীর ভাষা স্কুলে। তখন মাত্রই আমি কোরিয়ায় দায়িত্ব পালন করে ফিরেছি। সেটা তখনকার সময়ের এক নগণ্য যুদ্ধ ছিল। দক্ষতার জন্য আমি তখন ভালো খ্যাতি অর্জন করেছিলাম। কিন্তু তারপরও আমার পরের নিয়োগ হয় মন্টেরেতে। বিদেশি ভাষায় পারদর্শিতার কারণে আমাকে রুশ ভাষার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পাশাপাশি অন্যান্য স্লাভিক ভাষাও পড়ানোর দায়িত্ব পাই।
তখন আমার জীবনটা একদম শান্তিপূর্ণ ও নির্ঝঞ্ঝাট ছিল। যখন ওয়াশিংটনে নতুন দায়িত্ব পালনের আদেশ পেলাম, তখন মনে মিশ্র অনুভূতি কাজ করেছিল। তখনো জানতাম না, এই আদেশ শুধু আমার জীবনকেই নয়, বরং পুরো বিশ্বকে পাল্টে দেবে…
একদিন তুমি আর আমি আমাদের মন্টেরের বাড়ির লনে খেলছিলাম। সেদিন রাশিয়ার তত্ত্বাবধানে এক অচেনা হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানী একটা চমকপ্রদ আবিষ্কার করেন। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর কাজ সম্পর্কে উদ্বেগজনক কিছু গুজব ওয়াশিংটনে পৌঁছায়। মস্কো ও বেলগ্রেডে আমাদের দূতাবাস থেকে জানানো হলো, রাশিয়া মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় তীব্র তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের সন্দেহ, সেখানে ব্যাপক মাত্রার ম্যাস হিপনোসিসের ওপর বিশাল পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে।
আমিসহ মোট চার গোয়েন্দাকে এই গুজবের সত্যতা যাচাই ও হুমকি নির্মূল করার দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু তার আগেই খবর পেলাম, গুজব আর গুজব নেই, বাস্তবে পরিণত হয়েছে—বিশ্বের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সম্মোহিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটা যন্ত্র প্রায় সম্পূর্ণ হওয়ার পথে!
১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে আমি রাশিয়ায় প্রবেশ করি একজন সরকারি কর্মকর্তার ছদ্মবেশে। নতুন পরিচয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে কিছুটা আশঙ্কায় ছিলাম।
তিন মাস ধরে আমাদের পদার্থবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের ওপর কঠোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। তারপর আমাদের চারজনকে পৃথকভাবে পাঠানো হলো বিজ্ঞানী ও তার যন্ত্র খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে। যদিও পরে আমার অন্যান্য সঙ্গীদের আর কখনও দেখিনি...
১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে আমি রাশিয়ায় প্রবেশ করি একজন সরকারি কর্মকর্তার ছদ্মবেশে। নতুন পরিচয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে কিছুটা আশঙ্কায় ছিলাম। কিন্তু রাশিয়ানদের চেহারার সঙ্গে আমার চেহারা অবিকল মিলে গিয়েছিল। আমাকে বাছাই করার প্রধান কারণ ছিল এটাই। নিখুঁত ব্রিফিংয়ের কারণে আমি সহজেই রাশিয়ায় প্রবেশ করি। শিগগিরই রুশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠলাম এবং পুলিশের গোপন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বিভাগে যুক্ত হলাম। সেখান থেকেই আমি ‘প্রোজেক্ট পারচাক’ নামে একটা অতিগোপন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হই।
যন্ত্রটা তখন প্রয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে, কেবল কার্যক্ষমতা যাচাই করা বাকি ছিল। আমার নিয়োগের মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই তারা সফলভাবে কাজটা সম্পন্ন করে ফেলে।
১৯৫৬ সালের জুন মাসে, রাশিয়ান সরকার আমাকে হাঙ্গেরির ব্রেইলা শহরের এক ছোট বাড়িতে পাঠায়। সেখানে যন্ত্রটার গোপন একটা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পরিকল্পিতভাবে আমি একদিন আগেই সেখানে পৌঁছে সরাসরি গবেষণাগারে প্রবেশ করি।
যন্ত্রটার আবিষ্কারক ড. মাইকেল পারচাক আমার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাদের মাঝে টেবিলের ওপর এক জটিল যন্ত্র রাখা ছিল, দেখতে অনেকটা রেডিও ট্রান্সমিটারের মতো। কিন্তু এর ক্ষমতা ছিল অসীম, যা সমগ্র পৃথিবীর সব চিন্তাশীল প্রাণীকে হিপনোটাইজ করতে সক্ষম। এই যন্ত্রের অপার শক্তি এনে দিতে পারে অকল্পনীয় মঙ্গল কিংবা চূড়ান্ত ধ্বংস।
ড. পারচাক তাঁর সাফল্য নিয়ে গর্ব করছিলেন। কিন্তু আমি তাঁর কথায় আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। মানবতার উন্নতির জন্য কাজ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই শক্তি ব্যবহার করতে চাইছিলেন।
আমার ওপর যন্ত্রটা ধ্বংস করার আদেশ ছিল। কিন্তু আমি আদেশ পালন করিনি। বরং এই যন্ত্রের সাহায্যে আমি নিরাপদে হাঙ্গেরি থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি।
আমি যন্ত্রটার গোপন কার্যপ্রণালি সম্পর্কে জানার জন্য ধৈর্য ধরে তাঁর সব কথা শুনলাম। তারপর সুযোগ বুঝে হত্যা করলাম পারচাককে।
আমার ওপর যন্ত্রটা ধ্বংস করার আদেশ ছিল। কিন্তু আমি আদেশ পালন করিনি। বরং এই যন্ত্রের সাহায্যে আমি নিরাপদে হাঙ্গেরি থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি। তুমি যে প্রশংসাপত্রটা দেখেছ, তা কেবল আমার অসংখ্য সম্মাননার একটি।
কয়েক সপ্তাহ পর আমি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে একটা নির্জন আশ্রয়ে চলে যাই। সেখানে যন্ত্রটার ওপর আরও গবেষণা চালাই। আমাদের পৃথিবীতে যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিদ্যমান, তা আমার গবেষণার চূড়ান্ত সাফল্য।
আমার শয়নকক্ষের উত্তর কোণের দেয়ালে যন্ত্রটা লুকিয়ে রেখেছি। পুত্র আমার, এখন তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হলো। এটাকে প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করো। আমাদের দাসগুলোর প্রতি সদয় হও। এই পৃথিবীটা এখন তোমার।
ইতি
তোমার স্নেহের পিতা
প্রথম ফ্রান্সিস, পৃথিবীর প্রথম সম্রাট