মানবজাতির রক্ষক

‘আপনি সমগ্র মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেছেন?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর লেটন।

‘হ্যাঁ,’ বললাম আমি, ‘তা বলতে পারেন।’

প্রফেসর লেটন তখনও সন্দিহান। ‘আপনার মেশিনটা বেশ অত্যাধুনিক। এটা নিশ্চয়ই আপনার টাইম মেশিন, যেটা আপনাকে ভবিষ্যতে নিয়ে যায়। তাই না?’

‘না,’ বললাম, ‘মেশিনটা এখানেই থাকে। এটা যেকোনো কিছুকে ভবিষ্যতে পাঠাতে পারে এবং আমি একটা বাটন টিপে সেটাকে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে নিয়ে যেতে পারি।’

সত্যি বলতে, প্রফেসর লেটনকে আমি কখনোই পছন্দ করিনি। যদিও তাঁর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করি। একজন বিজ্ঞ মানুষ হিসেবে তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।

‘তাহলে ভবিষ্যৎ অপরিবর্তনীয়?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ‘পরিবর্তন করা যায় না?’

‘আমি নিজেই সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি,’ আমি বললাম। ‘কিন্তু আপাতত এটাই সঠিক বলে মনে হচ্ছে।’

শুরুতে আমি সাধারণ বস্তুর ওপর পরীক্ষা চালাই। এতে সুবিধা হচ্ছে, ছোটখাটো ভুলগুলো চাইলেই শোধরানো যায়। শুরুতে আমি ট্রান্সফারেন্স সার্কেলের মধ্যে দ্য মিল অন দ্য ফ্লস নামে একটা বই রেখেছিলাম। তারপর বইটাকে দুই শ বছর ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দিই।

পাঁচ মিনিট পর যখন বইটা বর্তমানে ফিরিয়ে আনলাম, তখন ওটা কিছুটা ভেজা ছিল। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল!

আমি পরে ল্যাম্প, টেবিল, চেয়ার এবং অন্যান্য বস্তুর ওপরেও পরীক্ষা চালিয়ে সফল হই। তারপর জীবন্ত প্রাণীর ওপরেও চলে পরীক্ষা। শুরুতে একটা গোল্ডফিশের ওপর। তারপর আমার এক বন্ধুর পোষা কুকুরকেও পাঠাই।

আমার মনে আছে, ভারী সবুজ চেয়ারের একটা পায়ার সঙ্গে কুকুরটাকে বেঁধে রেখেছিলাম। আমি চাইনি ওটা ভবিষ্যতে কোথাও হারিয়ে যাক। এমন কিছু হলে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।

অনেকটা সাহস জোগাড় করে কুকুরটাকে বিশ হাজার বছর ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দিলাম। দশ মিনিট পর ফিরিয়ে আনলাম বর্তমানে। ওটা স্বাভাবিকই ছিল। শুধু থেমে থেমে হাঁচি দিচ্ছিল।

আমার গণনা অনুযায়ী, আমি কুকুরটাকে বিশ হাজার বছর ভবিষ্যতে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু নিশ্চিত হব কীভাবে যে কুকুরটা সত্যিই ভবিষ্যতে গিয়েছিল?

তাই বাধ্য হয়ে সবুজ চেয়ারটায় বসে ছোট পোর্টেবল কন্ট্রোল মেকানিজমটা হাতে নিলাম। কত বছর সেট করব? হাজার বছর? নাকি শুরুতে দশ বছর ভবিষ্যতে গিয়ে দেখব? অথবা বিশ বছর?

প্রফেসর লেটন নাক টানলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি অবশ্য এটা অনুমান করেছিলাম। তা, শুধু কি উদ্ভিদ নিজেদের রিকভার করতে পেরেছিল? মানুষেরা পারেনি? তখন কি মানুষ ছিল? নাকি ছিল না?’

আমি হাসলাম। দশ বছর বা বিশ হাজার বছরের মধ্যে আলাদা কোনো পার্থক্য নেই। আমাকে ভবিষ্যতে যাত্রা করতেই হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম, বিশ হাজার বছর ভবিষ্যতে যাব।

বাটন টিপলাম।

প্রফেসর লেটন একটা সিগারেট ধরালেন। ‘আপনি ভবিষ্যতের পৃথিবী দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ, সবুজ পৃথিবী,’ আমি বললাম।

‘চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। পরে জানতে পারি, চৌদ্দ হাজার বছর পর প্রকৃতি নিজেকে রিকভার করতে পেরেছে। উদ্ভিদরা অন্তত পেরেছে।’

‘কী ঘটেছিল চৌদ্দ হাজার বছর আগে?’

‘পারমাণবিক যুদ্ধ, হাইড্রোজেন বোমার যুদ্ধ, আরও অনেক কিছু।’

প্রফেসর লেটন নাক টানলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি অবশ্য এটা অনুমান করেছিলাম। তা, শুধু কি উদ্ভিদ নিজেদের রিকভার করতে পেরেছিল? মানুষেরা পারেনি? তখন কি মানুষ ছিল? নাকি ছিল না?’

‘হ্যাঁ,’ বললাম আমি, ‘মানুষ ছিল বটে।’

‘তারা কি বিবর্তিত হয়েছিল বা তেমন কিছু?’

‘না। ভবিষ্যতের মানুষেরা দেখতে অনেকটা আমাদের মতোই। কিন্তু তারা দ্রুত মারা যাচ্ছিল।’

‘কী কারণে? তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, নাকি দূষিত বায়ুমণ্ডল তাদের মৃত্যুর পেছনে দায়ী?’

‘না। আমি আগেই বলেছি, প্রকৃতি নিজেকে রিকভার করে ফেলেছে। বাতাস তখন বিশুদ্ধ ছিল। আসলে সমস্যাটা ছিল তাদের মধ্যেই। তাদের মনে।’

‘তাদের মনে কী সমস্যা ছিল?’

এআই আর্ট
আসলে সময়ের বিনিময় হার সবসময় একই। আমাদের বর্তমানের এক ঘন্টা ভবিষ্যতেও এক ঘন্টার সমান। তেমনই ভবিষ্যতে এক সপ্তাহ বর্তমানেও এক সপ্তাহ। মানে আপনি ভবিষ্যতে যত সময় কাটাবেন, বর্তমানেও ততটুকু সময় পার হবে

আবার হাসলাম। ‘আমার মনে হয়েছে এত কিছুর পর মানবজাতি নিজেকে দায়ী ভাবতে শুরু করেছিল। সব কিছুতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, নিজেদের অস্তিত্ব আর টিকিয়ে রাখবে না। আমি পৃথিবীর ডজনখানেক ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। যেখানেই গিয়েছি, সেখানকার পরিস্থিতি একই রকম বলে মনে হলো। আমার অনুমান বলে, পৃথিবীর জনসংখ্যা তখন এক লাখেরও কম।’

লেটন তার চুলে আঙ্গুল চালালেন। ‘আপনি তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন? মানে তারা সবাই ইংরেজিতে কথা বলত না নিশ্চয়ই?’

‘না। প্রকৃতপক্ষে এখনকার চেয়ে তাদের ভাষায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তাদের বুদ্ধিমত্তা তখনও প্রশংসাযোগ্য। শুধু বেঁচে থাকার ইচ্ছাটুকুই ছিল না।’

প্রফেসর লেটন আঙুল নাড়িয়ে বললেন, ‘আপনি দাবি করেন যে আপনি মানবজাতিকে রক্ষা করেছেন...’ কিছুটা সামনে ঝুঁকে এলেন তিনি, ‘তা, আপনি ভবিষ্যতে মোট কত সময় অবস্থান করেছিলেন?’

‘এক সপ্তাহ। ভবিষ্যতের যাত্রাটা ছিল অপূর্ব। নিজেকে পর্যটক বলে মনে হচ্ছিল।’

‘এক সপ্তাহ?’ হাসতে হাসতে বললেন তিনি, ‘মনে হয় আপনি কোনো স্থান-কালের র‍্যাপের সম্মুখীন হয়েছিলেন। হয়তো ভবিষ্যতের এক সপ্তাহ আপনার কাছে বর্তমানের একটি মুহূর্ত ছিল মাত্র!’

‘না,’ আমি বললাম। ‘আসলে সময়ের বিনিময় হার সবসময় একই। আমাদের বর্তমানের এক ঘন্টা ভবিষ্যতেও এক ঘন্টার সমান। তেমনই ভবিষ্যতে এক সপ্তাহ বর্তমানেও এক সপ্তাহ। মানে আপনি ভবিষ্যতে যত সময় কাটাবেন, বর্তমানেও ততটুকু সময় পার হবে।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ‘আমার অবির্ভাব তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে হয়তো আপনার কোনো ধারণাই নেই। আমি স্বভাবতই তাদের নেতা হয়ে উঠি। আমি তাদের যা নির্দেশ দিতাম, তারা সেটাই পালন করত। যতক্ষণ তাদের সঙ্গে ছিলাম, ততক্ষণই তাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছা ছিল। সত্যি বলতে কি, এটা আমাকে চিন্তিত করে তুলেছিল।’

আরও পড়ুন

প্রফেসর লেটন সিগারেটটা কামড়াচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। ‘আপনার মেশিনটি আপনাকে কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে?’

‘একুশ হাজার বছর,’ আমি বললাম। ‘মনে হচ্ছে এটাই টাইম মেশিনের সর্বোচ্চ সীমা।’

‘তাহলে আপনি ভবিষ্যতে বিশ হাজার বছর ভ্রমণ করেছেন এবং জানতে পারেন মানবজাতি তখন বিলুপ্তির পথে?’

‘হ্যাঁ।’

‘এ জন্যই আপনি চিন্তিত?’

‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।’

তিনি আবার হেসে বললেন, ‘সেক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার পরিবর্তে আপনি টাইম মেশিন ব্যবহার করে আরও এক হাজার বছর ভবিষ্যতে যেতে পারেন। নিজ চোখেই দেখতে পারেন মানবজাতি রক্ষা পেল কি না?’

‘আমি তা-ই করেছিলাম।’

তিনি সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। ‘তারপর? মানবজাতি রক্ষা পেয়েছে?’

আমি মাথা নাড়ালাম, ‘হ্যাঁ, সফলতার সঙ্গেই।’

তিনি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ‘এক সপ্তাহে আপনি পুরো মানবজাতিকে রক্ষা করে ফেললেন?’

‘হায় খোদা! না,’ আমি বললাম। ‘মানবজাতিকে বাঁচাতে সারা জীবন লেগে যাবে।’

‘আপনি বাঁচিয়েছেন?’

‘না।’

তিনি ভ্রুকুটি করে সবুজ চেয়ারটায় একটু উঠে বসলেন। ‘তাহলে কে করল?’

‘আপনি’, আমি বললাম। ‘সঙ্গে সঙ্গে টিপে দিলাম বাটনটি।’

অনুবাদক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়