ছোট থেকেই রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকার অভ্যাস আমার। নিস্তব্ধ একটা আকাশ আর দূরের তারাগুলো। অসীম এই মহাবিশ্ব! এখানে কি আমরা একা? আর কোথাও কি কোনো প্রাণী নেই? কী অর্থ এসবের? আমরা কেন পৃথিবীতে এসেছি?
আমার দাদু ছিলেন একজন পর্যটক। আফ্রিকার এক বুড়ো ওঝা ওনাকে একবার বলেছিল, ‘আমরা আলোতে নেই, আছি অন্ধকারে! একদিন আলো আসবে, সত্য প্রকাশিত হবে।’
বুড়োর কথার অর্থ বোঝেননি দাদু, আমিও না।
বিজ্ঞানের প্রতি অপরিসীম ঝোঁক ছিল আমার। পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলাম, মহাকাশবিজ্ঞান সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। ভালো ফলের জন্য অধ্যাপকেরাও আমাকে বেশ পছন্দ করতেন।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মহাকাশ গবেষণা সংস্থায় চাকরি পেয়ে গেলাম। আবার সেই পুরোনো নেশা পেয়ে বসল আমাকে। এই মহাবিশ্বে কি আমরা একা? আর কেউই কি নেই?
মানমন্দিরে বসে চুপচাপ টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখতাম। নিস্তব্ধ একটা আকাশ আর মিটমিটে তারাগুলো।
না, আমরা একা নই! হতেই পারি না। আমাকে জানতে হবে মহাবিশ্বের রহস্য! শুরু করলাম গবেষণা, নতুন একধরনের সাংকেতিক ভাষা দাঁড় করালাম। সেই ভাষায় বার্তা পাঠাতে লাগলাম মহাকাশে।
সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল।
মাসের পর মাস বার্তা পাঠিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু উত্তর আসত না। হতাশ হয়ে পড়লাম।
অবশেষে উত্তর এল! ক্যালিফোর্নিয়ার একটি মানমন্দিরে কাজ করছিলাম, তখনই আমার সহকারী ড. রিচার্ড কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, উত্তর এসেছে ... আ ... আমাদের বার্তার!’
‘ক ... কোথা থেকে?’ বললাম আমি।
‘যত দূর বুঝতে পারছি, হারকিউলিস তারামণ্ডল থেকে!’
চালু করলাম বার্তাটা।
হিহিহিহিহিহিহি ... বুওওওওওওওওও ...
পৃথিবীর সব মানুষ শুনেছে ওই কণ্ঠ। যারা টিভির সামনে ছিল না, শুনেছে তারাও। আমার স্ত্রী শুনেছিল, শুনেছে আমার বাচ্চা, এমনকি যারা জন্মগতভাবে বধির, তারাও শুনেছিল! সব ভাষার মানুষ বুঝতে পেরেছিল কথাগুলোর অর্থ
অদ্ভুত একটা শব্দ। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলল সেই শব্দ। এটা কি কোনো জীবন্ত প্রাণীর শব্দ?
কিছুক্ষণ পরেই আরেকটি বার্তা এল। আমার যন্ত্র বার্তাটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে।
সে এক ভয়ংকর কণ্ঠ! ঠিক বোঝাতে পারব না ... মনে হচ্ছিল, দুটো বিরাট পাহাড় একসঙ্গে ঘষা খাচ্ছে ... কিংবা সাগরের ভয়ংকর ঢেউ আছড়ে পড়ছে মাটিতে ... সেই কণ্ঠকে ব্যাখ্যা করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
সেই কণ্ঠ বলেছিল, ‘কে ... তোমরা?’
ড. রিচার্ড সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেল। আমারও পুরো শরীর কাঁপছিল।
সেদিন আর কিছু হলো না।
কিন্তু পরদিন সকাল ১০টায় পৃথিবীর সব দেশে, সমস্ত টিভি চ্যানেল এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ঝিরঝিরে পর্দা থেকে শোনা গেল সেই কণ্ঠ, ‘কোথায় ... তোমরা?’
পৃথিবীর সব মানুষ শুনেছে ওই কণ্ঠ। যারা টিভির সামনে ছিল না, শুনেছে তারাও। আমার স্ত্রী শুনেছিল, শুনেছে আমার বাচ্চা, এমনকি যারা জন্মগতভাবে বধির, তারাও শুনেছিল! সব ভাষার মানুষ বুঝতে পেরেছিল কথাগুলোর অর্থ।
সেদিন থেকেই সব বদলে গেল। উন্মাদ হয়ে গেল কিছু মানুষ।
আর বাকিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করল। কারও মতে এ এক স্বর্গীয় বাণী, আবার কেউ কেউ বলছিল ‘শয়তানের কণ্ঠ’।
ওদের সবার ধারণাই ছিল ভুল।
কিন্তু আমি জানি, ব্যাপারটা তা নয়। যার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, সে অন্য গ্রহের কোনো প্রাণী নয়। সে কোনো গ্রহের বাসিন্দা নয়! হতেই পারে...
পৃথিবীর সব মানুষের মাথার মধ্যে যেন বাসা বেঁধে নিয়েছিল ওই কণ্ঠ। কে সে? কেন আমাদের অবস্থান জানতে চায়?
বড় বিজ্ঞানীদের সভা বসল। তাঁরা ভাবছিলেন, হয়তো অন্য গ্রহের প্রাণীরা যোগাযোগ করেছে আমাদের সঙ্গে।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সরল ছিল না। দুদিন পর ড. রিচার্ড মারা গেল।
পৃথিবীতে হুট করেই বেড়ে গেল আত্মহত্যার প্রবণতা। বিজ্ঞানীরা নিয়মিত সভা করছিলেন। তাঁদের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, অন্য গ্রহের প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়ে গেছে। তাদের জীবনধারা আর প্রযুক্তি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে উঠল তর্কের ঝড়।
কিন্তু আমি জানি, ব্যাপারটা তা নয়। যার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, সে অন্য গ্রহের কোনো প্রাণী নয়। সে কোনো গ্রহের বাসিন্দা নয়! হতেই পারে...
এভাবেই কেটে গেল আরও কয়েকটি সপ্তাহ।
বদলে যেতে লাগল পৃথিবীর আবহাওয়া। এই বরফ পড়ছে, তো ১০ মিনিট পরেই প্রচণ্ড রোদ। ঘন ঘন ভূমিকম্প হতে লাগল এখানে-সেখানে।
মানুষ আর প্রাণীরা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগল, অনেক খুঁজেও পুলিশ কোনো সুরাহা করতে পারল না এসবের। কমে যেতে লাগল গাছের সংখ্যা। উন্নত দেশগুলোর সরকারপ্রধানেরা বারবার বক্তৃতা দিয়ে জনগণকে বোঝাতে লাগলেন, কিছুই হয়নি, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আমি জানতাম, কিছুই আর ঠিক হবে না। চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। সারা দিন বাড়িতেই থাকতাম, কোথাও যেতাম না।
কয় দিন পর আমার ছেলেটা নিখোঁজ হলো। উন্মাদ হয়ে গেল আমার স্ত্রী।
তারপর এক রাতে চাঁদের আলোর রং বদলে হয়ে গেল সবুজ।
পরদিন সকালে আকাশ থেকে ভেসে এল সেই কণ্ঠ, ‘তোমাদের কথা শুনতে পাচ্ছি ...’
সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পৃথিবীর অর্থনীতি ভেঙে পড়ল, বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ইন্টারনেট।
একদিন রোববার সকালে সেই কণ্ঠ আবার শুনতে পেলাম আমরা, এবার বলছে, ‘আমি আসছি!’
সেই রাত থেকে শুরু হলো প্রচণ্ড দাঙ্গা-হাঙ্গামা। মানুষ উন্মাদের মতো একে অপরের প্রাণ নিতে লাগল। রক্তের বন্ধন ভুলে গেল সবাই। দয়ামায়া কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
কেন এসব হচ্ছিল? কেউ জানে না! আমার স্ত্রীও মারা গেল এক সকালে।
সেদিন রাতেই আঘাত হানল এক ভয়াবহ সুনামি। সূর্যের আলো কমে আসতে লাগল। যেন সূর্যকে ঢেকে ফেলছিল একটা কিছু। কয়েক দিন পর, দিন আর রাতের কোনো পার্থক্য রইল না। সর্বদাই অন্ধকার।
মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে আবার আমাকে ডেকে পাঠানো হলো। যে বা যাদের কারণে এসব হচ্ছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
ইচ্ছা ছিল না, তারপরও বার্তা পাঠালাম, ‘কে তুমি? কী চাও?’
কোনো উত্তর এল না।
বাড়ি ফিরে এলাম। উদাস চোখে তারাগুলোর দিকে চেয়ে থাকতাম। ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে আকাশের তারাগুলো। ওগুলোকে ঢেকে ফেলছে কিছু একটা ... বিশাল কিছু একটা ...
ওই ভয়ংকর মহাজাগতিক সত্তার সামনে আমরা তুচ্ছ, মানবতা তুচ্ছ ... কিছুই আর করার নেই, অপেক্ষা করা ছাড়া।
বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না।
দুদিন পরই সন্ধ্যার আকাশটা হলো একদম মিশমিশে কালো। কোথাও কোনো তারা নেই। পুরো আকাশে কেমন যেন একটা অদ্ভুত শব্দ। সেই শব্দকে মানুষের ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায় না।
রাত নয়টা বাজে।
তখনই আকাশ থেকে ভেসে এল সেই কণ্ঠ, ‘আমি এসে গেছি।’
অন্ধকার আর অন্ধকার। ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে স্ট্রিটলাইটের আলো। আমার বাড়ির সব আলোও নিভে গেছে। জানি, গোটা পৃথিবীই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎহীন হয়ে যাবে।
আর বাড়িতে থাকার মানে হয় না। রাস্তায় নেমে এলাম। আমার মতো আরও হাজার হাজার মানুষ নেমে এসেছে।
আমাদের ওপরে অন্ধকার এক তারাহীন আকাশ ... এই আকাশ যেন জীবন্ত!
জানি না আমাদের কী হবে। কিন্তু মহাবিশ্বের কিছু রহস্য কখনোই কারও জানা উচিত নয়। বহুকাল আগে আফ্রিকার সেই বুড়ো আমার দাদুকে ঠিকই বলেছিলেন। আমাদের এই পৃথিবীটা অজ্ঞানতার অন্ধকারেই লুকিয়ে ছিল, এখন আলো এসেছে ... অন্ধকারের আলো ... এক মহাজাগতিক সত্তা খুঁজে পেয়েছে আমাদের।
সূর্য আর চাঁদের মৃত্যু ঘটেছে। ওরা আর কখনো ফিরবে না। সব বদলে গেছে।
আশপাশের মানুষ হিংস্র হয়ে উঠেছে। একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওরা। রক্তের হোলি খেলা চলছে রীতিমতো।
নিজের অজান্তেই চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। এই কি তবে সত্য? নাকি কোনো ভয়ানক স্বপ্ন দেখছি? স্বপ্ন দেখার মতো অবস্থায় নেই আসলে আমি। অপার্থিব এক ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে। আমার ছোট্ট একটা ভুলের জন্য সবকিছু শেষ হতে চলেছে।
আকাশের দিকে চাইলাম। ঘন আঁধার আরও খানিকটা বেড়ে গেছে। কিন্তু আমার চোখে সয়ে এসেছে অন্ধকার। সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। পিচঢালা রাস্তা ভিজে গেছে … মানুষের রক্তে। ওরা এখনো মারামারি করছে, নির্মমভাবে হত্যা করছে একে অপরকে।
আমার দিকে এগিয়ে আসছে কয়েকটা লোক। জন, ল্যানি আর মার্ক! আমারই প্রতিবেশী … কেমন যেন উন্মত্ত খুনের নেশা তিনজনের চোখে। ওদের হাতেই হয়তো মৃত্যু ঘটবে আমার।
শেষবারের মতো আকাশের দিকে চাইলাম। আকাশটা নড়ছে … না … ভুল দেখিনি, আসলেই নড়ছে!
আর কোনো দিন ফিরে আসবে না আমার সেই পুরোনো নিস্তব্ধ আকাশ।