আমি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। মানুষ নিয়েই আমার কারবার। মাঝেমধ্যে ভাবি যে মানুষের বিষয়ে আমরা আর কিছু জানতে পারব কি না। আমাদের, মানে রোবটদের চেয়ে তারা কতটা আলাদা, এটা জানার জন্যই তো একটার পর একটা মৃত গ্রহে খোদাইয়ের কাজ চলছে এখনো। তবে একটা বিষয় জেনে বোধ হয় একটু অবাকই হবেন, একসময় একজন মানুষের সঙ্গে থাকতাম আমি। স্কুল-কলেজে যেভাবে সহজ করে বিষয়টা পড়ানো হয়, অতটাও সহজ নয় বিষয়টা।
কিছু নথিপত্র আর রেকর্ডিং আছে অবশ্য। আমার লাইনে যারা কাজ করে, তারাও চেষ্টা করছে আরও নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করার। কিন্তু সত্যি বলতে, খুব একটা যে লাভ হচ্ছে, এমনটা নয়। আমরা জানি, মানে ইতিহাসবিদদের মতে, আমরা জানি যে মানুষের উৎপত্তি পৃথিবী নামের একটা গ্রহে। এটাও জানি যে একটা পর্যায়ে গিয়ে ছায়াপথ থেকে ছায়াপথে শুরু হয় তাদের বিচরণ। আর যেখানেই তাদের পা পড়েছে, পেছনে ছেড়ে গেছে গুচ্ছ গুচ্ছ কলোনি। সেসব কলোনিতে ছিল মানুষ আর রোবটদের সহাবস্থান। এসব গ্রহে যাদের ছেড়ে যাওয়া হতো, তারা আর কখনো পৃথিবীতে ফিরতে পারত না। আহ্, কি সব দিন ছিল সেসব! এখন কি আমরা এতটাই হতোদ্যম হয়ে পড়েছি? মানুষের মনে ছিল তখন বিজ্ঞান আর নতুন নতুন আবিষ্কারের আগুন।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলে যে মানুষের সঙ্গে আমাদের খুব বেশি পার্থক্য নেই। মানে, তাদের কঙ্কাল এবং গঠন অনেকটাই আমাদের মতো। একটাই পার্থক্য। মানুষের কঙ্কাল ক্যালসিয়াম যৌগের তৈরি আর আমাদেরটা টাইটেনিয়ামের। আরও কিছু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পার্থক্য আছে অবশ্য।
আমার সঙ্গে একটা ফিল্ড কিট ছিল। ট্রিপে গেলে ওটা সব সময়ই সঙ্গে রাখি। কালক্ষেপণ না করে কাজে লেগে পড়ি দ্রুত। কাট-অফ সুইচটা অপারেট করতে ঘাড়ের পেছন দিকে ঢুকিয়ে দিই সুইটা, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় তার নড়াচড়া।
আমার সর্বশেষ ফিল্ড ট্রিপটা ছিল ১৩৯বি গ্রহটায়। একটু ভেতরের দিকে ওটার অবস্থান। সেখানেই মানুষটার সঙ্গে দেখা হয় আমার। আমাদের এই সোলার বেল্টে সে-ই ছিল খুব সম্ভবত সর্বশেষ জীবিত মানুষ। লম্বা একটা সময় একা একা থাকার কারণে কীভাবে কথা বলতে হয়, সেটা ভুলে গিয়েছিল বোধ হয়। তবে একবার আমাদের ভাষা শিখে ফেলার পর অবশ্য তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমস্যা হয়নি। ভেবেছিলাম, সঙ্গে করে এখানে নিয়ে আসব। তবে একটা সমস্যা হয়ে যায়।
একদিন হঠাৎ করেই সে বলে যে শরীর নাকি গরম হয়ে গেছে। রিডিং নিয়ে দেখি যে আসলেও তাপমাত্রা গতানুগতিকের চেয়ে একটু বেশি। এটা বুঝতে সমস্যা হয় না যে থার্মোস্ট্যাট সার্কিটটায় কোনো গন্ডগোল হয়েছে। আমার সঙ্গে একটা ফিল্ড কিট ছিল। ট্রিপে গেলে ওটা সব সময়ই সঙ্গে রাখি। কালক্ষেপণ না করে কাজে লেগে পড়ি দ্রুত। কাট-অফ সুইচটা অপারেট করতে ঘাড়ের পেছন দিকে ঢুকিয়ে দিই সুইটা, সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় তার নড়াচড়া। একদম রোবটদের মতোই। কিন্তু ঠিকমতো খোলার পর ভুল ভাঙে আমার। ভেতরটা রোবটদের তুলনায় একদম অন্য রকম। আবার যখন সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিই, তখন সে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও চালু করতে পারিনি। কেমন যেন নরম হতে শুরু করে সবকিছু। দেখতে দেখতে আমার বাড়ি ফেরার সময় চলে আসে। তত দিনে মানুষটার হাড্ডিই কেবল রয়ে যায় আগের মতো। হ্যাঁ, মানুষেরা আমাদের থেকে আসলেই অন্য রকম।
[বিদেশি গল্প অবলম্বনে]
*লেখাটি ২০২২ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত