অনকোলজিস্ট হাসান চৌধুরী অবাক হয়ে রিপোর্টটার দিকে তাকিয়ে আছেন। লোকটার মাথার বাঁ পাশের ছোট্ট একটি ম্যালিগনেন্ট টিউমার থেকে ক্যানসার সেলগুলো ছড়াচ্ছে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না, স্টেজ ফোরে এমনটাই হওয়ার কথা। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ক্যানসার সেলগুলো কী এক অদ্ভুত উপায়ে নিউরন সেলের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে, নিজেরাও বাড়ছে, নিউরনের সংখ্যাও বাড়াচ্ছে, এ যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানো, ক্যানসার সেল নিউরন সেলের কাঁধে হাত রেখে দিব্যি এগিয়ে চলেছে। মেডুলোব্লাস্টোমা টাইপের সাধারণ টিউমারটা এমন অসাধারণ আচরণ করছে কেন?
একজন মানুষের ব্রেনে নিউরন সেলের সংখ্যা কত? ৮৬ বিলিয়ন নিউরন, কিন্তু এ রোগীর মাথায় এই মুহূর্তে নিউরন সেলের সংখ্যা ১৭০ বিলিয়ন, ডাবলের বেশি। মানে কী?
—আপনার কেমন বোধ হচ্ছে?
—বুঝতে পারছি না।
—কোনো ব্যথা?
—না, তবে মাথাটা ভারী ভারী লাগছে।
—আগের সেই প্রচণ্ড ব্যথাটা নেই?
—না।
—আপনার কি চিন্তাভাবনা করতে কোনো সমস্যা হচ্ছে?
—জি না।
তবে না, ৪৮ নম্বর কেবিনের মেডুলোব্লাস্টোমা টিউমারের পেশেন্ট আফজাল সাহেব হঠাৎ করে টের পেলেন শূন্যের আগেও আরও একটি সংখ্যা আছে, সেটা মানুষ কেন জানতে পারছে না—হঠাৎ এটা কেন মনে হলো তার। তিনি স্কুলে অঙ্ক পড়াতেন। এমন কোনো আহামরি অঙ্ক না, সাধারণ পাটিগণিত। নাইন-টেনের অঙ্ক বই তার আপাদমস্তক মুখস্থ। কোন পাতায় কোন অঙ্ক আছে, চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারেন। যেমন বানরের তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্কটা আছে নাইনের পাটিগণিত বইয়ের ১১৮ পৃষ্ঠায়, গনি মিয়ার গরু কেনার গড়ের অঙ্কটা আছে টেনের ৯৬ পৃষ্ঠায়। ২৫ বছর ধরে অঙ্ক করাচ্ছেন, মনে থাকারই কথা। সংখ্যা নিয়ে ভাবনা তার ভেতর থাকতেই পারে, কিন্তু তার কেন আজ হঠাৎ মনে হলো শূন্যের আগেও একটি সংখ্যা আছে।
একজন মানুষের ব্রেনে নিউরন সেলের সংখ্যা কত? ৮৬ বিলিয়ন নিউরন, কিন্তু এ রোগীর মাথায় এই মুহূর্তে নিউরন সেলের সংখ্যা ১৭০ বিলিয়ন, ডাবলের বেশি। মানে কী?
রকেট যখন মহাশূন্যে পাড়ি দেয়, তখন ১০ থেকে গণনা শুরু হয় ৯, ৮, ৭...এই করতে করতে ০-তে গিয়ে থামে। শূন্যের পরে আর কিছু নেই...তার মানে তখন রকেটকে যাত্রা শুরু করতেই হবে। শূন্য থেকে মহাশূন্যে! তার মানে কি শূন্যের আগে একটি মহাশূন্য আছে...আরও একটি সংখ্যা!
অনেক আগে তার মাথায় একটি প্রশ্ন এসেছিল, ‘হোয়াই সামথিং ইনভেন্টেড বিফোর নাথিং?’ অর্থাৎ শূন্যের আগে কেন ১ থেকে ৯ সংখ্যা আবিষ্কার হলো? কিছুদিন এটা নিয়ে ভেবেও ছিলেন; যাদের জ্ঞানী মনে করতেন, সে রকম কয়েকজনকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন, সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারেনি। তবে তখন একটি অদ্ভুত বিষয় জানতে পেরেছিলেন। রকেট যখন মহাশূন্যে পাড়ি দেয়, তখন ১০ থেকে গণনা শুরু হয় ৯, ৮, ৭...এই করতে করতে ০-তে গিয়ে থামে। শূন্যের পরে আর কিছু নেই...তার মানে তখন রকেটকে যাত্রা শুরু করতেই হবে। শূন্য থেকে মহাশূন্যে! তার মানে কি শূন্যের আগে একটি মহাশূন্য আছে...আরও একটি সংখ্যা!
কিন্তু এখন কেন এটা হঠাৎ মনে হলো, শূন্যের আগে একটি সংখ্যা আছে, যেটা মানুষ জানে না। জানার চেষ্টাও করছে না। নাকি জানতে দেওয়া হচ্ছে না!
এ রকম উচ্চ চিন্তা করতে করতে মাথাটা যেন গরম হয়ে ওঠে আলতাফ সাহেবের। তাঁর কেন যেন মনে হচ্ছে একটু চেষ্টা করলেই তিনি সংখ্যাটা জেনে যাবেন। কিন্তু জেনে কী হবে! আর ঠিক তখনই হঠাৎ করে দ্বিতীয় একটি প্রশ্ন এল মাথায়। বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল?...মানে কী? তাঁর মাথায় এসব কী হচ্ছে? এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনা কেন আসছে, হ্যাঁ তরুণ বয়সে বিজ্ঞানের এসব প্রশ্ন নিয়ে প্রচুর মাতামাতি করেছিলেন একটা সময়; কিন্তু এখন কেন এগুলো আসছে মাথায়। তিনি দুই হাতে মাথা চেপে বসে রইলেন বিছানার ধারে।
ভোররাতের দিকে তিনি ঘুমালেন। বেশ ভালোই ঘুমালেন। ঘুম ভাঙল ১১টার দিকে। চোখ খুলে দেখেন ডাক্তার সাহেব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন তার বিছানার পাশে।
—ভালোই তো ঘুমালেন দেখছি।
—জি।
—কোনো সমস্যা বোধ করছেন? আগের সেই তীব্র ব্যথা কি হয়েছিল এর মধ্যে একবারও?
—জি না, তবে...।
—তবে?
—আপনি বলছিলেন না, চিন্তাভাবনায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না।
—হ্যাঁ।
—একটি সমস্যা হচ্ছে...তরুণ বয়সে যেসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতাম, মনে হচ্ছে সেগুলোর উত্তর আমি পেয়ে যাচ্ছি।
—সমস্যা কোথায়, এটা তো ভালো।
—জি...আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, আমি চলে যেতে যাচ্ছি, আমাকে ছেড়ে দিন।
—কী বলছেন! আপনার ট্রিটমেন্ট তো আমরা এখনো শুরুই করিনি।
—সে জন্যই...আমি কেন যেন বেশ বুঝতে পারছি, চিকিত্সা করে লাভ নেই। তা ছাড়া আমি সামান্য স্কুলমাস্টার, চিকিত্সার এত টাকাও আমার নেই। বরং চলেই যাই। বলে ডাক্তারের দিকে তাকালেন।
—সত্যিই চলে যাবেন?
আফজাল সাহেব উত্তর দিলেন না। তাঁর মাথায় তখন নতুন একটি চিন্তা এসেছে। একটি অন্ধকার ঘরে একটি কালো বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিড়ালটাকে খুঁজে বের করতে হবে; কেউ দেখতে পাচ্ছে না বিড়ালটাকে, তিনি দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু বিড়ালটা আসলে ওই ঘরে নেই! এসব চিন্তার মানে কী?
কিন্তু আফজাল সাহেব হঠাৎ টের পেলেন, তিনি সব জেনে গেছেন। বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল তিনি জেনে গেছেন...শূন্যের আগের সংখ্যাটাও পেয়ে গেছেন...সংখ্যাটা লিখতে হবে, এখনই লিখতে হবে, এ সংখ্যার ভেতরই সব আছে; সবাইকে জানিয়ে যেতে চান তিনি
আফজাল সাহেবকে ফিরতে দেখে মেসমালিক আজিজ আকন্দ বেশ অবাক হলেন।
—বাহ বাহ, আইসা পড়ছেন!
—হু, ডাক্তার ছেড়ে দিল।
—খুব ভালো, মেসে থাকেন খানদান, রেস্ট নেন সব ঠিক হয়া যাইব। মাথার বেতাল ব্যথাটা তাইলে আর নাই?
—জি না, নাই।
—খুব ভালো। আপনেরে চা দিতে বলি?
—জি বলেন। আফজাল সাহেব নিজের রুমে ঢুকে তার বহুদিনের ব্যবহৃত চেয়ারটায় বসলেন আর তখনই হঠাৎ তার মনে হলো একসময় তিনি নিয়মিত যোগব্যায়াম করতেন। বড় বড় যোগীর মতো ‘এনলাইটেন্ড’ হওয়ার শখ হয়েছিল তার। ভারতে গিয়ে যোগেশ আচার্য নামের এক নামকরা যোগীর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেছিলেন, তার আশ্রমে ছিলেন ছয় মাস। সেই যোগী একবার বলেছিল, যারা বছরের পর বছর যোগসাধনা করে করে মহাসমাধিতে গিয়ে এনলাইটেন্ড হয় বা হতে পারে, তারা সব জেনে যায়...সৃষ্টিরহস্য জেনে যায়। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে কখনো শেয়ার করে না।
—কেন করে না?
—কারণ, একদিন সব মানুষই এনলাইটেন্ড হবে, জানবেই।
—কীভাবে জানবে?
—মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সব মানুষ এনলাইটেন্ড হয়, সব জেনে যায়...কিন্তু অন্যদের বলে যেতে পারে না। ঈশ্বরের এক আশ্চর্য উপহার। তোমাকে সব বলে দিলাম কিন্তু অন্যদের জানাতে পারবে না...তুমি একা জেনে যাও!
কিন্তু আফজাল সাহেব হঠাৎ টের পেলেন, তিনি সব জেনে গেছেন। বিগ ব্যাংয়ের আগে কী ছিল তিনি জেনে গেছেন...শূন্যের আগের সংখ্যাটাও পেয়ে গেছেন...সংখ্যাটা লিখতে হবে, এখনই লিখতে হবে, এ সংখ্যার ভেতরই সব আছে; সবাইকে জানিয়ে যেতে চান তিনি। তিনি সৃষ্টি রহস্যটা ধরে ফেলেছেন...মাথায় হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণাটা ফিরে এসেছে। তিনি পাগলের মতো কাগজ–কলম খুঁজতে লাগলেন...নতুন সংখ্যাটা এখনই লিখতে হবে তার মাথা থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগেই লিখতে হবে...এখনই...এখনই।
আজিজের মেসে নিচতলায় খাবারের রুম। বেলা দেড়টায় সবাই খেতে আসে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু আফজাল সাহেব এলেন না খেতে। তার খোঁজে গিয়ে জানা গেল, তিনি মারা গেছেন। মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। মেসমালিক আজিজ থানায় ফোন দিলেন। ওসি সাহেব তার পরিচিত। ঘণ্টাখানেক পর ওসি সাহেব এসে দু-একজনকে এটা–সেটা জিজ্ঞেস করে লাশ নিয়ে চলে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে একটি সাদা কাগজ মেসমালিকের হাতে দিয়ে গেলেন।
—স্যার এটা কী?
—লাশের হাতে পাইছি, কী যেন লেখা। ওর আত্মীয়স্বজন এলে দিয়েন, স্মৃতি হিসেবে যদি রাখতে চায়...
—ওনার তো কোনো আত্মীয়স্বজন নাই।
—তাইলে আপনিই রাইখা দেন। ওসি সাহেবের গলায় ঠাট্টার সুর।
সাদা কাগজটার দিকে তাকান মেসমালিক আজিজ আকন্দ। কাগজের ঠিক মাঝখানে একটি চিহ্নের মতো কিছু আঁকা।
মেস প্রায় খালি, এই সময়টায় খালিই থাকে। তা ছাড়া আফজাল সাহেবের এই হঠাৎ মৃত্যুটা সবকিছু যেন কিছু সময়ের জন্য থমকে দিয়েছে। মেসমালিক আজিজ আকন্দ সিগারেট ধরাবেন কি না ভাবছিলেন। আশপাশে কেউ নেই সিগারেট খাওয়ার, এটাই উপযুক্ত সময়, কেউ দেখবে না। যদিও তার মেস ‘ধূমপানমুক্ত এলাকা’। তখনই তার টেবিলের ওপর লম্বা একটি ছায়া পড়ল। তিনি তাকিয়ে দেখেন টেবিলের অন্য পাশে একটি লোক দাঁড়িয়ে ময়লা ছেঁড়াফাঁড়া কাপড় পরা, তবে লোকটার দুই চোখের ওপর আড়াআড়িভাবে আরেকটা চোখ, চোখটা ঝকঝক করছে।
—ভাই কি ক্কিছু বলবেন? কাঁপা গলায় বললেন আজিজ সাহেব।
—ওই কাগজটা।
আজিজ সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মতো আফজাল সাহেবের সাদা কাগজটা বের করে দেন। লোকটা কাগজটা ভাঁজ করে পকেটে ঢোকায়। তারপর প্রায় শোনা যায় না এমন ফিসফিস করে—‘আমাদের ভুবনে স্বাগত...!’
