মহাকাশের অস্কার: চালু হলো প্রথম গ্লোবাল স্পেস অ্যাওয়ার্ড

লন্ডনের বিখ্যাত ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। ডাইনোসরের কঙ্কাল আর হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসের সাক্ষী এই ভবনটি। গত ৫ ডিসেম্বর, শুক্রবার রাতে এই ঐতিহাসিক ভবনটিই সেজেছিল এক ভিন্ন সাজে। হাড়কাঁপানো শীতের রাতে লাল গালিচা বিছানো হয়েছিল সেখানে। কিন্তু সেই গালিচায় হাঁটেননি কোনো হলিউড বা বলিউডের মুভির নায়ক-নায়িকারা।

সেখানে হাঁটছিলেন আমাদের মহাকাশের স্বপ্ন দেখানো মানুষেরা। মহাকাশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগের জগতকে যারা বদলে দিচ্ছেন, তাঁদের জন্যই ছিল এই আয়োজন। প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো গ্লোবাল স্পেস অ্যাওয়ার্ড।

এটাকে মহাকাশবিষয়ক অস্কার বলতে পারেন। ৩৪০ জন বিশেষ অতিথি নিয়ে ৫ ডিসেম্বর ছিল এক এলাহি কারবার। এই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের পেছনে একটা বিষাদমাখা সুরও ছিল। পুরো আয়োজনটি উৎসর্গ করা হয়েছিল প্রয়াত নভোচারী জেমস লাভেলের স্মরণে।

প্রয়াত নভোচারী জেমস লাভেল
ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

অ্যাপোলো ১৩ মিশনের সেই হাড়হিম করা ঘটনা আপনারা জানেন কি? অক্সিজেন ট্যাঙ্কারে বিস্ফোরণের পর যখন সবাই ভেবেছিল সব শেষ, তখন জেমস লাভেলই ঠান্ডা মাথায় বলেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি— ‘হিউস্টন, উই হ্যাভ আ প্রবলেম।’ মৃত্যুকূপ থেকে তিনি তার দলকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনেছিলেন। মহাকাশ ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই নায়ক গত ৭ আগস্ট আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই চালু করা হয়েছে ‘জেমস লাভেল লিগ্যাসি অ্যাওয়ার্ড’। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লাভেলের পরিবারের সদস্যরা। তাঁদের হাতেই তুলে দেওয়া হয় এই উদ্বোধনী সম্মাননা। ভবিষ্যতে যারা লাভেলের মতো সাহসিকতা দেখাবেন, তাদেরই দেওয়া হবে এই পুরস্কার।

আরও পড়ুন
অক্সিজেন ট্যাঙ্কারে বিস্ফোরণের পর যখন সবাই ভেবেছিল সব শেষ, তখন জেমস লাভেলই ঠান্ডা মাথায় বলেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি— ‘হিউস্টন, উই হ্যাভ আ প্রবলেম।’

এখন ভাবতে পারেন, ডাইনোসরের মিউজিয়ামে কেন মহাকাশের পুরস্কার দেওয়া হলো? এর উত্তরটা বেশ চমৎকার। অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটির সদস্য সঞ্জীব গোর্ধন এই বিষয়টার একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই মিউজিয়াম সাক্ষী দেয়, কীভাবে প্রাণীরা বিবর্তিত হয়েছে, কীভাবে কেউ টিকেছে, কেউ হারিয়ে গেছে। যেমন, ডাইনোসর। মানবজাতিও এখন এক নতুন ধাপে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা এখন আর শুধু পৃথিবীবাসী নই, আমরা মহাকাশবাসী হতে চলেছি। মহাকাশের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা শুধু টিকে থাকব না, বরং আরও উন্নত হবো। এই বার্তা দিতেই ভেন্যু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই মিউজিয়ামকে।

ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, লন্ডন
ছবি: লন্ডন টিকেটস

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ এবং সায়েন্স কমিউনিকেটর ব্রায়ান গ্রিন। যার বই বা ডকুমেন্টারি দেখে আমরা অনেকেই ফিজিকসের প্রেমে পড়েছি, সেই মানুষটিই ছিলেন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কাণ্ডারি। তার জাদুকরি উপস্থাপনা এই সন্ধ্যাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল।

প্রথম বছরই এই অ্যাওয়ার্ডের জন্য জমা পড়েছিল ৫০০টিরও বেশি নমিনেশন! সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে ৮টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দেওয়া হয়। বিচারকদের প্যানেলে ছিলেন বিশ্বের বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠানের কর্তারা।

পুরস্কারের ক্যাটাগরিগুলোও ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং। যেমন, প্লে-মেকার অফ দ্য ইয়ার। এই পুরস্কার তার জন্য, যিনি বা যে প্রতিষ্ঠান মহাকাশ শিল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। যারা মহাকাশ গবেষণায় টাকা ঢালছেন তাঁদের জন্য স্পেস ইনভেস্টমেন্ট। মহাকাশকে যারা আবর্জনামুক্ত বা টেকসই রাখার প্রযুক্তি আনছেন, তাঁদের জন্য সাস্টেইনেবিলিটি ইন স্পেস। নতুন কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য সায়েন্টিফিক ব্রেকথ্রু।

আরও পড়ুন
প্লে-মেকার অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার তার জন্য, যিনি বা যে প্রতিষ্ঠান মহাকাশ শিল্পের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। যারা মহাকাশ গবেষণায় টাকা ঢালছেন তাঁদের জন্য স্পেস ইনভেস্টমেন্ট।

এই অনুষ্ঠানের চমক কিন্তু শুরু হয়েছিল এক মাস আগেই। গত ৬ নভেম্বর যখন সেরা ৫০ জন ফাইনালিস্টের নাম ঘোষণা করা হয়, তখন সেটা কোনো সাধারণ প্রেস কনফারেন্সে হয়নি।

আয়োজকরা একটি বিশাল বেলুনে করে একটি ডিজিটাল স্ক্রিন পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্ট্রাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে। অর্থাৎ, ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার ওপরে! মহাকাশের কাছাকাছি সেই উচ্চতায়, পৃথিবীকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ভেসে উঠেছিল ফাইনালিস্টদের নাম। ভাবা যায়?

গ্লোবাল স্পেস অ্যাওয়ার্ড শুধু একটা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান নয়, এটি একটি বার্তা। মহাকাশ এখন আর শুধু সরকারি সংস্থার গবেষণার বিষয় নয়, এটি এখন বিশাল এক শিল্প। এখানে যেমন বিজ্ঞান আছে, তেমনি আছে ব্যবসা। আর সবার ওপরে আছে জেমস লাভেলের মতো বীরদের অনুপ্রেরণা।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, গণিত বিভাগ, পদ্মা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, শরীয়তপুর

সূত্র: স্পেস ডটকম

আরও পড়ুন