মঙ্গল গ্রহে মিলল প্রাচীন জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ, জানাল নাসা

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পারসিভারেন্স রোভার

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পারসিভারেন্স রোভার মঙ্গলে প্রাণের সন্ধানে গবেষণা চালাচ্ছে। এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত বছর রোভারটি ৬ বর্গফুটের একটি দাগযুক্ত শিলার সন্ধান পেয়েছিল। দেখতে তীর আকৃতির এই শিলাটির নাম দেওয়া হয় ‘চেয়াভা ফলস’। এটি এমন একটি স্থানে পাওয়া গেছে, যা একসময় জেজেরো গর্তে প্রবাহিত একটি প্রাচীন নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে তৈরি হয়েছিল। 

বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পাওয়া ব্রাইট অ্যাঞ্জেল নামে পরিচিত একটি পাথরের প্রাথমিক বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পাথরটি জৈব যৌগ দিয়ে পূর্ণ। জৈব যৌগ মানে হলো জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু মৌলিক উপাদান। এছাড়াও, পাথরের ভেতর দিয়ে একসময় পানি প্রবাহিত হয়েছিল, সে প্রমাণও মিলেছে। এর মধ্যে চিতাবাঘের মতো দাগের কিছু চিহ্নও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই দাগগুলো এমন কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার থেকে হয়েছে, যা প্রাচীন অণুজীব থেকে তৈরি। এসব কারণে বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে প্রাচীন জীবনের উপস্থিতি সম্পর্কে খুব আশাবাদী।

বিজ্ঞানীদের মতে, এই খনিজ পদার্থগুলো কাদা ও জৈব পদার্থের মধ্যে বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হতে পারে। এই শিলাগুলোর মধ্যে খনিজগুলো যেভাবে গঠিত, তা এই অনুমানকে আরও দৃঢ় করেছে।

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পাথরের মধ্যে পাওয়া দাগ ও খনিজ পদার্থগুলো লাখ লাখ বছর ধরে ঘটে যাওয়া সাধারণ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারণেও হতে পারে। তাই এর মাধ্যমে পুরোপুরি প্রমাণ করা যায় না যে মঙ্গলে জীবন ছিল। কিন্তু গত ১০ সেপ্টেম্বর নেচার জার্নালে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আরও কিছু তথ্য জানিয়েছেন। তাঁরা কাছাকাছি দুটি ভিন্ন স্থানে আরও শিলার নমুনা পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘এই নতুন প্রমাণগুলো মঙ্গলে অতীত জীবনের সম্ভাবনাকে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী করেছে।’

আরও পড়ুন

এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেছেন, ‘বিজ্ঞানীরা একবছর ধরে গবেষণা ও পর্যালোচনার পর একটি সিদ্ধান্তে এসেছেন। তাঁরা জানিয়েছেন, এই আবিষ্কারের আর কোনো সম্ভাব্য ব্যাখ্যা তাঁরা খুঁজে পাচ্ছেন না। এ কারণে নাসা মনে করছে, এটি মঙ্গল গ্রহে জীবনের সবচেয়ে স্পষ্ট চিহ্ন হতে পারে। 

এসব জিনিস কোনো জীব থেকে নাকি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে, তা নিশ্চিত করে জানতে হলে নমুনাগুলো পৃথিবীর গবেষণাগারে পরীক্ষা করা দরকার
ছবি: নাসা

২০২১ সালে মঙ্গলে পৌঁছানোর পর থেকে নাসার রোভার পারসিভারেন্স প্রায় ৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত জেজেরো গর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই গর্তে একসময় একটি নদী এসে মিশেছিল। তাই এখানে জীবনের চিহ্ন থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য রোভারটি কয়েক ডজন শিলা নমুনা সংগ্রহ করছে। এই মিশনের অংশ হিসেবেই রোভারটি চিতাবাঘের মতো দাগযুক্ত একটি বিশেষ শিলার সন্ধান পায়। পরে রোভারের একটি বিশেষ যন্ত্র দিয়ে এটিকে স্ক্যান করে দেখা যায় যে, এই পাথরের নমুনায় কার্বন-ভিত্তিক অণু, আয়রন ও ফসফেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এসব উপাদান জীবনের জন্য অপরিহার্য।

পাথরের মধ্যে পাওয়া দাগ ও খনিজ পদার্থগুলো লাখ লাখ বছর ধরে ঘটে যাওয়া সাধারণ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারণেও হতে পারে। তাই এর মাধ্যমে পুরোপুরি প্রমাণ করা যায় না যে মঙ্গলে জীবন ছিল।

টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির ভূ-জীববিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল টাইস জানিয়েছেন, ‘পারসিভারেন্স রোভার যখন ব্রাইট অ্যাঞ্জেলে প্রবেশ করে সেখানকার পাথরের গঠন পরীক্ষা করতে শুরু করে, তখন বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে যান। এর কারণ, এই পাথরগুলো তাঁরা আগে যা দেখেছেন, তার থেকে অনেকটাই আলাদা।’

নাসা মঙ্গল গ্রহে আরও কিছু নতুন আবিষ্কারের কথাও জানিয়েছে। এই নমুনাগুলো স্যাফায়ার ক্যানিয়ন ও ম্যাসোনিক টেম্পল নামের দুটি ভিন্ন স্থানে পাওয়া গেছে। এই জায়গাগুলোতে কাদামাটিপূর্ণ কিছু শিলার নমুনা মিলেছে। যার মধ্যে ভিভিয়ানাইট এবং গ্রেগাইট নামের খনিজ পদার্থ রয়েছে।

আরও পড়ুন
বর্তমানে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইসা) ও নাসা ২০৩৩ সালের মধ্যে এই নমুনাগুলো ফিরিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা করেছে। এর জন্য একটি ছোট রকেটবাহী মহাকাশযান ব্যবহার করা হবে।
বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পাওয়া ব্রাইট অ্যাঞ্জেল নামে পরিচিত একটি পাথরের প্রাথমিক বিশ্লেষণ করেছেন
ছবি: নাসা

বিজ্ঞানীদের মতে, এই খনিজ পদার্থগুলো কাদা ও জৈব পদার্থের মধ্যে বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হতে পারে। এই শিলাগুলোর মধ্যে খনিজগুলো যেভাবে গঠিত, তা এই অনুমানকে আরও দৃঢ় করেছে। তাঁরা বলেছেন, এ ধরনের গঠন থেকে বোঝা যায় যে এটি রেডক্স সাইক্লিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। 

এসব জিনিস কোনো জীব থেকে নাকি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছে, তা নিশ্চিত করে জানতে হলে নমুনাগুলো পৃথিবীর গবেষণাগারে পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু পারসিভারেন্স যে নমুনাগুলো সংগ্রহ করেছে, সেগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে কিনা, তা নিয়ে এখনো নানা ধরনের আলোচনা চলছে। বর্তমানে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইসা) ও নাসা ২০৩৩ সালের মধ্যে এই নমুনাগুলো ফিরিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা করেছে। এর জন্য একটি ছোট রকেটবাহী মহাকাশযান ব্যবহার করা হবে। তাই মঙ্গলে সত্যিই কোনো জীবন ছিল কিনা, তা জানতে আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স, সিএনএন

আরও পড়ুন