বুধ গ্রহ কী দিয়ে তৈরি, এর গঠন কেমন
সৌরজগতের সবচেয়ে ছোট গ্রহ বুধ। দেখতে অনেকটা চাঁদের মতো। এবড়োখেবড়ো আর অসংখ্য গর্তে ভরা। পৃথিবীর মতো বুধেরও কেন্দ্র বা কোর আছে। সেই কেন্দ্রকে ঘিরে রয়েছে একটি আবরণ বা ম্যান্টল। আর বাইরের স্তরকে বলে ক্রাস্ট। এখানেই লুকিয়ে আছে এক বিশাল রহস্য।
বুধ গ্রহের মাটিতে পা রাখলে মনে হবে যেন কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পড়েছেন। সব জায়গায় বিশাল বিশাল গর্ত আর পাহাড়। কিন্তু এগুলো কোনো যুদ্ধের চিহ্ন নয়। এগুলো হলো হাজার কোটি বছর আগের স্মৃতি। সৌরজগত যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন চারদিকে উড়ে বেড়াত বিশাল বিশাল পাথরের খণ্ড। এগুলোকে বলা হয় গ্রহাণু। এই গ্রহাণুগুলো প্রতিদিন বুধ গ্রহে আছড়ে পড়ত। আর প্রতিবার তৈরি হতো একটা করে বিশাল গর্ত। এভাবেই বুধ গ্রহের পৃষ্ঠে হাজার হাজার গর্ত তৈরি হয়েছে।এসব গর্তের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো ক্যালোরিস বেসিন। ১ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার চওড়া এই গর্তটা! এটা এত বড় যে পুরো বাংলাদেশ এর ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। এই গর্তের চারপাশে আছে ২ কিলোমিটার উঁচু পাহাড়ের দেয়াল।
বুধ গ্রহে এক সময় আগ্নেয়গিরি ছিল। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ছোট্ট এই গ্রহের মাটির নিচ থেকে একসময় গলিত লাভা বের হতো। এই লাভা গড়িয়ে গড়িয়ে অনেক জায়গা ঢেকে দিয়েছিল। সেজন্য কিছু কিছু জায়গা দেখতে একদম মসৃণ সমতল মাঠের মতো। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বুধ গ্রহে এখনো আগ্নেয়গিরি সক্রিয় থাকতে পারে। তবে কেউ এখনো কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দেখেনি। হয়তো লাখো বছর পর একদিন আবার জেগে উঠবে সেই আগ্নেয়গিরিগুলো।
বুধ গ্রহের আরেকটা অবাক করা বিষয় হলো, এটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন?
বুধ গ্রহে বরফও আছে। এটা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যি। ভাবছেন, কীভাবে সেখানে বরফ থাকা সম্ভব? সূর্যের এতো কাছে থেকেও বরফ গলে যায় না কেন? আসলে বুধ গ্রহের কিছু গর্তে সূর্যের আলো কখনো পৌঁছায় না। এসব জায়গা সবসময় অন্ধকার আর ঠান্ডা থাকে। সেখানেই জমে আছে বরফ। মজার ব্যাপার হলো, এই বরফের ওপর কালো রঙের একটা স্তর আছে। বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝতে পারেননি এই কালো জিনিসটা কী।
বুধ গ্রহের আরেকটা অবাক করা বিষয় হলো, এটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাচ্ছে। কেন? কারণ ভেতরের গলিত লোহা ঠান্ডা হয়ে জমে যাচ্ছে। আর জমে যাওয়ার সময় জায়গা দখল করছে কম। ফলে পুরো গ্রহটাই যেন কুঁচকে যাচ্ছে। এই কুঁচকে যাওয়ার কারণে ভূপৃষ্ঠে তৈরি হয়েছে অনেক ভাঁজ। এগুলোকে দেখতে বুড়ো মানুষের কপালের ভাঁজের মতো লাগে।
বুধ গ্রহের বাতাস অনেক হালকা। এত হালকা যে একে বাতাসই বলা যায় না। সূর্যের প্রচণ্ড সৌরঝড় এই হালকা বাতাসকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাই বুধ গ্রহে দিনের বেলা অসহ্য গরম আর রাতে কনকনে ঠান্ডা। দিনে তাপমাত্রা হয় ৪২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় সীসাও গলে যাবে। আর রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ১৭০ ডিগ্রির নিচে।বুধ গ্রহের ভেতরের গল্পটাই সবচেয়ে মজার। মানে কেন্দ্র বা কোরের কথা বলছি। এর কেন্দ্রে আছে বিশাল এক লোহার গোলা। এই গোলাটা এত বড় যে পুরো গ্রহের ৭০ ভাগই লোহা ও নিকেল দিয়ে তৈরি। অন্য কোনো গ্রহে এত বেশি লোহা নেই। এই লোহার কেন্দ্রটা কিন্তু জমাট বাঁধা নয়। গলিত অবস্থায় আছে। আর এই গলিত লোহা ঘুরতে ঘুরতে তৈরি করে চৌম্বকক্ষেত্র। তবে পৃথিবীর তুলনায় এর চৌম্বকক্ষেত্র খুবই দুর্বল।
বুধ গ্রহে দিনের বেলা অসহ্য গরম আর রাতে কনকনে ঠান্ডা। দিনে তাপমাত্রা হয় ৪২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রায় সীসাও গলে যাবে। আর রাতে তাপমাত্রা নেমে যায় মাইনাস ১৭০ ডিগ্রির নিচে
এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বুধ গ্রহে কেন এত লোহা? বিজ্ঞানীরা দুটি সম্ভাব্য কারণ দিয়েছেন। প্রথম সম্ভাবনা হলো, বুধ গ্রহ তৈরি হওয়ার সময় সূর্যের প্রচণ্ড তাপে বাইরের পাথুরে অংশ বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। শুধু ভেতরের ভারী লোহার অংশই রয়ে গেছে। দ্বিতীয় সম্ভাবনা আরও রোমাঞ্চকর—হয়তো বুধ গ্রহ এখনকার চেয়ে অনেক বড় ছিল। কিন্তু সৌরজগত তৈরি হওয়ার সময়ের বিশৃঙ্খলায় কোনো বিশাল গ্রহাণু এসে ধাক্কা মেরে বাইরের স্তরগুলো উড়িয়ে দিয়েছে। রয়ে গেছে শুধু লোহার কেন্দ্রটুকু।
তবে এই গ্রহের রহস্য এখানেই শেষ নয়। বুধ গ্রহের চৌম্বকক্ষেত্রের একটা বিচিত্র বৈশিষ্ট্য আছে। গ্রহটির উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণ গোলার্ধের চেয়ে তিনগুণ বেশি শক্তিশালী। এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য দেখে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন, বুধ গ্রহের ভেতরটা পৃথিবীর মতো নয়। পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে একটা শক্ত লোহার বল আর তার চারপাশে গলিত লোহা। কিন্তু বুধ গ্রহে উল্টো। সেখানে লোহা জমতে শুরু করে একদম বাইরে থেকে। অনেকটা তুষারপাতের মতো। মানে গ্রহটির লোহা হয়তো বরফের মতো ঝড়ে পরে।
বুধ গ্রহ নিয়ে এখনো অনেক রহস্য অমীমাংসিত। বিজ্ঞানীরা গ্রহটিতে আরও অভিযান পাঠালে একদিন হয়তো এই ছোট্ট গ্রহটির আরও অনেক রহস্য উন্মোচিত হবে।
