আলোর ভর নেই, কিন্তু ব্ল্যাকহোল একে কীভাবে টেনে ধরে
আলো সম্পর্কে যারা একটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন যে পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে, আলোর কোনো ভর নেই। আলোর অপর নাম ফোটন। এ কণার কোনো ভর না থাকার কারণেই তা বিপুল দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে চোখের পলকে। যেমন, মাত্র এক সেকেন্ডে আলো পৃথিবীকে চক্কর দিতে পারে প্রায় সাড়ে সাত বার। প্রায় একই সময়ে পৌঁছে যেতে পারে পৃথিবী থেকে চাঁদে।
এদিকে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণাও আছে, তাঁরা জানেন, এই বস্তুর মহাকর্ষ খুবই প্রবল। তাই মহাকাশের এই গর্ত থেকে কোনোকিছুই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না। এমন কি আলোও আটকা পড়ে সেই প্রবল মহাকর্ষের টানে। তাহলে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক, ভরহীন ফোটনকে ব্ল্যাকহোল নিজের ভেতরে টেনে ধরে কীভাবে? কেন ব্ল্যাকহোল থেকে আলো বেরিয়ে আসতে পারে না?
আসলে মহাকর্ষ নিয়ে কথা বলতে গেলেই সবার আগে মাথায় আসে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের নাম। বিজ্ঞানের ইতিহাসে তিনিই প্রথম এই মৌলিক বলকে গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর সূত্র মতে, মহাবিশ্বের ভরযুক্ত প্রতিটি বস্তুই পরস্পরকে কাছে টানছে। অর্থাৎ মহাকর্ষ হলো দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল। সে হিসেবে, আলোর ভর না থাকার কারণে এর ওপর মহাকর্ষ কাজ করার কথা নয়। তাহলে কৃষ্ণগহ্বরে আলো আটকা পড়ে কীভাবে?
বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের সূত্র মতে, মহাবিশ্বের ভরযুক্ত প্রতিটি বস্তুই পরস্পরকে কাছে টানছে। অর্থাৎ মহাকর্ষ হলো দুটি বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ বল।
এর উত্তর আসলে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রে নেই। উত্তরটা আছে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বা জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে। এর মাধ্যমে মহাকর্ষকে পুরোপুরি নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ তত্ত্বকে বলা হয় নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বের ‘সংশোধনী’ বা আরও ভালোভাবে বললে ‘সম্প্রসারণ’। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিউটনের তত্ত্বকে বাতিল করে দেয়নি, বরং এটি ব্যাখ্যা করেছে কেন মহাকর্ষ সেভাবে কাজ করে।
সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্ব একটা বিশাল চাদরের মতো। এটাই ‘স্থান-কাল’। এই চাদরের ওপর কোনো ভারী বস্তু (যেমন একটি তারা বা গ্রহ) রাখা হলে, বস্তুটির ভরের কারণে চাদরটি সেই জায়গায় টোল খায় বা বেঁকে যায়। একটি বিছানার চাদরের মাঝখানে একটি ভারী বোলিং বল রাখলে চাদরটি দেবে যায়, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম। বস্তু যত বড় ও ভারী হবে, স্থান-কাল তত বেশি বেঁকে যাবে। আলোও স্থান-কালের এই বক্রতায় প্রভাবিত হয়। দূর মহাকাশ থেকে কোনো নক্ষত্রের আলোও আমাদের সূর্যের কাছে এসে বেঁকে যায়। সে কারণে নক্ষত্রটির অবস্থান প্রকৃত অবস্থান থেকে পাল্টে যায় (ছবি ১)।
ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরেও আলো আসলে এভাবেই প্রভাবিত হয়। আলো যখন একটা ব্ল্যাকহোলের পাশ দিয়ে যায়, তখন সেই বাঁকা স্থান-কালের মধ্য দিয়েই সে চলে। কিন্তু আলোর গতি তো বাড়তে পারে না, কারণ আলোর গতি সবসময় একই থাকে। তাহলে কী হয়? আলোর ফ্রিকোয়েন্সি বদলে যায়। ফলে আলোর রং পরিবর্তন হয়ে যায়। এই ঘটনাকে বলা হয় গ্র্যাভিটেশনাল রেড-শিফট বা ব্লু-শিফট।
সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্ব একটা বিশাল চাদরের মতো। এটাই ‘স্থান-কাল’। এই চাদরের ওপর কোনো ভারী বস্তু রাখা হলে, বস্তুটির ভরের কারণে চাদরটি সেই জায়গায় টোল খায় বা বেঁকে যায়।
এবার আসল প্রশ্নে আসি: ব্ল্যাকহোল কীভাবে আলোকে ধরে রাখে?
ব্ল্যাকহোল হলো এমন একটি বস্তু যার ভর এতই বেশি, কিন্তু তা অবিশ্বাস্যরকম ক্ষুদ্র একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এই বিন্দুকে বলে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু। এর ফলে এটি তার চারপাশের স্থান-কালকে সাধারণ তারা বা গ্রহের চেয়ে বহুগুণ বেশি—বলা যায় অসীম পরিমাণে—বাঁকিয়ে ফেলে।
ব্ল্যাকহোলের একটা বিশেষ সীমা আছে, যাকে বলে ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। এই সীমার ভেতরে একবার ঢুকে গেলে আর কিছুই বাইরে আসতে পারে না। ব্ল্যাকহোল যত বড় হয়, তার চারপাশের স্থান-কাল তত বেশি বাঁকা হয়। ইভেন্ট হরাইজনের যত কাছাকাছি যাওয়া যায়, স্থান-কালের বক্র বা বাঁকও তত বেশি হয়। আলো এই বাঁকা পথে চলতে বাধ্য হয়। একসময় আলো এত বেশি বেঁকে যায় যে সে আর সোজা বাইরে বেরোতে পারে না। তখন আলোর একমাত্র সম্ভাব্য পথ হলো ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
ব্ল্যাকহোল হলো এমন একটি বস্তু যার ভর এতই বেশি, কিন্তু তা অবিশ্বাস্যরকম ক্ষুদ্র একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এই বিন্দুকে বলে সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু।
এখানে ব্ল্যাকহোলের প্রবল মহাকর্ষ আসলে সরাসরি আলোকে টানে না। বরং ব্ল্যাকহোল তার চারপাশের স্থান-কালকে এতই বেশি বাঁকিয়ে দেয় যে আলো সেই বাঁকা পথ ধরেই চলে। আলো সবসময় দুই বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে ছোট পথে চলে, এটাই তার স্বভাব। কিন্তু ব্ল্যাকহোলের কাছে স্থান-কাল এতই বাঁকা যে সেই ‘সবচেয়ে ছোট পথ’টাই আমাদের কাছে বাঁকা মনে হয়। ইভেন্ট হরাইজনে স্থান-কাল নিজের মধ্যেই বাঁকিয়ে যায়। ফলে আলো আর বাইরে বেরোনোর কোনো পথই খুঁজে পায় না।
সহজ কথায়, ব্ল্যাকহোল আলোকে টানে না, বরং আলো যে রাস্তা দিয়ে যায় সেই রাস্তাটাই এমনভাবে বাঁকিয়ে দেয় যে আলো আর ফিরে আসতে পারে না।
