ঝকঝকে রাতের আকাশ। অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। কখনো ভেবে দেখেছেন, এই নক্ষত্রগুলো কতদিন ধরে আমাদের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে? ওদের আলো হয়তো শতাব্দী প্রাচীন কোনো বার্তা বহন করে আনছে পৃথিবীর জন্য! নক্ষত্রদের মুখ থেকে সেই গল্পই শোনা যাক।
কোটি কোটি বছর আগের কথা। মহাকাশের এক কোণে জমাট বাঁধা গ্যাস আর ধুলোর মেঘ ঘুরপাক খাচ্ছিল। ধীরে ধীরে সেই মেঘ সংকুচিত হয়ে গরম হতে থাকল। হাতে একটা ফোমের বল চেপে ধরলে যেমন সংকুচিত হয়, অনেকটা সে রকম! একদিন হঠাৎ করেই সেই গ্যাসের বল ফেটে গেল, আর জন্ম নিল একটি নতুন নক্ষত্র। তারপর থেকে সে নিরন্তর জ্বলছে, আলো ছড়াচ্ছে মহাবিশ্বের অন্ধকারে। সেই আলো কত লাখো-কোটি গ্রহ-উপগ্রহকে পথ দেখাচ্ছে! নক্ষত্রেরা কথা বলতে পারে না ঠিকই, কিন্তু নক্ষত্রের আলো বিজ্ঞানীদের জন্য একধরনের কোডেড বার্তা দেয়। কোনো নক্ষত্র নীলাভ মানে ওটা অত্যন্ত গরম! লালচে হলে ওটা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। টেলিস্কোপ দিয়ে যখন বিজ্ঞানীরা এই আলো বিশ্লেষণ করেন, তখন বুঝতে পারেন নক্ষত্রটি কী দিয়ে তৈরি, বয়স কত। এমনকি ওই নক্ষত্রের চারপাশে কোনো গ্রহ আছে কি না, সেসব গ্রহে প্রাণের সন্ধান মিলতে পারে কি না, তাও বুঝতে পারেন!
আমাদের গ্রহের সব স্বর্ণ বা রৌপ্য এসেছে প্রাচীন সুপারনোভা থেকে। সৌরজগৎ তৈরির আগে বিস্ফোরিত হয়েছিল সেই সুপারনোভা। এ ছাড়াও নিউট্রন স্টার আসতে পারে সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ থেকে।
কিন্তু সব নক্ষত্রই কি চিরকাল জ্বলে? না, আমার-আপনার মতো নক্ষত্রদেরও মৃত্যু আছে। এই মৃত্যুর নানা উপায় আছে। কোনোটি মৃত্যুর পরে রূপান্তরিত হয় কৃষ্ণগহ্বরে, কোনোটি আবার পরিণত হয় শ্বেতবামন কিংবা নিউট্রন তারায়। কিছু বিশেষ নক্ষত্রের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে সেগুলো এক অবিশ্বাস্য বিস্ফোরণে নিজেকে উড়িয়ে দেয়। একে বলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ! এই বিস্ফোরণ এত শক্তিশালী যে তা মুহূর্তে গ্যালাক্সিকে আলোকিত করে তোলে। মজার ব্যাপার হলো, এই বিস্ফোরণেই তৈরি হয় স্বর্ণ বা রৌপ্য! রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও এটা মহাবিশ্বের সবচেয়ে বাস্তব ও বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর একটি। কিন্তু কীভাবে নক্ষত্রের বিস্ফোরণে স্বর্ণ বা রৌপ্য তৈরি হয়?
আসলে আমরা এবং নক্ষত্র কিন্তু একই জিনিস দিয়ে তৈরি! হ্যাঁ, সেই বিগ ব্যাংয়ের সময় তৈরি হওয়া হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম পরমাণু দিয়েই আপনি, আমি আর নক্ষত্রেরা গঠিত। মানে আমরা সবাই মহাবিশ্বের এক বিশাল পরিবারের সদস্য। তাই এরপর রাতের আকাশে তাকালে ভাবতে পারেন, আপনি শুধু কিছু নক্ষত্র দেখছেন না, দূরদূরান্তের ভাই-বোনদেরও দেখছেন!
সব নক্ষত্রের জীবন শুরু হয় বিশাল হাইড্রোজেন গ্যাসের মেঘ থেকে। এদের অভ্যন্তরে চরম তাপ ও চাপে (প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস!) হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। এটাই নিউক্লিয়ার ফিউশন। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল শক্তি নির্গত হয়, যা নক্ষত্রকে জ্বলতে সাহায্য করে। কয়েক কোটি বছর পর হাইড্রোজেন ফুরিয়ে গেলে নক্ষত্রে হিলিয়ামের ফিউশন ঘটে কার্বন ও অক্সিজেন তৈরি হয়। সূর্যের চেয়ে বড় নক্ষত্রগুলো (অন্তত ৮ গুণ বড়) লোহা পর্যন্ত তৈরি করতে পারে! কিন্তু এখানেই সমস্যা। লোহার ফিউশন ঘটালেই শক্তি ফুরিয়ে যায়। নক্ষত্রের জ্বালানি শেষ হওয়ার শুরু এখান থেকেই। লোহা তৈরি হওয়ার পর নক্ষত্রের মৃত্যু ঘণ্টা বাজে। নক্ষত্রের কেন্দ্র নিজের ওজনে ভেঙে পড়ে এবং সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণের তাপ ও শক্তি এত তীব্র যে লোহার চেয়ে ভারী মৌল—স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়াম তৈরি হয়। নিউট্রন ক্যাপচার প্রক্রিয়ায় বিস্ফোরণের সময় মুক্ত নিউট্রনগুলো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ধরা পড়ে ভারী মৌল গঠন করে এবং সব ধাতু মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সেগুলো নতুন গ্রহ-নক্ষত্রের উপাদান হিসেবে মিশে যায়।
২০১৭ সালে লাইগো অবজারভেটরি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করে। তারা দেখতে পায়, দুটি নিউট্রন তারা (একটি মৃত নক্ষত্রের অতি ঘন কেন্দ্র) পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে এবং এই সংঘর্ষে প্রচুর স্বর্ণ তৈরি হচ্ছে। আনুমানিক ১০ গুণ পৃথিবীর ভরের সমান স্বর্ণ তৈরি হতে পারে একবার সংঘর্ষে! তাহলে পৃথিবীর স্বর্ণ কোথা থেকে এল?
আসলে আমরা এবং নক্ষত্র কিন্তু একই জিনিস দিয়ে তৈরি! হ্যাঁ, সেই বিগ ব্যাংয়ের সময় তৈরি হওয়া হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম পরমাণু দিয়েই আপনি, আমি আর নক্ষত্রেরা গঠিত। মানে আমরা সবাই মহাবিশ্বের এক বিশাল পরিবারের সদস্য।
আমাদের গ্রহের সব স্বর্ণ বা রৌপ্য এসেছে প্রাচীন সুপারনোভা থেকে। সৌরজগৎ তৈরির আগে বিস্ফোরিত হয়েছিল সেই সুপারনোভা। এ ছাড়াও নিউট্রন স্টার আসতে পারে সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ থেকে। এগুলো গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীতে পৌঁছেছিল। পরে মানুষের হাতে এসেছে গহনা বা মুদ্রা হয়ে!
আপনার হাতে যে স্বর্ণের আংটি রয়েছে, ওটার পরমাণুগুলো সম্ভবত ৪৬০ কোটি বছর আগে কোনো সুপারনোভা বা নিউট্রন তারার সংঘর্ষের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল! ওটা আসলে কোনো মৃত নক্ষত্রের শেষ উপহার। অর্থাৎ, আপনি হয়তো মহাবিশ্বের এক বিরল ইতিহাস ধারণ করে আছেন নিজের অঙ্গে!