দুটি ব্ল্যাকহোলকে একে অপরের চারপাশে প্রথমবার ঘুরতে দেখা গেল
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রথমবার এমন দুটি ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলেছেন, যেগুলো একে অপরের চারপাশে ঘুরছে। কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা যে ভবিষ্যদ্বাণী করে এসেছিলেন, তা এবার দেখা গেল চোখের সামনে। মহাবিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে এই আবিষ্কার একটি মাইলফলক।
সদ্য প্রকাশিত এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে দুটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল এক মহাজাগতিক নৃত্যে আবদ্ধ হয়ে হয়েছে। এদের অবস্থান ওজে২৮৭ নামে একটি উজ্জ্বল কোয়াসারের ভেতরে। এটি ক্যান্সার নক্ষত্রমণ্ডলে প্রায় ৫০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের চারপাশের গ্যাস ও ধূলিকণা প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে উজ্জ্বলভাবে জ্বলে। এই জ্বলন্ত অঞ্চলকেই বলে কোয়াসার।
গবেষকেরা বলছেন, এই নতুন ছবিই ‘বাইনারি ব্ল্যাকহোল’ বা জোড়া ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্বের সবচেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ। ফিনল্যান্ডের তুর্কু বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও এই গবেষণার প্রধান লেখক মাউরি ভালটোনেন জানিয়েছেন, কোয়াসার ‘ওজে ২৮৭’ এতই উজ্জ্বল যে শখের জ্যোতির্বিদেরাও এটি দেখতে পান।
কোয়াসাররা মহাবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তুগুলোর মধ্যে একটি। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর আগে একক ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলেছেন। যেমন আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের ব্ল্যাকহোল এবং মেসিয়ার ৮৭ গ্যালাক্সির ব্ল্যাকহোল। কিন্তু দুটি ব্ল্যাকহোল একে অপরকে প্রদক্ষিণ করছে, এমন ছবি এই প্রথম তোলা হলো।
১৯৮২ সালে ‘ওজে ২৮৭’ বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে। ফিনল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আইমো সিলানপা খেয়াল করেন, এর উজ্জ্বলতা নিয়মিত ১২ বছরের চক্রে বাড়ে ও কমে।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা পরোক্ষভাবে জোড়া ব্ল্যাকহোলের প্রমাণ পেয়েছিলেন। কিন্তু ‘ওজে ২৮৭’-এর দুটি ব্ল্যাকহোলকে কখনো সরাসরি আলাদাভাবে দেখা যায়নি। কারণ, টেলিস্কোপগুলোতে এত উচ্চ রেজ্যুলেশন ছিল না যে আলোর বিন্দু থেকে সেগুলো আলাদা করা সম্ভব হবে।
কোয়াসার ‘ওজে ২৮৭’ নিয়ে পর্যবেক্ষণ চলছে একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ১৮০০ সালের শেষের দিকে আকাশের একই অংশের যেসব ছবি তোলা হয়েছিল, সেখানে ঘটনাক্রমে এই কোয়াসারটিও ধরা পড়েছিল। তখন ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যেত না, কোয়াসারের কথা তো দূরের বিষয়।
১৯৮২ সালে ‘ওজে ২৮৭’ বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে। ফিনল্যান্ডের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আইমো সিলানপা খেয়াল করেন, এর উজ্জ্বলতা নিয়মিত ১২ বছরের চক্রে বাড়ে ও কমে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে এর ভেতরে হয়তো দুটি ব্ল্যাকহোল একে অপরকে প্রদক্ষিণ করছে। এরপর থেকে শত শত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই তত্ত্ব যাচাই করার জন্য ‘ওজে ২৮৭’ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এবার রেডিও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেই প্রমাণ পাওয়া গেল। ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার ‘রেডিওঅ্যাস্ট্রন’ স্যাটেলাইটের সঙ্গে পৃথিবীর টেলিস্কোপগুলোকে যুক্ত করা হয়। ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সাধারণ ছবির চেয়ে প্রায় এক লাখ গুণ ভালো ছবি ধারণ করতে সক্ষম হন।
ভালটোনেন জানান, ‘ব্ল্যাকহোলগুলো নিজেরা কালো হওয়ায় এদের সরাসরি দেখা যায় না। তবে এদের চারপাশ থেকে ছিটকে আসা কণার জেট বা উজ্জ্বল গ্যাস দেখে এদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।’
গবেষকরা যখন নতুন ছবির সঙ্গে আগের তাত্ত্বিক হিসাবগুলো মিলিয়ে দেখলেন, তখন দেখা গেল দুটি ব্ল্যাকহোল ছবিতে ঠিক সেখানেই রয়েছে, যেখানে তাদের থাকার কথা ছিল।
ভালটোনেন জানান, ‘ব্ল্যাকহোলগুলো নিজেরা কালো হওয়ায় এদের সরাসরি দেখা যায় না। তবে এদের চারপাশ থেকে ছিটকে আসা কণার জেট বা উজ্জ্বল গ্যাস দেখে এদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।’
ছবিগুলো আরেকটি মজার জিনিস প্রকাশ করেছে। দুটি ব্ল্যাকহোলের মধ্যে ছোটটি থেকে যে জেট বেরিয়ে আসছে সেটি দেখতে অনেকটা ঘূর্ণায়মান বাগানের পানির পাইপের জেটের মতো পেঁচানো। কারণ, ছোট ব্ল্যাকহোলটি বড়টির চারপাশে দ্রুত গতিতে ঘুরছে। গবেষকরা বলছেন, ছোট ব্ল্যাকহোলটি যখন তার ১২ বছরের কক্ষপথে চলতে থাকবে, তখন এই জেটটিকে একটি লেজের মতো দুলতে দেখা যাবে। এর মাধ্যমে আমরা বাস্তব সময়ে ওগুলোর গতিবিধি দেখতে পারব।
এই গবেষণাটি গত ৯ অক্টোবর দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।