গত এক যুগে মিল্কিওয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের খোলনলচে বদলে দিয়েছে একটি টেলিস্কোপ, একা। এই টেলিস্কোপটির নাম গায়া টেলিস্কোপ। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসা ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর এই টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করে। টেলিস্কোপটি এতদিন ‘এল২ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট’ নামের কক্ষপথে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই টেলিস্কোপের তথ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে ১৩ হাজারের বেশি গবেষণাপত্র। মিল্কিওয়ের ভরের বর্তমান সঠিক মান, এর ভেতরে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্ত বস্তুর পরিমাণ, এর ত্রিমাত্রিক মানচিত্রসহ আরও অনেক কিছু জানা গেছে এই টেলিস্কোপের তথ্য থেকে।
অথচ হতে পারে এই টেলিস্কোপের নামই আপনি শোনেননি! না শোনাটা আশ্চর্যজনক কিছুও নয়। প্রশ্ন হলো, কেন? উত্তরটা বুঝতে আরও দুটি টেলিস্কোপের উদাহরণ দেওয়া যাক। হাবল টেলিস্কোপের নাম বিজ্ঞানে আগ্রহী সবারই পরিচিত হওয়ার কথা। সেই ১৯৯০ থেকে কাজ করে চলেছে এই নভোদুরবিন, তুলেছে দারুণ সব ছবি। হালের জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ হাবলের সুযোগ্য উত্তরসূরী। ইতিমধ্যেই এর তোলা কিছু ছবি মাত করে দিয়েছে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়া। সাধারণ মানুষ থেকে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত সবার মুখে মুখে ঘুরে ফিরেছে জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের নাম। অথচ গায়ার নামটি কখনোই জনপ্রিয় ধারার আলোচনায় সেভাবে উঠে আসেনি। কেন?
কোনো মহাজাগতিক বস্তু আমাদের দিকে ছুটে আসতে থাকলে তার আলোটা খানিকটা নীলচে দেখায়। এটাকে বলে আলোর নীল সরণ। আর কোনো মহাজাগতিক বস্তু আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে তার আলো খানিকটা লালচে দেখায়।
এ ক্ষেত্রে মূল দুটি কারণের কথা বলা যায়। এক নম্বরে বলতে হবে রাজনৈতিক কারণ। হাবল টেলিস্কোপ বা জেমস ওয়েবের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল নাসার। দুটিই যুগ্ম প্রকল্প, কিন্তু নাসা অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সংশ্লিষ্ট ন্যারেটিভ বা মত প্রতিষ্টার যে চেষ্টা, তা এই দুটি টেলিস্কোপের জনপ্রিয়তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। সে তুলনায় ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার চেষ্টা উল্লেখযোগ্য নয়।
জেমস ওয়েবের প্রথম ছবিটির কথাই ধরুন। ছবিটি জনসমক্ষে উন্মুক্ত করেছেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেটা ২০২২ সালের জুলাইয়ের কথা। একটা টেলিস্কোপের ছবি একজন প্রেসিডেন্ট কেন উন্মুক্ত করবেন? উত্তরটা বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন বোধ করছি না। বুদ্ধিমান পাঠকের বিষয়টি না বোঝার কোনো কারণ নেই।
দ্বিতীয় কারণটি খাঁটি বৈজ্ঞানিক। হাবল এবং জেমস ওয়েব—দুটিই জেনারেল-পারপাস অবজারভেটরি। এগুলোর মূল কাজ মহাকাশের গভীরে অনুসন্ধান করা এবং বহু দূরের গ্যালাক্সি ও নক্ষত্রের ছবি তোলার চেষ্টা করা। অন্যদিকে গায়া টেলিস্কোপের মূল কাজই ছিল মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলোর অবস্থান, গতিবেগ এবং ঘূর্ণন ও দূরত্ব নিখুঁতভাবে রেকর্ড করা। বিজ্ঞানের ভারিক্কি ভাষায় যাকে বলে ‘স্পেশালাইজড অ্যাস্ট্রোমেট্রি’। অর্থাৎ একদম সহজ করে বলা যায়, হাবল বা জেমস ওয়েব হলো ইমেজিং টেলিস্কোপ বা ফটোগ্রাফার—যার মূল কাজই ছবি তোলা। আর গায়া হলো মিজারমেন্ট টেলিস্কোপ—যার মূল কাজ নিখুঁতভাবে (নক্ষত্রের বিভিন্ন তথ্য) পরিমাপ করা।
হাবল টেলিস্কোপ বা জেমস ওয়েবের পেছনে বড় ভূমিকা ছিল নাসার। দুটিই যুগ্ম প্রকল্প, কিন্তু নাসা অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আধিপত্য এবং সংশ্লিষ্ট ন্যারেটিভ বা মত প্রতিষ্টার যে চেষ্টা, তা এই দুটি টেলিস্কোপের জনপ্রিয়তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
এই বিষয়গুলো খুব সহজেই বোঝা যায় টেলিস্কোপগুলোর গঠন এবং যন্ত্রপাতি দেখলে। হাবল টেলিস্কোপের কথাই বলি। এর ক্যামেরাগুলো দৃশ্যমান, অতিবেগুনি এবং অবলোহিত—অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের আলোয় ছবি তুলতে পারে। সে জন্যই ‘পিলারস অব ক্রিয়েশন’-এর মতো বিখ্যাত ছবি তুলেছে এই নভোদুরবিন। ওদিকে গায়ায় বিভিন্ন আলোয় ‘ছবি তোলা’র মতো ক্যামেরাই নেই। এটি আলোর পরিমাণ ও বর্ণালি বিশ্লেষণ করে নক্ষত্রের গতিবেগ, অবস্থান, দূরত্ব ইত্যাদি মাপার চেষ্টা করে। কীভাবে করে, সেটা আরেকটা বড় আলোচনা। একদম সংক্ষেপে, সহজ করে বললে—কোনো মহাজাগতিক বস্তু আমাদের দিকে ছুটে আসতে থাকলে তার আলোটা খানিকটা নীলচে দেখায়। এটাকে বলে আলোর নীল সরণ। আর কোনো মহাজাগতিক বস্তু আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকলে তার আলো খানিকটা লালচে দেখায়। এটাকে লোহিত বা লাল সরণ বলে। আর আলোর এই লালচে বা নীলচে দেখানোর বিষয়টিকে বলে ডপলার ক্রিয়া বা ডপলার প্রভাব (ডপলার এফেক্ট)। এই বিষয়টি সম্ভবত অনেকেই জানেন। গায়া নভোদুরবিনে ১০৬টি সিসিডি সেন্সর দিয়ে তৈরি ছোট আয়না আছে, এর কাজই হলো আলোর এ ধরনের পরিবর্তন রেকর্ড করা। এ কাজে সহায়তার জন্য এতে দুটি ফটোমিটারও আছে, যার একটি ব্লু ফটোমিটার (নীল আলো পরিমাপক যন্ত্র, ৩৩০–৬৮০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করে), আরেকটি রেড বা লাল ফটোমিটার (৬৪০–১,০৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করে)। এভাবে এটি নক্ষত্রের অবস্থান ও উজ্জ্বলতা রেকর্ড করে। কিন্তু এটি সেই নক্ষত্রের কোনো ছবি তোলে না। (এটা অবশ্যই অতিসরলীকরণ। তবে এ লেখার মূল বক্তব্য বুঝতে এটুকু জানলেই চলে।)
এর ফলেই গায়ার সংগৃহীত তথ্য থেকে অত নিখুঁতভাবে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু ‘গায়ার তোলা বিস্ময়কর ছবি’ লিখে গুগলে সার্চ করলে দুর্দান্ত কোনো ছবি আপনি পাবেন না। এ কারণে গায়া মিল্কিওয়ে গবেষক ও মহাকাশবিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বটে, তবে সবার দেখার মতো মুগ্ধকর ছবি যেহেতু এটি তোলেনি, জনপ্রিয় ধরনের লেখা বা ফটোফিচার থেকে এটি আড়ালেই রয়ে গেছে।
