মিল্কিওয়ে দেখতে কেমন

রাতের আকাশে যে আবছা আলোর একটা পথ দেখা যায়, সেটাই আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। কিন্তু এটুকু দেখে আমাদের গ্যালাক্সির প্রকৃত রূপ বোঝা কঠিন। যদিও আধুনিক টেলিস্কোপের কল্যাণে মিল্কিওয়ের কিছুর আশ্চর্য ছবি আমরা পেয়েছি। কিন্তু তবুও এই গ্যালাক্সি সম্পর্কে এখনো আমরা সবটা জানি না। মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমরা এখন পর্যন্ত যতটা জেনেছি, তা অনেক বছরের অনুসন্ধান, পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর জটিল হিসাব-নিকাশের ফল।

খালি চোখে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দেখতে একটা আলোর রেখার মতো। হাজার বছর ধরে দার্শনিক আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এর আসল প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলি প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির আসল প্রকৃতি বুঝতে পেরেছিলেন। মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য নক্ষত্র দিয়ে গঠিত, তা তিনি বুঝেছিলেন। খালি চোখে এটা বোঝা সম্ভব ছিল না।

এরপর ১৭০০ সালের মাঝামাঝি দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট অনুমান করেন, মিল্কিওয়ে হলো নক্ষত্রের একটা বিশাল ঘূর্ণায়মান চাকতি। আর আমরা যেহেতু সেই চাকতির ভেতরেই আছি, তাই ওটাকে আলোর ফিতার মতো দেখি। সহজভাষায় বললে, পৃথিবী যে গোলাকার তা আমরা জানি। কিন্তু পৃথিবীকে দেখে গোলাকার মনে হয় না, কারণ আমরা পৃথিবীর ওপরেই বাস করি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। ব্যাপারটা আরও ভালোভাবে বুঝতে উইলিয়াম হার্শেল মহাবিশ্বের একটা মানচিত্র বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সে কাজে সফল হননি। 

আবার নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি আর মহাকর্ষের সূত্র কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন, মিল্কিওয়ের কেন্দ্রটা শুধু গোল নয়, একটু লম্বাটে। এমনকি চিনাবাদামের মতো লম্বাটেও হতে পারে।

আমাদের গ্যালাক্সির আসল চেহারাটা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করি বিশ শতকের শুরুতে, জ্যোতির্বিদ এডুইন হাবলের হাত ধরে। ১৯২০-এর দশকে হাবল আবিষ্কার করলেন, অ্যান্ড্রোমিডা নেবুলা নামে আমরা যে বস্তুটিকে চিনি, ওটা আসলে একটা গ্যালাক্সি। ফলে বোঝা গেল, মিল্কিওয়ে শুধু আশপাশের কিছু নক্ষত্র নিয়ে তৈরি কোনো ডিস্ক বা চাকতি নয়, বরং একটা সম্পূর্ণ গ্যালাক্সি।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির পাশে ম্যাজেলানের বড় ও ছোট মেঘ
ছবি: নিনা ম্যাককার্ডি/ নিক রাইজিংগার/ নাসা

তবে আমরা যেহেতু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ভেতরে আছি, তাই বাইরে থেকে যেভাবে গ্যালাক্সিটিকে দেখা যায়, আমরা সেভাবে দেখতে পারি না। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্যালাক্সিটিকে পুরোপুরি দেখা সম্ভবও নয়। এজন্য বিজ্ঞানীরা অন্য গ্যালাক্সির গঠন দেখে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে এবং নানা রকম মডেল বানিয়ে মিল্কিওয়ের ম্যাপ তৈরি করেন।

বেশিরভাগ ডিস্ক-আকৃতির গ্যালাক্সির মাঝখানে ঘন একটি বলয় থাকে। আর সেই ঘন বলয় থেকে দুই দিকে ছড়িয়ে থাকে দুটি সর্পিলাকার বাহু। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরও তেমন বাহু আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন

তবে সমস্যা একটাই, এর বিশালতা। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের দূরত্ব প্রায় এক লাখ আলোকবর্ষ। এর ভেতরে আছে শত শত কোটি নক্ষত্র, অগণিত গ্রহ, ব্ল্যাকহোল, নিউট্রন স্টার, ধুলাবালি আর নক্ষত্র তৈরির অঞ্চল। এত বিশাল জায়গার মানচিত্র বানানো সহজ কথা নয়।

তার ওপর মহাকাশে আছে প্রচুর ধুলা। এই ধুলার কারণে আলো ম্লান হয়ে যায়। ফলে আমরা মহাকাশের অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পারি না। কারণ, ধুলা আমাদের দৃষ্টি আটকে দেয়। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপও মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির একপাশ থেকে অন্য পাশ সম্পূর্ণ দেখতে পায় না। তাই বিজ্ঞানীরা নানা কৌশল খাটিয়ে পরোক্ষভাবে তথ্য জোগাড় করে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ম্যাপ তৈরি করেছেন।

দেখতে যতই নাটকীয় লাগুক না কেন, এই বাহুগুলো এর চারপাশের অঞ্চলের চেয়ে মাত্র ১০ ভাগ বেশি ঘন। তবুও এ বাহুগুলোকে বেশি আকর্ষণীয় লাগে, কারণ ওখানে নতুন নক্ষত্র তৈরি হয়।

আবার নক্ষত্রগুলোর গতিবিধি আর মহাকর্ষের সূত্র কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা বুঝেছেন, মিল্কিওয়ের কেন্দ্রটা শুধু গোল নয়, একটু লম্বাটে। এমনকি চিনাবাদামের মতো লম্বাটেও হতে পারে। 

২০১৩ সালে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল গায়া টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপের মূল কাজ ছিল, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির যত বেশি সম্ভব নক্ষত্রের অবস্থান, গতি, উজ্জ্বলতা আর রং পরিমাপ করা। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি নক্ষত্রের ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে যত নক্ষত্র আছে, ২০০ কোটি নক্ষত্র তার এক শতাংশেরও কম!

আরও পড়ুন
পৃথিবী থেকে নক্ষত্র বিস্ফোরণের ছবি দেখা যাবে
ফাইল ছবি: ফ্রিপিক

তবু এই তথ্য ভান্ডার থেকেই আমাদের আশপাশের মহাকাশের ম্যাপ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। অন্যান্য জরিপের সঙ্গে তুলনা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে এই ডেটা। সর্পিলাকার বাহুগুলোর কথাই ধরুন। দেখতে যতই নাটকীয় লাগুক না কেন, এই বাহুগুলো এর চারপাশের অঞ্চলের চেয়ে মাত্র ১০ ভাগ বেশি ঘন। তবুও এ বাহুগুলোকে বেশি আকর্ষণীয় লাগে, কারণ ওখানে নতুন নক্ষত্র তৈরি হয়। নতুন নক্ষত্রের কারণেই ওই অঞ্চলে বেশি উজ্জ্বল। আমাদের আশপাশে খুব বেশি নক্ষত্রের জন্ম না হওয়ায় আশপাশটা নিস্তরঙ্গ লাগে। আর দূরের যেসব অঞ্চলে নক্ষত্রের জন্ম বেশি হয়, সেগুলোর ম্যাপ তৈরি করেই আঁকা হয় মিল্কিওয়ের সর্পিল বাহু।

এসব পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা জানি, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির অন্তত দুটি সর্পিলাকার বাহু আছে। আর বাহুগুলো লম্বাটে বা চিনাবাদামের মতো লম্বাটে আকৃতির কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অনেকটা ইংরেজি S আকৃতি তৈরি করেছে। তবে এর বাইরের জিনিসগুলো একটু অস্পষ্ট। মিল্কিওয়ের হয়তো আরও দুটো মাঝারি আকারের বাহু থাকতে পারে, অথবা এলোমেলোভাবেও থাকতে পারে কিছু ছোট বাহু। এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। কারণ, আমরা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির যে ছবিই দেখি না কেন, তার বেশিরভাগই বিজ্ঞানভিত্তিক মডেল, জরিপ আর কল্পনার সমন্বয়ে তৈরি।

সূত্র: স্পেস ডট কম

আরও পড়ুন