মঙ্গল গ্রহের বিলিয়ন ডলারের নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে রাজি নন ট্রাম্প

রোভার পারসিভিয়ারেন্সছবি: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

গত চার বছর ধরে মঙ্গল গ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার রোভার পারসিভিয়ারেন্স। রোভারটি আছে গ্রহটির জেজেরো ক্রেটারে। একসময় এই জায়গায় বিশাল এক হ্রদ ছিল। তাই বিজ্ঞানীদের দাবি, ওখানে থাকতে পারে প্রাণও। এ ধারণার সত্যতা যাচাই করতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে পারসিভিয়ারেন্স। এরপর থেকে রোভারটি বহু জায়গা ঘুরে ঘুরে মাটি আর পাথরের নমুনা সংগ্রহ করেছে। সেই নমুনা এখন সিল করে রাখা হয়েছে কিছু ধাতব টিউবে। রোভারটি নিজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ কাজ করেছে। এগুলো ভবিষ্যতে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা ছিল নাসার। অত্যাধুনিক ল্যাবে এসব নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যেত, মঙ্গলের পাথরগুলোর মধ্যে প্রাচীন প্রাণের কোনো চিহ্ন আছে কি না। 

নাসা আর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ইসা যুগ্মভাবে এই মিশন পরিচালনা করছে। মিশনের নাম দেওয়া হয়েছে মার্স স্যাম্পল রিটার্ন বা এমএসআর। কয়েক দশকের পরিকল্পনা আর বিলিয়ন ডলার খরচের পর এই মিশন চালু হয়েছে। গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে যত গবেষণা হয়েছে, এটি তার মধ্যে অন্যতম। 

অনেকে আবার বলছেন, মানুষ গিয়ে নমুনা আনবে, এই ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্রহবিজ্ঞানী স্কট হাবার্ড বলেছেন, ‘চলুন, বাস্তব চিন্তা করি। কবে মানুষ মঙ্গলে যাবে?

কিন্তু সবকিছু বদলে যেতে পারে ট্রাম্প প্রশাসনের এক ঘোষণায়। গত ২ মে হোয়াইট হাউসের বাজেট অফিস থেকে এমন একটি প্রস্তাব এসেছে, যেখানে নাসার মোট বাজেট ২৫ শতাংশ কমানোর কথা বলা হয়েছে। এই বাজেটে এমএসআর পুরোপুরি বাতিল করার সুপারিশও রয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই মিশন ‘অতিরিক্ত ব্যয়বহুল’ এবং এই কাজ ভবিষ্যতে মানুষ পাঠিয়ে করা হবে। 

এই ঘোষণা সবাইকে চমকে দিয়েছে। কারণ, এই ঘোষণার মাত্র দুই দিন আগেই নাসার মার্স এক্সপ্লোরেশন প্রোগ্রাম বিশ্লেষণ কমিটির এক সভায় এমএসআর প্রোগ্রামের পরিচালক ডনিয়া ডগলাস-ব্র্যাডশ ইতিবাচক রিপোর্ট দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এই প্রথম আমরা অন্য গ্রহ থেকে কিছু পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনব।’

আরও পড়ুন

তবে তিনি এমএসআরের সমস্যাগুলো অস্বীকার করেননি। একাধিক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এই মিশনের বাজেট ফুলে ফেঁপে প্রায় ১১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর নমুনা ফেরাতে সময় লাগবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত। এটা খুবই ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। গত বছর অবশ্য এই সমস্যার সমাধান হিসেবে বলা হয়েছিল, ২০৩৫ সালের মধ্যেই এ নমুনা ফেরানো যাবে এবং ব্যয় নামিয়ে আনা হবে ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারে। দুটি আলাদা পরিকল্পনা নিয়ে একসঙ্গে কাজ চলছিল। কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে, তা নির্ধারণের কথা ছিল ২০২৬ সালে।

মঙ্গল গ্রহে দাগযুক্ত শিলার সন্ধান পেয়েছে নাসার পারসিভারেন্স রোভার
ছবি: নাসা

এমএসআরের বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা অনেককে ক্ষুব্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথওয়েস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাকাশবিজ্ঞানী ভিক্টোরিয়া হ্যামিল্টন বলছেন, ‘এটি শুধু দীর্ঘ পরিকল্পনা নষ্ট করবে না, বরং আন্তর্জাতিক মঞ্চে মার্কিন নেতৃত্বও দুর্বল করে দেবে। নাসার রোবোটিক অভিযানগুলো বিশ্বে শ্রেষ্ঠ। এগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের অনুপ্রেরণা জোগায়। এই নেতৃত্ব হারানো মানে পিছিয়ে পড়া।’

মার্কিন প্রশাসনের এই ঘোষণার দুই দিন পরেই ইসার মহাপরিচালক জোসেফ অ্যাশবাচার ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ইসরোর সঙ্গে ভবিষ্যতে যৌথ মহাকাশ অভিযানের ঘোষণা দেন।

অনেকে আবার বলছেন, মানুষ গিয়ে নমুনা আনবে, এই ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্রহবিজ্ঞানী স্কট হাবার্ড বলেছেন, ‘চলুন, বাস্তব চিন্তা করি। কবে মানুষ মঙ্গলে যাবে? ২০৩৯ বা ২০৪০ সালের আগে মঙ্গলে যাওয়ার কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনাই নেই।’

অন্যদিকে চীন বলছে, তারা ২০৩০ সালের মধ্যেই একটি ‘নমুনা সংগ্রহ’ মিশন পরিচালনা করবে মঙ্গলে। যদিও সেটি নাসার মতো এত ব্যয়সাপেক্ষ হবে না, কিন্তু মঙ্গল থেকে সহজভাবে কিছু পাথর তুলে আনতে পারবে। এতে দেশটি দাবি করতে পারবে, তারাই মঙ্গল থেকে প্রথম নমুনা সংগ্রহ করেছে।

এমএসআরের নমুনাগুলো প্রকৃত অর্থেই মূল্যবান। কারণ ওগুলো নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য মাথায় রেখে সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু ‘যেকোনো পাথর’ দিয়ে মঙ্গলের বয়স, বায়ুমণ্ডল বা প্রাণের সম্ভাবনার মতো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। আর মানুষের মঙ্গল যাত্রা এমএসআরের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ। এমনকি মানুষ অবতরণ করলে, পৃথিবীর জীবাণু মঙ্গলে পৌঁছে যেতে পারে। ফলে নষ্ট হতে পারে নমুনার বিশুদ্ধতাও। 

আরও পড়ুন

এখন পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসনের মনোনীত নাসা প্রধান জারেড আইজাকম্যান এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। তাঁর নিয়োগ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ফলে তিনি এখনই এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে পারবেন কি না, তা অনিশ্চিত।

আলোক টেলিস্কোপে মঙ্গলগ্রহ
ছবি: নাসা

যুক্তরাষ্ট্রের প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইনস্টিটিউটের প্রধান অ্যামান্ডা হেনড্রিক্স বলছেন, ‘এটা দেখে মনে হচ্ছে, মার্কিন প্রশাসন ইচ্ছে করেই যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ নেতৃত্ব অন্যদের হাতে তুলে দিতে চায়।’ 

এদিকে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এখনো শান্ত থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সরাসরি ঘোষণা এলে হয়তো তারা এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। ইউরোপীয় অংশ হিসেবে তারা বর্তমানে আর্থ রিটার্ন অরবিটার (ERO) বানাচ্ছে। এটা মঙ্গলের কক্ষপথে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবে। এই প্রকল্পে তারা ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ইউরো খরচ করে ফেলেছে। যদি এমএসআর বাতিল হয়, তাহলে এটা ইউরোপের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিতে পরিণত হবে। 

একাধিক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এই মিশনের বাজেট ফুলে ফেঁপে প্রায় ১১ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আর নমুনা ফেরাতে সময় লাগবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত।

তবে বাজেটের চূড়ান্ত রূপ এখনো আসেনি। জুনের মধ্যে তা আসবে। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, এই প্রোগ্রাম চলবে, নাকি বন্ধ হয়ে যাবে। নাসার প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে গেলে ইসার কি হবে, তা সময়ই বলে দেবে। হয়তো ইসা নতুন পার্টনার খুঁজবে। 

মঙ্গলপৃষ্ঠে পারসিভারিয়েন্স রোভার
ছবি: নাসা

মার্কিন প্রশাসনের এই ঘোষণার দুই দিন পরেই ইসার মহাপরিচালক জোসেফ অ্যাশবাচার ভারত সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ইসরোর সঙ্গে ভবিষ্যতে যৌথ মহাকাশ অভিযানের ঘোষণা দেন। পৃথিবীর নিম্ন-কক্ষপথে এবং চাঁদে মানুষ পাঠাতে ভারতকে সাহায্য করবে ইসা। বিবৃতির দুদিনের মধ্যে অ্যাশবাচারের এ ভারত সফর কাকতালীয় হতে পারে, আবার নাও পারে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি যে কতটা অস্থির হতে পারে, তা হয়তো আঁচ করতে পারছে ইসা।

মার্স স্যাম্পল রিটার্ন মিশন বন্ধ হয়ে যাবে কি না, তা হয়তো জানা যাবে আগামী জুনে। ততদিনে ট্রাম্প প্রশাসন সিদ্ধান্ত বদলায় কি না, তা-ই এখন দেখার বিষয়!

সূত্র: সায়েন্টিফিক আমেরিকান

আরও পড়ুন