মহাকাশ
মহাবিশ্বের মহাশূন্যতা
মহাবিশ্ব যে কত বড়, তা কল্পনা করাও কঠিন। জন্মের পর থেকে প্রসারমাণ মহাবিশ্বের পুরোটা আমাদের পক্ষে দেখাও সম্ভব নয়। দেখতে হলে চোখে আলো আসা চাই। অথচ আলোর বেগ সেকেন্ডে মাত্র তিন লাখ কিলোমিটার। মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে প্রকৃতির সর্বোচ্চ বেগও তুচ্ছ।
মহাবিশ্ব যে কত বড়, তা কল্পনা করা কঠিন। জন্মের পর থেকে প্রসারমাণ মহাবিশ্বের পুরোটা আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। দেখতে হলে চোখে আলো আসা চাই। অথচ আলোর বেগ সেকেন্ডে মাত্র তিন লাখ কিলোমিটার। মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে প্রকৃতির সর্বোচ্চ বেগও তুচ্ছ। আলোর বেগের স্বল্পতার কারণে মহাবিশ্বের এমন অঞ্চল আছে, যা আমরা কোনো দিন দেখতে পাব না। কারণ, সেখান থেকে আলো কোনো দিনই আমাদের কাছে এসে পৌঁছাবে না। আলো পেরে উঠবে না মহাবিশ্বের স্থানের ক্রমেই বেশি হারে প্রসারণের সঙ্গে।
মহাবিশ্বের যতটুকু তাত্ত্বিকভাবে দেখা সম্ভব, তার নাম পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব। যতটা বোঝা যাচ্ছে, মহাবিশ্বের সার্বিক আকৃতি সম্ভবত সমতল৷ তবে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব গোলাকার। কারণ, আমরা বাধাহীন কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে চতুর্দিকে যতটুকু এলাকা দেখতে পারি, তার আকৃতি গোলকের মতো। ডানে, বাঁয়ে, ওপরে, নিচে, সামনে, পেছনে ও এগুলোর মাঝামাঝি যেকোনো দিকে। আলোর বেগ ও মহাবিশ্বের প্রসারণ—এ দুটি থেকে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের আকার হিসাব করা হয়েছে। এর ব্যাসার্ধ ৪৬৫০ কোটি আলোকবর্ষ। মানে পৃথিবী থেকে যেকোনো দিকে তাকিয়ে আমরা সর্বোচ্চ এতটা দূরের জিনিস দেখতে পারব। এর চেয়ে দূরের বস্তু কখনোই আমাদের চোখে পৌঁছাবে না।
চন্দ্রালোকিত রাতের আকাশে তাকালে আমরা মহাবিশ্বের আমাদের নিকটতম প্রতিবেশীকে দেখতে পাই। দেখতে পাই সৌরজগতের অন্য গ্রহদেরও। সব সময় দেখা না গেলেও পাঁচটি গ্রহ দেখা যায় খালি চোখে। বুধ ও শুক্র ছাড়া অন্য গ্রহদের আছে উপগ্রহ। গ্রহরা ঘোরে সূর্যের চারপাশে। ঘোরে আরও অনেক কিছু। প্লুটোর মতো বামন গ্রহ, গ্রহাণু ও ধূমকেতু।
আকাশগঙ্গা ও অ্যান্ড্রোমিডা দুই ছায়াপথই আবার লোকাল গ্রুপ নামের একটি ছায়াপথ গোষ্ঠীর সদস্য। যাতে ৮০টির বেশি ছায়াপথ মহাকর্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ আছে। লোকাল গ্রুপের মতো অন্তত ১০০টি এমন গ্রুপ নিয়ে আছে ভার্গো সুপারক্লাস্টার।
সৌরজগৎ পেরিয়ে বাইরে উঁকি দিলে দেখা যাবে সূর্যের মতো আরও অনেক সূর্যের। গ্রহ আছে সৌরজগতের তারাদেরও। প্রথম বহিঃসৌরগ্রহ বা এক্সোপ্লানেট আবিষ্কৃত হয় ১৯৯২ সালে। সূর্যের মতো তারাদের প্রায় ২০ ভাগের অন্তত একটি দানব গ্রহ আছে। অন্তত ৪০ ভাগ তারার আছে ছোট ভরের গ্রহ। মহাবিশ্বের প্রায় ৮০ ভাগ পর্যন্ত তারারা আবার জোড়া তারা। ঘোরে অন্য তারার চারপাশে।
নক্ষত্ররাও বসে নেই। ঘোরে ছায়াপথ কেন্দ্রের চারপাশে। আমাদের সূর্যের বাস মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথে। ছায়াপথটির কেন্দ্র থেকে প্রায় ২৫ লাখ আলোকবর্ষ দূরে আছি আমরা ও সূর্য। অবস্থান ছায়াপথের কালপুরুষ নামের সর্পিল বাহুটায়। আকাশগঙ্গায় তারা আছে ১০ থেকে ৪০ হাজার কোটি৷ চওড়া প্রায় ৮৭ হাজার থেকে ১ লাখ আলোকবর্ষ। পার্শ্ববর্তী (নিকটতম নয় যদিও) অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথ তো আরও বড়। ১ লাখ ৫২ হাজার আলোকবর্ষ। ছায়াপথই নক্ষত্রদের একমাত্র সমাবেশ নয়। ছায়াপথের মধ্যে আবার বিভিন্নভাবে তারার দলের মেলা বসে। এই যেমন বটিকাকার তারাপুঞ্জ বা উন্মুক্ত তারাপুঞ্জ। মেসিয়ার ৯২ বটিকাকার তারাপুঞ্জের একটি উদাহরণ। পুঞ্জের তারারা মহাকর্ষীয় বাঁধনে আবদ্ধ একে অপরের সঙ্গে। পুরো পুঞ্জের ভর ৩ লাখ ৩০ হাজার সূর্যের সমান।
আকাশগঙ্গা ও অ্যান্ড্রোমিডা দুই ছায়াপথই আবার লোকাল গ্রুপ নামের একটি ছায়াপথ গোষ্ঠীর সদস্য। যাতে ৮০টির বেশি ছায়াপথ মহাকর্ষীয় বন্ধনে আবদ্ধ আছে। লোকাল গ্রুপের মতো অন্তত ১০০টি এমন গ্রুপ নিয়ে আছে ভার্গো সুপারক্লাস্টার। বিশাল এই সুপারক্লাস্টার ১১ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত। পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বে এর মতো অন্তত এক কোটি সুপারক্লাস্টার আছে। ভার্গো আবার লানিয়াকেয়া সুপারক্লাস্টারের অন্তর্ভুক্ত। দুটোই পাইসিজ-সিটাস ফিলামেন্টের অংশ। এই ফিলামেন্ট ১০০ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত। বিভিন্ন সুপারক্লাস্টার নিয়ে গড়ে ওঠা গ্যালাক্সি ফিলামেন্টরা মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় কাঠামো। পাইসিজ-সিটাসের পাশেই আরেক ফিলামেন্ট পারসিয়াস-পেগাসাস। ১৯৮৫ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। ১৯৮৭ সালে আবিষ্কৃত হয়েছিল পাইসিজ-সিটাস। একই সালে আবিষ্কৃত হয় ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত আরেক জিনিস। সেটার কথা বলছি একটু পরে।
১৯৬০–এর দশকে দেখা গিয়েছিল মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি ও ক্লাস্টারের চেয়ে বড় সমাবেশ আছে। আছে সুপারক্লাস্টার। পাওয়া গেল লোকাল সুপারক্লাস্টার। বহু ছায়াপথের মিলিত এক বিন্দু আলো বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেল প্রথম সুপারক্লাস্টারের আকৃতি।
আবার এমনও ছায়াপথ আছে, যারা অন্যদের থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। অন্য কারও সঙ্গে মহাকর্ষীয় বন্ধন নেই। তাদের নাম ফিল্ড গ্যালাক্সি। এমন একটি ছায়াপথের নাম এনজিসি ৪০৪। পৃথিবী থেকে এক কোটি আলোকবর্ষ দূরে।
এত সব গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, পুঞ্জের কথা শুনে মনে হতে পারে মহাবিশ্ব এগুলো দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ। আসলে তা নয়। মহাবিশ্বে আছে মহাশূন্যতাও। ১৯৮৭ সালে আবিষ্কৃত হয় এমনই এক শূন্যতা। ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত এই বিশাল বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নাম জায়ান্ট ভয়েড। তবে এটাই প্রথম পাওয়া শূন্যতা নয়। এর ৯ বছর আগে দেখা মেলে প্রথম মহাজাগতিক শূন্যতার।
১৯৬০–এর দশকে দেখা গিয়েছিল মহাবিশ্বে গ্যালাক্সি ও ক্লাস্টারের চেয়ে বড় সমাবেশ আছে। আছে সুপারক্লাস্টার। পাওয়া গেল লোকাল সুপারক্লাস্টার। বহু ছায়াপথের মিলিত এক বিন্দু আলো বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেল প্রথম সুপারক্লাস্টারের আকৃতি। শুরু হয় মহাবিশ্বের বড় আকারের কাঠামো জানার সূচনা। সময় গড়াল। পর্যবেক্ষণের পর পর্যবেক্ষণ চলল। একের পর এক পাওয়া গেল ছায়াপথ ও তাদের সমাবেশ। কিন্তু না, একদিন আর তা পাওয়া গেল না। মহাজগতে পাওয়া গেল এক মহাশূন্যতা। বিশাল বিস্তীর্ণ এলাকায় নেই কোনো কিছু। এ যেন বিশাল সবুজের মাঝে এক টুকরা সাহারা মরুভূমি। ৬৫০ আলোকবর্ষ চওড়া এক শূন্যতা। এটা ১৯৭৮ সালের কথা। এ শূন্যতা আবিষ্কার করলেন লেয়ার্ড থম্পসন ও স্টিফেন গ্রেগোরি। যুক্তরাষ্ট্রের কিট পিক জাতীয় মানমন্দির থেকে পাওয়া যায় এ পর্যবেক্ষণ।
ভয়েড মানে শূন্যস্থান নয়। যদিও শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়ামও শূন্য নয়। সেটা অন্য আলোচনা। ভয়েডের মধ্যে হয় ছায়াপথ আছে, তা না হলেও আছে বিচ্ছিন্ন হাইড্রোজেন গ্যাসের অণু কিংবা বিকিরণ। তবে মজার ব্যাপার হলো, মহাবিশ্বের পুরো আয়তনের মধ্যে ভয়েডের পরিমাণই বেশি।
আগেই বলেছি, মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় জানা কাঠামোর নাম ফিলামেন্ট। আর ভয়েডের স্থান ফিলামেন্টের ভাঁজে ভাঁজে। ফিলামেন্টে থাকে মহাকর্ষীয় বাঁধনে আবদ্ধ সুপারক্লাস্টার। একেকটা ফিলামেন্ট ১৬ থেকে ২৬ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত থাকে। ভয়েড যে একদম ফাঁকা, তা নয়। এর মধ্যেও কিছু নিঃসঙ্গ ছায়াপথ থাকতে পারে। ছায়াপথের উপস্থিতি তুলনামূলক কম এমন সুবিশাল জায়গাকেও ভয়েড বলা হয়। আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথ তো এমনই এক প্রস্তাবিত ভয়েডে অবস্থিত। এর নাম কেবিসি ভয়েড বা লোকাল হোল। আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, লোকাল গ্রুপ ও এমনকি লানিয়াকেয়া সুপারক্লাস্টার পুরোটাই এই শূন্যতার ভেতরে আছে। মহাবিশ্বের অন্য বেশির ভাগ এলাকার চেয়ে এখানে ছায়াপথের উপস্থিতি অনেক কম। এমন স্বল্প ঘনত্বের বিস্তৃতি প্রায় ২০০ কোটি আলোকবর্ষ। তবে শূন্যতা এর চেয়ে বড় আছে। এখন পর্যন্ত অবশ্য লোকাল হোলের চেয়ে বড় একটি ভয়েড পাওয়া গেছে। ২৯৫ কোটি আলোকবর্ষ বিস্তৃত এ শূন্যতার নাম লোজ নর্থ ১৩৭৮৮ ভয়েড। এত বিশাল জায়গায় ছায়াপথ আছে মাত্র এক লাখ।
ভয়েড মানে শূন্যস্থান নয়। যদিও শূন্যস্থান বা ভ্যাকুয়ামও শূন্য নয়। সেটা অন্য আলোচনা। ভয়েডের মধ্যে হয় ছায়াপথ আছে, তা না হলেও আছে বিচ্ছিন্ন হাইড্রোজেন গ্যাসের অণু কিংবা বিকিরণ। তবে মজার ব্যাপার হলো, মহাবিশ্বের পুরো আয়তনের মধ্যে ভয়েডের পরিমাণই বেশি। ভয়েডের মধ্যেও পাওয়া যায় ছোট ও অনুজ্জ্বল বামন ছায়াপথ। মহাবিশ্বের জানা স্থানের প্রায় ৯০ ভাগই ভয়েড। ধারণা করা হয়, আদি মহাবিশ্বের ঘনত্বের তারতম্য থেকে ভয়েডের উৎপত্তি ঘটেছে। প্রাথমিক মহাবিশ্বে উচ্চ ঘনত্বের অঞ্চল আশপাশের এলাকা থেকে আরও বেশি পদার্থ টেনে নিয়েছে। নিয়েছে কম ঘনত্বের জায়গা থেকেও। এতে কম ঘনত্বের স্থান আরও হালকা হয়েছে। এই কম ঘনত্বের স্থানই আজকের ভয়েড।