ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে নাসার প্রধান নভোচারীর বক্তৃতা, স্বপ্নময় কিছুক্ষণ

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবা। সেই বক্তৃতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা... এবং একগুচ্ছ ছবি...

নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবাছবি: আশরাফুল আলম

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উপচে পড়া ভীড়। শুধু উপচে পড়া বললে ভুল হয়। ‘তিল ধারণের ঠাঁই নেই’—কথাটি বোধ হয় এরকম পরিস্থিতি বোঝানোর জন্যই বানানো হয়েছে। নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবা বাংলাদেশে এসেছেন। আজ তিনি এখানে বক্তৃতা দেবেন। আমরা এসেছি সেই বক্তৃতা শুনতে। এক জীবনে বারবার এমন সুযোগ মেলে না। উপচে পড়া ভীড় সে জন্যই। সবাই তাঁর কথা শুনতে চান, তাঁকে দেখতে চান।

বিজ্ঞানচিন্তার কথা বলে ভীড় এড়িয়ে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পাওয়া গেল। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো প্রায় ঘণ্টাখানেক বাকি। ভেতরে কিছু সংরক্ষিত সিট অবশ্য রয়েছে। একসারি মিডিয়ার জন্য বরাদ্দ। পেছনে তাকাতেই দেখা গেল, দুই তলা অডিটোরিয়ামের সবটা কানায় কানায় ভরা। বাইরে আরও বহু মানুষ দাঁড়িয়ে।

ঘণ্টাখানেক ওভাবে বসেই কাটল। আমাদের আলোকচিত্রী আশরাফুল আলম ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত। ছবি তোলার বাড়তি সুযোগ পাওয়া যাবে না। প্রস্তুত অন্যান্য মিডিয়ার আরও অনেকে। ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছোঁয়ার আগেই অবশ্য প্রতীক্ষার অবসান হলো। নাসার প্রধান নভোচারী ঢুকে পড়লেন। নভোচারীদের পোশাক পরেই এসেছেন। তাঁর সঙ্গে এসেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, স্কুল অব ডাটা অ্যান্ড সায়েন্সেসের ডিন অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার এবং কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমানসহ আরও অনেকে।

জোসেফ এম আকাবা মানুষটি কে, তা নিয়ে খানিকটা পড়াশোনা করে না গেলে অন্যায় হতো। কাজেই একটুখানি পড়াশোনা করেই গিয়েছি। ইন্টারনেটে নাসা ও উইকিপিডিয়ার সূত্রে যা জানা যায়, সেটুকুই। সেই সূত্রে জানা আছে, সামনের মানুষটি একজন হাইড্রোজিওলজিস্ট। এককালে শিক্ষকতা করেছেন। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন জাতিসংঘের শান্তি মিশনে। প্রথম পুয়ের্তোরিকান বংশোদ্ভূত ব্যক্তি হিসেবে ২০০৪ সালের মে মাসে নাসার নভোচারী প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। ২০২৩ সালে তাঁকে নাসার নভোচারী কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছোঁয়ার আগেই অবশ্য প্রতীক্ষার অবসান হলো। নাসার প্রধান নভোচারী ঢুকে পড়লেন। নভোচারীদের পোশাক পরেই এসেছেন
আকাবা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তার জবাব দিচ্ছেন দর্শকের উচ্ছ্বাসের
ছবি: আশরাফুল আলম

সেই মানুষটি এখন সামনে দাঁড়িয়ে। দর্শকসারি থেকে উল্লাস শোনা গেল। আকাবা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তার জবাব দিলেন। এরপর মঞ্চ থেকে নেমে সংরক্ষিত আসনে বসে পড়লেন। উপস্থাপক প্রথমেই অধ্যাপক মাহবুব মজুমদারকে আহ্বান করলেন কিছু বলতে। এ উদ্যোগের পেছনে তাঁর ভূমিকার কথাও জানালেন উপস্থিত সবাইকে।

অধ্যাপক মাহবুব মজুমদার জানালেন, শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপস্থিত সবাইকে সংক্ষেপে ধন্যবাদ জানিয়ে চট করে মঞ্চ ছেড়ে দিলেন তিনি।

চলে এল সেই মুহূর্ত। উপস্থাপক তা বুঝেই বললেন, ‘আমি জানি, উপস্থিত কেউ আমার কথা শুনতে চায় না। আমিও চাই না!’ এরপরেই মঞ্চে উপস্থিত হতে অনুরোধ করা হলো জোসেফ এম আকাবাকে।

এলেন তিনি। সবার প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিজ্জা খেতে পছন্দ করে কারা?’

অনেকেই হাত তুলল। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘আমরা এখানে মজা করব। কিন্তু স্যাররা যেহেতু আছেন, তাঁদের দেখাতে হবে তো যে পড়াশোনা করছি!’ এই বলেই একটা ভিডিও ছেড়ে দিলেন। অডিটোরিয়ামের বিশাল স্ক্রিনে দেখা গেল, নভোচারীরা নানারকম পিজ্জা বানাচ্ছেন, খাওয়াদাওয়া করছেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভাসছে পিজ্জা!

নভোচারীদের পিজ্জা প্রদর্শনী!
ছবি: আশরাফুল আলম

সবাই হাসছে। এর মধ্যেই মাইক্রোগ্র্যাভিটি এবং ওজনহীনতার কথা বললেন তিনি। ছয় মিনিটের একটি ভিডিওতে দেখালেন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তাঁর সর্বশেষ মিশনের কিছু মুহূর্ত। ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয় মিশনটি। শেষ হয় ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ৬ মাসের এ মিশনের মজার অভিজ্ঞতা দেখে মুগ্ধ হয় সবাই। এরকম তিনটি মহাকাশ মিশনে অংশ নিয়েছেন তিনি। মহাকাশে কাটিয়েছেন ৩০৬ দিন।

ভিডিওর পরে প্রশ্নোত্তরের সুযোগ দেওয়া হলো। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করছেন। প্রচণ্ড কৌতূহল তাঁদের। কার্বন ক্যাপচার নিয়ে কঠিন একটি প্রশ্ন করলেন একজন। আকাবা হাত তুলে বললেন, ‘আরে আরে, এত কঠিন প্রশ্নের উত্তর তো আমি পারি না!’

পরের প্রশ্নটিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গলতরী প্রকল্পের এক শিক্ষার্থী জানতে চাইলেন, ‘নভোচারীদের স্পেসস্যুটের কব্জিতে আয়না লাগানো থাকে কেন?’ আকাবা হেসে, মজা করে বললেন, ‘এই প্রশ্নটার উত্তর আমি জানি!’ ব্যাখ্যা করে বললেন, নভোচারীরা এক হাত দিয়ে স্যুটের কন্ট্রোল প্যানেল ঠিকঠাক করেন। তখন অন্য হাতের কব্জির আয়নায় তাকিয়ে সহজেই বুঝতে পারেন, এই হাতে কী করছেন। এ জন্য কন্ট্রোল প্যানেলের লেখাগুলো উল্টো করে লেখা হয়, আয়নায় সেটা সোজা দেখা যায়।

আন্তর্জাতিক নভোস্টেশন দেখাচ্ছেন আকাবা, বলছেন তাঁর মিশনের অভিজ্ঞতার কথা
ছবি: আশরাফুল আলম
আরও পড়ুন

একের পর এক কৌতূহলী প্রশ্ন ছুটে আসতে লাগল। ‘মহাকাশে কাঁদলে পানি কি মুখের সঙ্গে লেগে থাকে?’ উত্তরের পাশাপাশি প্রায় ওজনহীন পরিবেশে পানির ফোঁটা কেমন করে ভেসে বেড়ায়, এ নিয়ে ভিডিও দেখালেন আকাবা। বললেন, ‘মহাকাশে কান্না করা নিষেধ!’ কেন?—তার জবাবে মনে করিয়ে দিলেন, পানি ঢুকে গেলে নষ্ট হতে পারে বৈদ্যুতিক যন্ত্র। মজা করে বললেন, চাইলে নিজের কম্পিউটারে পানি ঢেলে দিয়ে কেউ এক্সপেরিমেন্ট করতেই পারে!

এমন নানা প্রশ্নে, হাসি-মজায় সময় কেটে গেল। প্রশ্ন তবু শেষ হয় না। এক শিক্ষার্থী হাত তুলেছিলেন, আকাবা জানালেন, এটাই শেষ প্রশ্ন। সেই শিক্ষার্থীকে বললেন, ‘এখন তোমার ওপর অনেক চাপ! প্রশ্ন ঠিকঠাক করে করো!’ প্রশ্নটা যথার্থই ছিল। ‘কীভাবে নভোচারী হলেন আপনি?’

জবাবে রীতিমতো পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন খুলে ধরলেন নাসার প্রধান নভোচারী। বড় করে তাতে লেখা: যে চারটি ভুল আমি করেছি।

জানা গেল, তাঁর এককালে মেটাল শপ ছিল। চাকরি-বাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন মেরিন কর্পসে। তারপর চলে গেলেন শান্তি মিশনে, স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। এরপর ফিরে এসে নিলেন শিক্ষকের চাকরি। কেন এগুলো ভুল ছিল, বললেন সে কথাও—স্বেচ্ছাসেবী কাজে একদমই পয়সা নেই, আর শিক্ষকের চাকরিতেও অর্থ তুলনামূলক কম। প্রেজেন্টেশনের পরের পৃষ্ঠাতেই দেখা গেল, এই কাজগুলোই তাঁর নভোচারী হওয়ার পথ গড়ে দিয়েছে। শান্তি মিশন শিখিয়েছে, বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কীভাবে যৌথভাবে কাজ করতে হয়। শিক্ষকতা শিখিয়েছে অদ্ভুত সব পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। আর মেটাল শপ? আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নানা কাজকর্ম। অনেক তত্ত্বকথার চেয়ে সেখানে গিয়ে হাতে-কলমে কাজ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।

এরপর সবার উদ্দেশে শেষের আগে বললেন, ‘ভুল সবাই করে। কেউ যদি বলেন কোনো ভুল করেননি, তবে তা মিথ্যে কথা। ভুল থেকে শিখতে হবে। এই ভুলই তখন গড়ে দেবে ভবিষ্যতে এগিয়ে চলার পথ।’

'কীভাবে আমি নভোচারী হলাম', নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শোনাচ্ছেন নাসার প্রধান নভোচারী
ছবি: আশরাফুল আলম

আকাবা কথা শেষ করলেন। এরপর আবার ভিডিও। পৃথিবীকে কেমন দেখায় মহাকাশ থেকে? একজন নভোচারী কী দেখেন? আমাদের সুন্দর গ্রহটার নানা রূপ স্তব্ধ করে দিল সবাইকে। ভিডিও শেষে বাতি জ্বলে উঠল। আকাবা বললেন, ‘ইয়েস, আওয়ার প্ল্যানেট ইজ সুপার কুল!’

সবাইকে নিয়ে ছবি তুলেই একছুটে বেরিয়ে গেলেন নাসার প্রধান নভোচারী।

পেছনে তাকালে তিনি দেখতেন, একদল স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এই স্বপ্নবাজ মানুষগুলোই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

দর্শকের একাংশ
ছবি: আশরাফুল আলম
আরও পড়ুন

আয়োজনের নেপথ্যে ও আকাবার ঢাকা সফর

যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রধান নভোচারী জোসেফ এম আকাবা প্রথমবারের মতো ঢাকা এলেন। দেশের তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করাই তাঁর এ সফরের উদ্দেশ্য। এই সফরের অংশ হিসেবেই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর এ বক্তৃতা আয়োজিত হয়।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান বললেন, ‘জোসেফ এম আকাবা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার ঘুরে দেখেছেন। এর চেয়ে ভালো গবেষণাগার তিনি নিশ্চয়ই দেখেছেন বহুবার, তবে আমাদের দেশে এরকম গবেষণাগার দেখে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেছেন।’ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারেই বানানো হয়েছে মঙ্গলের উপযোগী রোভার ‘মঙ্গলতরী’; ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় যেটি একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছে।

সবার সঙ্গে আকাবার ছবি
ছবি: আশরাফুল আলম

জানা গেছে, আকাবা প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম ছাড়াও একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অংশ নেবেন। সেখানে তিনি বৈশ্বিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নাসার অবদান এবং মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করবেন। বিশেষ করে আর্টেমিস অ্যাকর্ডসের মাধ্যমে সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরবেন। মহাকাশে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, লুক্সেমবার্গ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশ। ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর এটি প্রণীত হয়। বর্তমানে এ নীতিমালায় মোট ৫০টি রাষ্ট্র স্বাক্ষর করেছে। এটিই আর্টেমিস অ্যাকর্ডস। এ নীতিমালা নাসা ও বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মহাকাশ ও প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা আরও জোরদারে সাহায্য করতে পারে। বাংলাদেশের এ অ্যাকর্ডসে যোগদানের ব্যাপারে আলোচনা করার কথা রয়েছে আকাবার।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া বক্তৃতায়ও আকাবা এই অ্যাকর্ডসে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘মঙ্গলের মতো ভিন্ন গ্রহে বসবাস করতে হলে আমাদের সবাইকে এক হতে হবে, একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

বলা বাহুল্য, এ অ্যাকর্ডসের অংশ হিসেবেই আর্টেমিস প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের অধীনে আর্টেমিস ১ নভোযান ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের প্যাড ৩৯বি থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মাধ্যমে প্রায় ৫০ বছর পর নতুন করে চন্দ্রাভিযান শুরু করে মানুষ। সে বছরের ১১ ডিসেম্বর ফিরে আসে এ নভোযান। ২০২৪ সালে আর্টেমিস ২ উৎক্ষেপণের কথা ছিল, এখন তা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে চাঁদের উদ্দেশে যাত্রা করবে এ নভোযান। আর্টেমিস ৩-এর মাধ্যমে আবার চাঁদে নামার স্বপ্ন দেখছে মানুষ। ২০৪০ সালের মধ্যে মঙ্গলজয়েরও চিন্তা করছে। অবশ্য এর কতটা সত্যি হবে, তার উত্তর জানে শুধু সময়।