পৃথিবী ও আকাশ
পৃথিবীর প্রথম কৃত্রিম সোভিয়েত উপগ্রহ
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ রাতের আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছে। খোঁজার চেষ্টা করেছে আকাশ ও পৃথিবীর নানা রহস্যের সমাধান। পৃথিবী ও আকাশ নামে এই বইয়ে সেই সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছোটদের জন্য, সহজ ভাষায়। বইটি প্রকাশিত হয়েছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘বিদেশি ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’ থেকে। আলেকজান্ডার ভলকভের লেখা বইটি রুশ থেকে অনুবাদ করেছেন সমর সেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য বইটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে…
এ বইয়ে কয়েকবার স্পুটনিকের নাম উল্লেখ করেছি। সোভিয়েত (বর্তমান রাশিয়া) বিজ্ঞানের এই অপরূপ অবদানের বিষয়ে আরও কিছু বলা যাক।
দ্যুলোকে একটি স্টেশন বানানোর মতলব থাকলে আমাদের শত শত রকেট পাঠাতে হবে, প্রতিটিতে থাকবে আলাদা আলাদা অংশ। তারপর সেগুলো জড়ো করে জোড়া লাগাতে হবে বহিশূন্যে বা মহাকাশে। অত্যন্ত কঠিন, অত্যন্ত জটিল এ কাজ। দীর্ঘ প্রস্তুতির দরকার। পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা রকেট ছোড়ার বিদ্যা প্রথমে শিখতে হবে। মানুষের তৈরি প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষিপ্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে।
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর প্রথম উপগ্রহ পাঠানো হয়। বিদ্যুৎগতিতে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল সারা দুনিয়ায়। নাম দেওয়া হলো স্পুটনিক। এই রুশ শব্দটির অর্থ উপগ্রহ বা সহযাত্রী। পৃথিবীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার ঘরোয়া শব্দে পরিণত হলো এই শব্দটি।
নতুন কৃত্রিম উপগ্রহটি অত্যন্ত ছোট। ব্যাস—৫৮ সেন্টিমিটার, ওজন ৮৩ কিলোগ্রামের একটু বেশি। ছোট আধারটার মধ্যে ইঞ্জিনিয়াররা দুটো ছোট সর্ট-ওয়েভ রেডিও ট্রান্সমিটার বানাতে সমর্থ হন, যাদের সঙ্কেতধ্বনি— ব্লিপ, ব্লিপ, ব্লিপ। অচিরে সারা দুনিয়ার রেডিও-অ্যামেচারদের কাছে চেনা হয়ে গেল।
নতুন কৃত্রিম উপগ্রহটি অত্যন্ত ছোট। ব্যাস—৫৮ সেন্টিমিটার, ওজন ৮৩ কিলোগ্রামের একটু বেশি। ছোট আধারটার মধ্যে ইঞ্জিনিয়াররা দুটো ছোট সর্ট-ওয়েভ রেডিও ট্রান্সমিটার বানাতে সমর্থ হন, যাদের সঙ্কেতধ্বনি— ব্লিপ, ব্লিপ, ব্লিপ
পৃথিবীর চমক আর তারিফ তখনো কাটেনি, আবার একটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করল সোভিয়েত জনগণ। ১৯৫৭ সালের ৩ নভেম্বর দ্বিতীয় স্পুটনিক চড়ল মহাশূন্যে। এটি হলো একটি রকেটের নাসিকা-ভাগ, ওজন ৫০৮ কিলোগ্রাম। এর অভ্যন্তরে ছিল মাপের অনেক যন্ত্রপাতি, বিশেষ আধারে ছিল একটি কুকুর। লাইকা বহিঃশূন্যের প্রচণ্ড উর্ধ্বে ওঠে। এতে প্রমাণ হলো যে, প্রাণীরা ঊর্ধ্বগামী রকেটের ভয়ঙ্কর ত্বরণবেগ সহ্য করতে পারে।
ছয় মাসের একটু পরে, ১৯৫৮ সালের ১৫ই মে, তৃতীয় স্পুটনিক ছাড়লেন সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। বিদেশি সাংবাদিকেরা এর নাম দিলেন উড়ন্ত মোটরগাড়ি। এর ওজন ১ হাজার ৩২৭ কিলোগ্রাম, এর মধ্যে মানুষ থাকতে পারে।
প্রথম স্পুটনিকগুলোর কী হলো?
তৃতীয় স্পুটনিক ৬৯১ দিন টিকে পৃথিবীকে ১০ হাজার ৩৬ বার ঘোরে, ৪০ কোটি ৪৮০ লাখ কিলোমিটার পরিক্রমণ করে। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের তিন গুণ। এর দীর্ঘ কর্মজীবন শেষ হয় ১৯৬০ সালের ৬ই এপ্রিল
অতি উর্ধ্বে হাওয়া অত্যন্ত অনিবিড় হলেও মানুষের তৈরি উপগ্রহগুলোর গতিবেগে বাধা দেয় ক্রমশ, মন্থরগতি হয়ে এরা বায়ুমণ্ডলের ঘন স্তরে পড়ে ধুমকেতুর মতো পুড়ে যায়। দুঃখের কারণ নেই অবশ্য; স্পুটনিকগুলোর বৈজ্ঞানিক মূল্য অসামান্য। টেলিস্কোপে তাদের দেখে, রেডিওযোগে খবর পেয়ে বায়ুমণ্ডলের উচ্চ স্তর সম্বন্ধে অনেক কথা জানতে পারেন বিজ্ঞানীরা।
প্রতিটি নতুন স্পুটনিক আগের স্পুটনিকের চেয়ে ঊর্ধে ওঠে। প্রথম স্পুটনিকের উচ্চতা সীমা ছিল ৯০০ কিলোমিটার, দ্বিতীয়টি ওঠে ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার, আর তৃতীয়টি ১ হাজার ৮৮০ কিলোমিটার। যত উঁচুতে ওঠে, তত বেশি আয়ু, কেননা হাওয়ার বাধা তত কম।
প্রথম স্পুটনিক প্রায় ৯২ দিন টিকে থেকে পৃথিবীকে ১ হাজার ৪০০ যার প্রদক্ষিণ করে মোট যাত্রাপথ ৬ কোটি কিলোমিটার। মঙ্গলগ্রহের দিকে গেলে তাতে পৌঁছাত সে সময়ে, যখন মঙ্গল পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে। দ্বিতীয় স্পুটনিক ১৬২ দিন কক্ষপথে থেকে প্রায় ১০ কোটি কিলোমিটার ঘোরে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের দুই-তৃতীয়াংশ।
তৃতীয় স্পুটনিক ৬৯১ দিন টিকে পৃথিবীকে ১০ হাজার ৩৬ বার ঘোরে, ৪০ কোটি ৪৮০ লাখ কিলোমিটার পরিক্রমণ করে। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের তিন গুণ। এর দীর্ঘ কর্মজীবন শেষ হয় ১৯৬০ সালের ৬ই এপ্রিল।
কয়েক ডজন কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে এবং রকেটবিদ্যার টেকনিক সম্পূর্ণভাবে আয়ত্তে আনার পর প্রথম দ্যুলোক স্টেশন বানানোর সময় এসে পড়বে—সৌরমণ্ডলের গ্রহে যাত্রার পথ তখন উন্মুক্ত হবে।
(চলবে…)
মূল: আলেকজান্ডার ভলকভ, অনুবাদ: সমর সেন
* পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের মূলভাব ঠিক রেখে বানানরীতির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে।