২০২৪ সালে মহাকাশ অভিযানগুলো বারবার চমকে দিয়েছে আমাদের।
নাসার ইউরোপা ক্লিপার বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপা পানে ছুট দিয়েছে। স্পেসএক্সের স্টারশিপের বুস্টারগুলো প্রথমবারের মতো শূন্যে থাকতে খপ করে ধরে ফেলা হয়েছে চপস্টিকের মতো রোবটিক বাহু দিয়ে। ওদিকে চীনের চাঙ-ই ৬ মিশন চাঁদের উল্টোপাশ থেকে নমুনা নিয়ে ফিরেছে পৃথিবীতে। আন্তর্জাতিক নভোস্টেশন এখনো বিভিন্ন অভিযানের আন্তর্জাতিক নভোচারীদের স্বাগত জানাচ্ছে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য।
এ সবই বছরজুড়ে পড়েছেন পাঠক বিজ্ঞানচিন্তা প্রিন্ট ও অনলাইনে। জেনেছেন মহাকাশ অভিযান ও গবেষণার সাম্প্রতিক খবর। কিন্তু সামনে কী হতে যাচ্ছে? কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য ২০২৫ সালে?
অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার ঝেনবো ওয়াং এ নিয়ে একটি বিস্তারিত লেখা লিখেছেন। এ লেখায় উঠে এসেছে আসন্ন বছরের দারুণ কিছু মহাকাশ অভিযানের কথা। চলুন, সেগুলো জেনে নিই সংক্ষেপে।
চাঁদের মাটিতে সিএলপিএস
নাসার কমার্শিয়াল লুনার পেলোড সার্ভিসেস বা সিএলপিএস উদ্যোগের অধীনে ২০২৫ সালে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পৌঁছে দেওয়া হতে পারে চাঁদের মাটিতে। বড় বিষয় হলো, এ জন্য ব্যবহৃত হবে কমার্শিয়াল ল্যান্ডার; অর্থাৎ বাণিজ্যিক ল্যান্ডার। এই সিএলপিএস উদ্যোগের অধীনেই অ্যাপোলো মিশনের প্রায় ৫০ বছর পর, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি ইন্টুইটিভ মেশিনসের অডিসি ল্যান্ডার নেমেছিল চাঁদের বুকে।
২০২৫ সালে এরকম বেশ কিছু ‘ডেলিভারি মিশন’ পরিচালনা করবে নাসা। এ কাজে নাসার সহযোগী হিসেবে কাজ করবে অ্যাস্ট্রোবোটিক, ইন্টুইটিভ মেশিনস ও ফায়ারফ্লাই অ্যারোস্পেস।
এই মিশনগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নিয়ে যাওয়া হবে চাঁদের বিভিন্ন স্থানে। এর কিছু কিছু ব্যবহৃত হবে চাঁদের ভূতত্ত্ব বা চন্দ্রপৃষ্ঠ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গবেষণায়। মঙ্গলের পরিবেশ আরও ভালোভাবে বুঝতে ও ভবিষ্যতের মানব মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হবে এর মাধ্যমে।
স্ফিয়ারএক্সে আকাশ জরিপ
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাসা একটি স্পেক্ট্রো-ফটোমিটার উৎক্ষেপণ করতে চাইছে। এর নাম ইপক অব রিআয়োনাইজেশন অ্যান্ড আইসেস এক্সপ্লোরার (স্ফিয়ারএক্স, SPHEREx)। এটির উদ্দেশ্য মহাবিশ্বের ইতিহাস আরও ভালোভাবে জানা।
এ মিশন আকাশে জরিপ করবে নিয়ার-ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোর কাছাকাছি তরঙ্গে। খালি চোখে এ তরঙ্গ (পড়ুন, আলো) দেখা যায় না। তবে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা যায়। দৃশ্যমান আলোয় যেসব বস্তু বহু দূরের বা অত্যন্ত শীতল, সেগুলো ধরা পড়ে না। তবে দেখা যায় অবলাল বা এর কাছাকাছি তরঙ্গে।
স্ফিয়ারএক্স মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির ১০০ মিলিয়ন নক্ষত্র জরিপ করবে। পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহ করবে আরও ৪৫০ মিলিয়ন গ্যালাক্সি থেকে। এই জরিপের ওপর ভিত্তি করে এটি মহাকাশ বা মহাবিশ্বের মানচিত্র তৈরি করবে। এ তথ্য ব্যবহার করে জ্যোতির্বিদেরা গ্যালাক্সির জন্ম এবং স্টেলার নার্সারি বা নক্ষত্রের আঁতুড়ঘরে ছড়িয়ে থাকা জৈব যৌগ ও পানি নিয়ে গবেষণা চালাবেন।
পৃথিবীর নিম্ন-কক্ষপথ গবেষণায় স্পেস রাইডার
ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসা ২০২৫-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরে স্পেস রাইডার নামে মানবহীন একটি মিশন পরিচালনা করবে পৃথিবীর নিম্ন-কক্ষপথে। এটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য নভোযান, নিম্ন-কক্ষপথে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হবে।
এ সময় মাইক্রোগ্র্যাভিটি বা প্রায় ওজনহীন পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা ও গবেষণা চালানো হবে। দেখা হবে, এরকম পরিবেশে গাছ কীভাবে বেড়ে ওঠে, বিভিন্ন পদার্থ কী রকম আচরণ করে, বিভিন্ন জৈব প্রক্রিয়ার ওপর মহাকর্ষের প্রভাব ইত্যাদি।
এ ছাড়া ভবিষ্যতের বিভিন্ন মিশনে যেসব প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে, এর কিছু কিছু পরীক্ষা করে দেখবে স্পেস রাইডার। যেমন সর্বাধুনিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা পরীক্ষা করা হবে এতে। চাঁদ বা মঙ্গলে ব্যবহৃত হবে, এমন কিছু রোবটিক যন্ত্রপাতিও পরীক্ষা করে দেখা হবে এ সময়।
চাঁদের বুকে জাপানের এম২/রেজিলিয়েন্স
জাপানের এম২/রেজিলিয়েন্স চাঁদে যেতে পারে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। এ মিশনে একটি ল্যান্ডার এবং একটু মাইক্রো-রোভার নামবে চাঁদের পৃষ্ঠে।
এই মিশনে চাঁদের মাটি ও এর বিভিন্ন উপাদান নিয়ে গবেষণা চালানো হবে। পানির মূল উপাদান হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন। চাঁদের বুকে পানির অণু ভেঙে ফেলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন উৎপাদন করা যায় কি না, পরীক্ষা করে দেখা হবে তাও। এই পানি অবশ্য পৃথিবীর পানি নয়। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে পানি বের করে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে এ সময়। লক্ষ্য হলো, সেই পানিকে তাপ দেওয়া এবং ভেঙে যাওয়া হাইড্রোজেন-অক্সিজেন অণুযুক্ত বাষ্প সংগ্রহ করা। এই পানি, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন প্রয়োজন পড়বে যেকোনো দীর্ঘকালীন চন্দ্র অভিযানে।
চাঁদের বুকে নিখুঁতভাবে অবতরণ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোভার চালানোর জন্য নতুন প্রযুক্তি—অ্যাডভান্সড নেভিগেশন সিস্টেম পরীক্ষা করে দেখা হবে এ মিশনে। ভবিষ্যতের চাঁদ ও মঙ্গল মিশনে এ সিস্টেম কাজে লাগতে পারে।
গ্রহাণু গবেষণায় তিয়ানান-২
চীনের তিয়ানান-২ মিশন চেষ্টা করবে গ্রহাণু থেকে নমুনা নিয়ে ফেরার। ২০২৫ সালের মে মাসে পরিকল্পিত এই অভিযান প্রথমে চালানো হবে ৪৬৯২১৯ কামো’ওয়ালিওয়া গ্রহাণুতে। এটি ১৩১-৩২৮ ফুট দীর্ঘ এই গ্রহাণু হয়তো এককালে চাঁদেরই অংশ ছিল, এমনটাই ধারণা বিজ্ঞানীদের। তাঁরা মনে করেন, বড় কোনো সংঘর্ষে এটি ভেঙে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কাজেই, এ গ্রহাণুতে গবেষণা করে সৌরজগতের সূচনাকাল ও এর গঠন-কাঠামো গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি নিয়ে আরও ভালোভাবে জানতে চান বিজ্ঞানীরা। এ জন্য তিয়ানান-২ গ্রহাণুটির বুকে স্বল্প সময়ের জন্য নামবে, দ্রুত নমুনা সংগ্রহ করে আবার দেবে ছুট। এরপর এটি অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট বা গ্রহাণু বেষ্টনীর একটি গ্রহাণু ৩১১পি/প্যানস্টার্স-এও নেমে নমুনা সংগ্রহ করবে বলে পরিকল্পনা রয়েছে।
এ ছাড়াও বৃহস্পতির বরফচাঁদগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে ইসার জুস মিশন। নাসার লুসি মিশন বৃহস্পতির ট্রোজান গ্রহাণুগুলোতে অভিযান চালানোর কথা রয়েছে। স্পেসএক্স জানিয়েছে, বুস্টারের পাশাপাশি মূল স্টারশিপ রকেটটিও শূন্যে থাকতে ধরার চেষ্টা করবে তারা ২০২৫ সালে। রয়েছে আরও বেশ কিছু মিশন, যেগুলোর পরিকল্পনা এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি।
২০২৫ সাল মহাকাশ অভিযানের জন্য একটা রোমাঞ্চকর বছর হতে যাচ্ছে, এটুকু বোধ হয় আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।