বিজ্ঞানচিন্তার চোখে বছরজুড়ে জীববিজ্ঞানের আলোচিত ১০

২০২৪ সাল ছিল জীববিজ্ঞানের জন্য বেশ ঘটনাবহুল। দেশে-বিদেশে বেশ কিছু গবেষণা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে—এর কোনোটি বদলে দিয়েছে জীববিজ্ঞান গবেষণার ধারা, কোনোটি আবার উন্মোচিত করেছেন নতুন দিগন্ত। বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে এসব আলোচিত গবেষণা। শুধু তা-ই নয়, নিউ সায়েন্টিস্ট, কোয়ান্টা ম্যাগাজিন, হাউ ইট ওয়ার্কস, বিবিসি ফোকাস, ডিসকভার, সায়েন্টিফিক আমেরিকানসহ বেশ কিছু প্রকাশনা বছরজুড়ে আলোচিত বিভিন্ন গবেষণার তালিকা প্রকাশ করেছে। এর মধ্য থেকে বাছাইকৃত, বিজ্ঞানচিন্তার চোখে বছরজুড়ে আলোচিত ১০ দেখে নিন একনজরে।

সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রথমবার খাদ্য উৎপাদন করল প্রাণিকোষ

এ বছর প্রথমবারের মতো সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম প্রাণিকোষ তৈরি করেছেন জাপানের একদল বিজ্ঞানী। অর্থাৎ এ প্রাণিকোষ উদ্ভিদের মতোই সূর্যের আলো থেকে খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাকিহিরো মাতসুনাগার নের্তৃত্বে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। একে একুশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে প্রসিডিংস অব দ্য জাপান একাডেমি জার্নালে।

প্রাণিকোষ শুধু ক্লোরোপ্লাস্টকে মেনেই নেয়নি, বৃদ্ধিও হচ্ছিল কোষগুলোর। অর্থাৎ ক্লোরোপ্লাস্ট কোষটিকে কার্যকরভাবে শক্তি যোগান দিয়ে যাচ্ছিল

সালোকসংশ্লেষণ উদ্ভিদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের দেহকোষে সূর্যের আলো, পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে কোষের মধ্যে অক্সিজেন এবং শর্করা বা চিনি (সুগার) তৈরি হয়। সালোকসংশ্লেষণক্ষম এমন প্রাণিকোষ তৈরির চেষ্টা চলছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। ৭০-এর দশক থেকে এ নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। অধ্যাপক মাতসুনাগা ও তাঁর দল এ কাজের জন্য দুটি পদক্ষেপ নেন। প্রথমত, তাঁরা এমন ক্লোরোপ্লাস্ট খুঁজে ফেরেন, যেটা প্রাণিকোষের উষ্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারবে। প্রাণিদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রায় বেশির ভাগ উদ্ভিদের ক্লোরোপ্লাস্ট টিকতে পারে না। উপযুক্ত ক্লোরোপ্লাস্ট খুঁজে পাওয়ার পর শুরু হয় আসল চ্যালেঞ্জ। প্রাণিকোষকে বশ মানানোর চেষ্টা করেন তাঁরা, যেন ক্লোরোপ্লাস্টকে ক্ষতিকর মনে করে আক্রমণ না করে। মাতসুনাগা ও তাঁর দল কোষের মধ্যে জোর করে ক্লোরোপ্লাস্ট ঢোকানোর বদলে একে খাবার হিসেবে কোষের কাছে উপস্থাপন করেন। ফলে কোষের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটানো সম্ভব হয়, ক্লোরোপ্লাস্টও টিকে থাকে।

গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল দেখে অবাক হয়ে যান গবেষকেরা। প্রাণিকোষ শুধু ক্লোরোপ্লাস্টকে মেনেই নেয়নি, বৃদ্ধিও হচ্ছিল কোষগুলোর। অর্থাৎ ক্লোরোপ্লাস্ট কোষটিকে কার্যকরভাবে শক্তি যোগান দিয়ে যাচ্ছিল। এ অর্জন অনেক ক্ষেত্রেই দারুণভাবে কাজে লাগবে। বিশেষ করে চিকিৎসা ও কৃত্রিম প্রাণিজ মাংস উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। (বিস্তারিত পড়ুন: সালোকসংশ্লেষণ করবে প্রাণিকোষ!)

প্রতীকী ছবি

পাওয়া গেল নতুন রক্তের গ্রুপ

১৯৭২ সালে গর্ভবতী এক নারীর রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে চিকিৎসকরা অদ্ভুত এক ঘটনার সম্মুখীন হন। তাঁরা দেখতে পান, এই নারীর রক্তে অন্য সবার মতো লোহিত রক্তকণিকার পৃষ্ঠে যে প্রোটিন থাকে, সেটি নেই। প্রায় ৫০ বছর পরে বিজ্ঞানীরা এই রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছেন। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের রক্ত বিশেষজ্ঞ লুইস টিলি ও তাঁর দলই এই বিরল রক্তের গ্রুপের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছেন ২০ বছর ধরে। অবশেষে তাঁরা এই রহস্যের জট খুলতে পেরেছেন। আমেরিকান সোসাইটি অফ হেমাটোলজির ব্লাড জার্নালে এ সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।

আমরা জানি, রক্তের গ্রুপ মূলত এ, বি, ও এবং এবি—এই চার ধরনের হয়। এ ছাড়াও রেসাস ফ্যাক্টর (প্লাস বা মাইনাস) থাকতে পারে। এই গ্রুপগুলো আসলে আমাদের রক্তের লোহিত রক্তকণিকার ওপর থাকা বিশেষ ধরনের প্রোটিনের ওপর নির্ভর করে। এএনডাব্লিউজে নামে একটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন সাধারণত সবার রক্তে থাকে। কিন্তু, ১৯৭২ সালে আবিষ্কৃত ওই নারীর রক্তে এই প্রোটিনটি ছিল না। বিজ্ঞানীরা এই নতুন রক্তের গ্রুপকে ‘এমএএল’ নাম দিয়েছেন। (বিস্তারিত পড়ুন: পাওয়া গেল নতুন রক্তের গ্রুপ)

প্রথমবারের মতো স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনে ফিরে পেল দৃষ্টিশক্তি

দৃষ্টিশক্তির নানারকম সমস্যা রয়েছে অনেকেরই। এরকমই একটি সমস্যা অস্পষ্ট দেখা বা ব্লারি ভিশন। চোখের সামনের স্বচ্ছ অংশ কর্নিয়া প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে এমনটা হতে পারে। তিনজন মানুষের এ সমস্যার সমাধান করা হয়েছে স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে। এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্বখ্যাত দ্য ল্যানসেট জার্নালে।

এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালিত হয়েছে জাপানে। এর মাধ্যমে ইতিহাসে প্রথমবার স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সমাধান হলো দৃষ্টিশক্তি সমস্যার। এ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নেন মোট চারজন। তাঁদের প্রত্যেকের চোখের কর্নিয়ায় লিম্বাল স্টেম সেল ডেফিশিয়েন্সি বা এলএসসিডি নামের একটি সমস্যা ছিল। এ সমস্যা হলে কর্নিয়ার স্টেম কোষগুলো আর নতুন কোষ তৈরি করতে পারে না। এদিকে কর্নিয়ার কিছু কোষ মারা যেতে থাকে। এই মৃত কোষগুলো জমতে থাকে কর্নিয়ায়। এই দুইয়ে মিলে দৃষ্টিশক্তি অস্পষ্ট বা ঝাপসা হয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধান হিসেবেই স্টেম কোষ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ফলে সেগুলো কর্নিয়ার ক্ষতি সারিয়ে তুলেছে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: ইতিহাসে প্রথম স্টেম কোষ প্রতিস্থাপনে দৃষ্টিশক্তি সমস্যার সমাধান)

আরও পড়ুন

জিন থেরাপিতে শ্রবণশক্তি পুনরুদ্ধার

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জিন থেরাপির মাধ্যমে জন্মগতভাবে বধির এক শিশু শ্রবণশক্তি ফিরে পেয়েছে। যুক্তরাজ্যের ১৮ মাস বয়সী ওপাল স্যান্ডি নামের এক মেয়ে শিশুকে এই থেরাপি দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত স্যান্ডিই সবচেয়ে কম বয়সী শিশু, যাকে এ থেরাপি দেওয়া হয়েছে। শিশুটি ‘অডিটরি নিউরোপ্যাথি’ নামে একটি রোগে ভুগছিল। এ রোগের কারণে ভুক্তভুগীরা শব্দ শনাক্ত করতে পারে ঠিকই, কিন্তু মস্তিষ্কে তা রিলে হয় না। মানে মস্তিষ্ক সেই শব্দ শনাক্ত করতে বা বুঝতে পারে না। এ কারণে শিশু জন্মের সময় থেকেই বধির থাকে।

১৬ মিনিটের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শিশুটির কানে কার্যকরী জিন স্থাপন করা সম্ভব হয়। অস্ত্রোপচারের পর থেকে শব্দের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে শিশুটি। অস্ত্রোপচার করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: জিন থেরাপিতে জন্মগত বধির শিশুরা ফিরে পেল শ্রবণক্ষমতা!)

জীববিজ্ঞানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা

চলতি বছর রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক গবেষণায়। কম্পিউটেশনাল প্রোটিন ডিজাইনের জন্য এই পুরস্কারের অর্ধেক পেয়েছেন মার্কিন বিজ্ঞানী ডেভিড বেকার। আর প্রোটিনের গঠন অনুমানের জন্য বাকি অর্ধেকটা পেয়েছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেমিস হ্যাসাবিস ও মার্কিন বিজ্ঞানী জন এম জাম্পার। রসায়নে নোবেল দেওয়া হলেও গবেষণাটি যে জীববিজ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তা বলা বাহুল্য। কারণটা একটু খোলাসা করা যাক। যেকোনো প্রোটিন সাধারণত ২০ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিডের নানা ধরনের বিন্যাসের ফলে গঠিত হয়। অর্থাৎ এই অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোকে বলা যায় প্রাণের মূল ভিত্তি বা গাঠনিক একক। অ্যামিনো অ্যাসিড মিলে মিলে প্রোটিন গঠন করে, আর এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে জৈবনিক সব রাসায়নিক বিক্রিয়া। আর এবারের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা এই প্রোটিনই হ্যাক করেছেন!

নোবেল জয়ী দুই বিজ্ঞানী ডেমিস হ্যাসাবিস ও জন এম জাম্পার নোবেল পেয়েছেন মূলত আলফাফোল্ড২ নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই প্রোটিনের গঠন অনুমানের কাজটি করে। গুগল ডিপমাইন্ডের এই দুই বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে এ বছরের মে মাসে চলে এসেছে আলফাফোল্ড২-এর উত্তরসূরী—আলফাফোল্ড৩।

ড্রাগ আবিষ্কার, প্রোটিন বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন কাজে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে দাঁতের চিকিৎসায় পর্যন্ত কাজে লাগছে। তবে আলফাফোল্ড২ ও ৩-ই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। কোয়ান্টা ম্যাগাজিন লিখেছে, খুব কম সপ্তাহই পেরিয়েছে যখন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নতুন গবেষণা প্রকাশিত হয়নি। কাজেই চলতি বছরের আলোচিত কাজের তালিকায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ঠাঁই না দিলে যে অন্যায় হবে, সে তো বুঝতেই পারছেন। (রসায়নে নোবেল পুরস্কারজয়ী গবেষণার বিস্তারিত জানতে পড়ুন: প্রোটিন রহস্যের সমাধান করে রসায়নে নোবেল পেলেন তিন বিজ্ঞানী)

আরও পড়ুন

আরএনএ বিপ্লব

আবিষ্কারের পর থেকেই আরএনএকে ভাবা হয়েছে ডিএনএর ‘ছোট ভাই’-এর মতো। এক সূত্রক, সাধারণ এক বার্তাবাহক ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে আরএনএ জীবনের জন্য শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়; কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার সঠিক ধারণা এখনো যেন আমাদের নেই। জিনোমের ‘নন-কোডিং’ অংশের বেশির ভাগটাই দেখা যাচ্ছে ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় আরএনএ অণু তৈরি করে। এগুলো শুধু বার্তাবাহকের কাজ করে না, জিন নিয়ন্ত্রণসহ নানা ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।

এ বছর নোবেল দেওয়া হয়েছে মাইক্রোআরএনএ গবেষক মার্কিন দুই বিজ্ঞানীকে। ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুন। চোখ বা ফুসফুসের ক্যানসার, জন্মগত বধিরতা, কিডনির সমস্যাসহ বহু রোগ হতে পারে মাইক্রোআরএনএতে সমস্যা হলে। দেহের ভেতরে ও বাইরের পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কোষের ভেতরের কোন জিনটি কাজ করবে আর কোনটি করবে না, তা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। এসবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মাইক্রোআরএনএ। (জীববিজ্ঞানে নোবেল গবেষণার বিস্তারিত জানতে পড়ুন: মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার ও জিন গবেষণায় বিপ্লব)

এ বছর গবেষকেরা নতুন আরেকধরনের আরএনএ পেয়েছেন। আসলে, মানুষের মুখগহ্বর ও অন্ত্রে লুকিয়ে থাকা একধরনের নতুন অণুজীব আবিষ্কার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। এই অণুজীবের নাম দেওয়া হয়েছে অবেলিস্ক। গোলাকার আরএনএ অণু দিয়ে তৈরি এগুলো, নিজেরাই নিজেদের প্রোটিন অণু তৈরি করতে পারে। এই গবেষণা বিজ্ঞানীদের জন্য জীবনের নতুন এক অধ্যায় উন্মোচন করেছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি রিভিউয়ের জন্য নেচার ও সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়। (অবেলিস্ক নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন: মানব শরীরের অদ্ভুতুড়ে অণুজীব আবিষ্কার)

আরএনএর এসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে চলতি বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বলা হচ্ছে অবেলিস্ক আবিষ্কারসহ আরএনএবিষয়ক গবেষণাগুলোকে।

ফ্রুট ফ্লাই বা মাছির মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ মানচিত্র
ছবি: সায়েন্স ডট অর্গ

মস্তিষ্কের গভীরে

শরীর মস্তিষ্ককে চালায়, নাকি মস্তিষ্ক দেহকে চালায়? এতদিন বেশির ভাগ ইমিউনোলজিস্ট (দেহের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গবেষক) ভাবতেন, দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজে নিজেই কাজ করে। মস্তিষ্কের আলাদা করে নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এ বছর প্রথমবারের মতো গবেষকেরা একটি নিউরাল সার্কিট আবিষ্কার করেছেন। এটি ব্রেনস্টেমে রয়েছে। এটি দেহে ইনফ্ল্যামেটরি বা জ্বালাপোড়া হয়, এমন অণু শনাক্ত করে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে জানায় সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে, নাকি না করলেও হবে। এ থেকে দেহ আর মস্তিষ্কের সংযোগের ব্যাপারে আরও ভালো ধারণা হলো বিজ্ঞানীদের। তাঁরা ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছেন, আমাদের স্নায়ুগুলো মস্তিষ্ককে কীভাবে দেহের সঙ্গে যুক্ত করে ও প্রতিক্রিয়া দেখায়।

এ ছাড়া, একধরনের তরল রয়েছে—সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড। নাম শুনে মনে হয়, এটি শুধু মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ডে (সুষুষ্মাকাণ্ড) থাকে। নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, এটি সত্যি নয়। এই তরল দেহের বিভিন্ন অংশে থাকে। এতদিন ভাবা হতো, এর কাজ শুধু মস্তিষ্ক ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুগুলোকে রক্ষা করা, পুষ্টি যোগান দেওয়া ও পরিষ্কার করা। এখন দেখা যাচ্ছে, দেহের অনেক স্নায়ুর জন্যই এটি এসব কাজ করে।

এ ছাড়াও, মস্তিষ্ক নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করার জন্য ৫ হাজার ছবি জোড়া দিয়ে দিয়ে সবিস্তার ছবি তৈরি করা হয়েছে। এই ৫ হাজার ছবি তোলা হয়েছে মস্তিষ্কের মাত্র ১ ঘনমিলিমিটার অংশ থেকে। ছবি জোড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এভাবে তৈরি করা হয়েছে ৫৭ হাজার নিউরন ও ১৫০ মিলিয়ন সিন্যাপ্সের খুঁটিনাটিসহ সবিস্তার ছবি।

পাশাপাশি একটি ফ্রুট ফ্লাই বা মাছির মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ মানচিত্র তৈরি করা হয়েছে। এত সবিস্তার ও বড় পরিসরে মস্তিষ্কের মানচিত্র তৈরি এই প্রথম। এসব মিলে মস্তিষ্ক গবেষণায় এ বছর গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আশা করা যাচ্ছে, শিগগিরই মানুষ ও অন্য প্রাণীদের মস্তিষ্কের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা আরও বিস্তারিত জানতে পারবেন।

বাংলাদেশি দুই বিজ্ঞানীর নতুন মথ আবিষ্কার

নতুন একটি মথের নামকরণ করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মো. জহির রায়হান ও সায়েমা জাহান। আবিষ্কারের পর ৬ মাস গবেষণা করে তাঁরা নিশ্চিত হন, এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির মথ। তাঁরা এর নাম রেখেছেন ‘প্যারাক্সিনোয়াক্রিয়া স্পিনোসা’ (Paraxenoacria spinosa)। তাঁদের এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের জুট্যাক্সা জার্নালে। এ বছরের অক্টোবর মাসে ‘আ নিউ জেনাস অ্যান্ড স্পেসিস অব পেলিওপোডিডি হজেস, ১৯৭৪ (ইনসেকটা: লেপিডোপটেরা) ফ্রম সাউথ-এশিয়া’ শিরোনামের তাঁদের লেখা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

জহির রায়হান ও সায়েমা জাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখানেই দুজনের বন্ধুত্ব হয়। একসঙ্গে বিভিন্ন সময় মথের লার্ভা খুঁজেছেন। খুঁজতে খুঁজতেই পেয়ে যান নতুন একটি গণ বা জেনাসের নতুন প্রজাতির মথ। মাসখানেক আগে তাঁরা পরস্পরকে বিয়ে করেছেন।

সায়েমা জানান, এর আগেও তাঁরা নতুন প্রজাতির মথ আবিষ্কার করেছেন। গত বছর তাঁরা একটা মথের নামকরণ করেন Phragmataecia ishuqii। চলতি বছর জুলাইয়ে আরেকটা মথের নাম দেন Schistophleps kendricki। তবে এবারই প্রথম নতুন গনের মথ আবিষ্কার করলেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে তিনি বিজ্ঞানচিন্তাকে জানান, ‘নতুন গণের মথ আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা আমাদের এবারই প্রথম। এ জন্য আনন্দটাও বেশি।’

মথের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সন্তানের নাম রাখার সময় যেমন সুন্দর নাম এবং নামের অর্থ খোঁজেন, তেমনি মথের নামকরণেও অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়। অনেকে প্রিয় মানুষের নামে নাম রাখেন। আমরাও নিজেদের নামে, বিশেষ করে জহির চাইছিল আমার নামে মথটির নামকরণ করতে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তা করলে এই মথের বৈশিষ্ট্য নাম শুনে বোঝা যাবে না, আড়ালে পড়ে যাবে। তাই আমরা নিজেদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এর নাম রাখিনি।’ (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: বাংলাদেশি দুই বিজ্ঞানীর নতুন মথ আবিষ্কার)

বাংলাদেশে নতুন ৩ প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার

সম্প্রতি বাংলাদেশি গবেষকেরা তিনটি নতুন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার করেছেন। ফড়িংগুলো পাওয়া গেছে টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান, পাথরঘাটা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, চরকুকরি মুকরি ও সিলেট অঞ্চলের আন্তঃসীমানা এলাকার পাহাড়ি ছড়ায়। এগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে ফাইলোথেমিস এল্টোনি (Phyllothemis eltoni), ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি (Elattoneura campioni) ও অ্যানাক্স এফিপিগার (Anax ephippiger)। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ আশিকুর রহমান সমী। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: বাংলাদেশে নতুন তিন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার)

১০
হ্যাব্রোসেস্টাম স্বামীনাথন

দুই নতুন মাকড়সার সন্ধান

সম্প্রতি ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমঘাটের ঘন জঙ্গলে দুটি নতুন প্রজাতির মাকড়সা আবিষ্কার করেছেন বাঙালি বিজ্ঞানীরা। কর্ণাটকের মুকাম্বিকা অভয়ারণ্য এবং কেরালার এরনাকুলাম জেলা থেকে পাওয়া গেছে এ প্রজাতি দুটি। মাকড়সা দুটির নাম রাখা হয়েছে যথাক্রমে হ্যাব্রোসেস্টাম বেঞ্জামিন (Habrocestum benjamin) এবং হ্যাব্রোসেস্টাম স্বামীনাথন (Habrocestum swaminathan)। এগুলোর নামকরণ করা হয়েছে প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সুরেশ পি বেঞ্জামিন এবং সবুজ বিপ্লবের জনক এম এস স্বামীনাথনের নামে। এই মাকড়সাগুলো হ্যাম্ব্রোসেস্টাম সাইমন গণের মাকড়সা। ভারতের বিভিন্ন উপদ্বীপে পাওয়া এই মাকড়সাগুলো লাফ দিতে পটু। এই দুই প্রজাতির মাকড়সা গণটির মধ্যে আকার-আকৃতিতে সবচেয়ে বড়। ভারতের এরিঞ্জালাকুদার ক্রাইস্ট কলেজের (খ্রিস্ট কলেজ) গবেষকেরা এ মাকড়সা দুটি আবিষ্কার করেছেন। এ সম্পর্কিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের জুটাক্সা জার্নালে। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: নতুন দুটি মাকড়সা আবিষ্কার করেছেন বাঙালি বিজ্ঞানীরা)