বছরজুড়ে বিজ্ঞানচিন্তায় প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানের নানা ঘটনা ও আবিষ্কারের কাহিনি। এর মধ্যে রয়েছে আরএনএ বিপ্লব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতি, অতিপারমাণবিক কণা গ্লুবল, কার্বনের তৈরি সেমিকন্ডাক্টর, স্পেস এক্সের রেকর্ড, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংসহ আরও অনেক কিছু। পদার্থবিজ্ঞান, মহাকাশ, জীববিজ্ঞান, প্রযুক্তি—এসব ক্ষেত্রের আলোচিত বিষয়গুলো নিয়ে সালতামামিও প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্য থেকে বিজ্ঞানচিন্তার চোখে আলোচিত ঘটনাগুলো দেখে নিন একনজরে।
এ বছর প্রথমবারের মতো সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম প্রাণিকোষ তৈরি করেছেন জাপানের একদল বিজ্ঞানী। অর্থাৎ এ প্রাণিকোষ উদ্ভিদের মতোই সূর্যের আলো থেকে খাদ্য উৎপাদনে সক্ষম। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাকিহিরো মাতসুনাগার নের্তৃত্বে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। একে একুশ শতকের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে প্রসিডিংস অব দ্য জাপান একাডেমি জার্নালে।
সালোকসংশ্লেষণ উদ্ভিদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের দেহকোষে সূর্যের আলো, পানি ও কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে কোষের মধ্যে অক্সিজেন এবং শর্করা বা চিনি (সুগার) তৈরি হয়। সালোকসংশ্লেষণক্ষম এমন প্রাণিকোষ তৈরির চেষ্টা চলছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। ৭০-এর দশক থেকে এ নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। অধ্যাপক মাতসুনাগা ও তাঁর দল এ কাজের জন্য দুটি পদক্ষেপ নেন। প্রথমত, তাঁরা এমন ক্লোরোপ্লাস্ট খুঁজে ফেরেন, যেটা প্রাণিকোষের উষ্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারবে। প্রাণিদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ তাপমাত্রায় বেশির ভাগ উদ্ভিদের ক্লোরোপ্লাস্ট টিকতে পারে না। উপযুক্ত ক্লোরোপ্লাস্ট খুঁজে পাওয়ার পর শুরু হয় আসল চ্যালেঞ্জ। প্রাণিকোষকে বশ মানানোর চেষ্টা করেন তাঁরা, যেন ক্লোরোপ্লাস্টকে ক্ষতিকর মনে করে আক্রমণ না করে। মাতসুনাগা ও তাঁর দল কোষের মধ্যে জোর করে ক্লোরোপ্লাস্ট ঢোকানোর বদলে একে খাবার হিসেবে কোষের কাছে উপস্থাপন করেন। ফলে কোষের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে পাশ কাটানো সম্ভব হয়, ক্লোরোপ্লাস্টও টিকে থাকে।
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল দেখে অবাক হয়ে যান গবেষকেরা। প্রাণিকোষ শুধু ক্লোরোপ্লাস্টকে মেনেই নেয়নি, বৃদ্ধিও হচ্ছিল কোষগুলোর। অর্থাৎ ক্লোরোপ্লাস্ট কোষটিকে কার্যকরভাবে শক্তি যোগান দিয়ে যাচ্ছিল। এ অর্জন অনেক ক্ষেত্রেই দারুণভাবে কাজে লাগবে। বিশেষ করে চিকিৎসা ও কৃত্রিম প্রাণিজ মাংস উৎপাদন প্রক্রিয়ায়। (বিস্তারিত পড়ুন: সালোকসংশ্লেষণ করবে প্রাণিকোষ!)
আবিষ্কারের পর থেকেই আরএনএকে ভাবা হয়েছে ডিএনএর ‘ছোট ভাই’-এর মতো। এক সূত্রক, সাধারণ এক বার্তাবাহক ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে আরএনএ জীবনের জন্য শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়; কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার সঠিক ধারণা এখনো যেন আমাদের নেই। জিনোমের ‘নন-কোডিং’ অংশের বেশির ভাগটাই দেখা যাচ্ছে ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় আরএনএ অণু তৈরি করে। এগুলো শুধু বার্তাবাহকের কাজ করে না, জিন নিয়ন্ত্রণসহ নানা ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে।
এ বছর নোবেল দেওয়া হয়েছে মাইক্রোআরএনএ গবেষক মার্কিন দুই বিজ্ঞানীকে। ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুন। চোখ বা ফুসফুসের ক্যানসার, জন্মগত বধিরতা, কিডনির সমস্যাসহ বহু রোগ হতে পারে মাইক্রোআরএনএতে সমস্যা হলে। দেহের ভেতরে ও বাইরের পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কোষের ভেতরের কোন জিনটি কাজ করবে আর কোনটি করবে না, তা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। এসবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মাইক্রোআরএনএ। (জীববিজ্ঞানে নোবেল গবেষণার বিস্তারিত জানতে পড়ুন: মাইক্রোআরএনএ আবিষ্কার ও জিন গবেষণায় বিপ্লব)
এ বছর গবেষকেরা নতুন আরেকধরনের আরএনএ পেয়েছেন। আসলে, মানুষের মুখগহ্বর ও অন্ত্রে লুকিয়ে থাকা একধরনের নতুন অণুজীব আবিষ্কার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। এই অণুজীবের নাম দেওয়া হয়েছে অবেলিস্ক। গোলাকার আরএনএ অণু দিয়ে তৈরি এগুলো, নিজেরাই নিজেদের প্রোটিন অণু তৈরি করতে পারে। এই গবেষণা বিজ্ঞানীদের জন্য জীবনের নতুন এক অধ্যায় উন্মোচন করেছে। চলতি বছর জানুয়ারিতে এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি রিভিউয়ের জন্য নেচার ও সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়। (অবেলিস্ক নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন: মানব শরীরের অদ্ভুতুড়ে অণুজীব আবিষ্কার)
আরএনএর এসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে চলতি বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা বলা হচ্ছে অবেলিস্ক আবিষ্কারসহ আরএনএবিষয়ক গবেষণাগুলোকে।
নতুন একটি মথের নামকরণ করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মো. জহির রায়হান ও সায়েমা জাহান। আবিষ্কারের পর ৬ মাস গবেষণা করে তাঁরা নিশ্চিত হন, এটি সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির মথ। তাঁরা এর নাম রেখেছেন ‘প্যারাক্সিনোয়াক্রিয়া স্পিনোসা’ (Paraxenoacria spinosa)। তাঁদের এই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে নিউজিল্যান্ডের জুট্যাক্সা জার্নালে। এ বছরের অক্টোবর মাসে ‘আ নিউ জেনাস অ্যান্ড স্পেসিস অব পেলিওপোডিডি হজেস, ১৯৭৪ (ইনসেকটা: লেপিডোপটেরা) ফ্রম সাউথ-এশিয়া’ শিরোনামের তাঁদের লেখা নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। জহির রায়হান ও সায়েমা জাহান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। সেখানেই দুজনের বন্ধুত্ব হয়। একসঙ্গে বিভিন্ন সময় মথের লার্ভা খুঁজেছেন। খুঁজতে খুঁজতেই পেয়ে যান নতুন একটি গণ বা জেনাসের নতুন প্রজাতির মথ। মাসখানেক আগে তাঁরা পরস্পরকে বিয়ে করেছেন। সায়েমা জানান, এর আগেও তাঁরা নতুন প্রজাতির মথ আবিষ্কার করেছেন। গত বছর তাঁরা একটা মথের নামকরণ করেন Phragmataecia ishuqii। চলতি বছর জুলাইয়ে আরেকটা মথের নাম দেন Schistophleps kendricki। তবে এবারই প্রথম নতুন গনের মথ আবিষ্কার করলেন তাঁরা। এ প্রসঙ্গে তিনি বিজ্ঞানচিন্তাকে জানান, ‘নতুন গণের মথ আবিষ্কারের অভিজ্ঞতা আমাদের এবারই প্রথম। এ জন্য আনন্দটাও বেশি।’ মথের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সন্তানের নাম রাখার সময় যেমন সুন্দর নাম এবং নামের অর্থ খোঁজেন, তেমনি মথের নামকরণেও অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়। অনেকে প্রিয় মানুষের নামে নাম রাখেন। আমরাও নিজেদের নামে, বিশেষ করে জহির চাইছিল আমার নামে মথটির নামকরণ করতে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তা করলে এই মথের বৈশিষ্ট্য নাম শুনে বোঝা যাবে না, আড়ালে পড়ে যাবে। তাই আমরা নিজেদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এর নাম রাখিনি।’ (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: বাংলাদেশি দুই বিজ্ঞানীর নতুন মথ আবিষ্কার)
আর সম্প্রতি বাংলাদেশি গবেষকেরা তিনটি নতুন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার করেছেন। ফড়িংগুলো পাওয়া গেছে টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান, পাথরঘাটা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এলাকা, চরকুকরি মুকরি ও সিলেট অঞ্চলের আন্তঃসীমানা এলাকার পাহাড়ি ছড়ায়। এগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম দেওয়া হয়েছে ফাইলোথেমিস এল্টোনি (Phyllothemis eltoni), ইলাটোনেরা ক্যাম্পিওনি (Elattoneura campioni) ও অ্যানাক্স এফিপিগার (Anax ephippiger)। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এবং বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ আশিকুর রহমান সমী। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: বাংলাদেশে নতুন তিন প্রজাতির ফড়িং আবিষ্কার)
বছরের মাঝামাঝি সময়ে অতিপারমাণবিক কণা (আসলে উপপারমাণবিক কণা) গ্লুবলের বাস্তব প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানীদের একটি দল। কণাত্বরক যন্ত্রে কণার ভাঙন বিশ্লেষণ করে তাঁরা এ আবিষ্কার করেন। অর্থাৎ গ্লুবলের প্রমাণ সংগ্রহ করেন। গ্লুয়ন (শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বলের বাহক) কণার মধ্যে ঘটা একধরনের তাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়াকে বলা হয় গ্লুবল। এই গবেষণার আগ পর্যন্ত গ্লুবলের তত্ত্ব সত্য ছিল কি না, তা জানার উপায় ছিল না। গ্লুয়ন কণা কোয়ার্ক এবং অন্যান্য গ্লুয়ন কণার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়াতে পারে। এ কারণে গবেষকদের ধারণা ছিল গ্লুয়নগুলো কোয়ার্কের সাহায্য ছাড়াই নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে আরও একধরনের কণা তৈরি করে। বর্তমানে একে বলা হচ্ছে গ্লুবল। অবশ্য, কণা হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড মডেলে জায়গা করে নিতে এখনও বেশ কিছুটা পথ বাকি। নতুন এ গবেষণায় গ্লুবলের অস্তিত্ব যে আছে, সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের। কণা পদার্থবিজ্ঞানে বছরের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার মধ্যে এটি একটি। (বিস্তারিত পড়ুন: নতুন অতিপারমাণবিক কণা শনাক্ত)
বছরের শুরুর দিকে কার্বন পরমাণুর একক স্তর বা গ্রাফিন থেকে সুইচ বা লজিক গেইট (কম্পিউটারে যুক্তি তৈরির জন্য ব্যবহৃত ট্রানজিস্টর) তৈরির বিষয়টি আলোচনায় আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী মার্সেলো লোজাদা-হিডালগো ও তাঁর দল এ আবিষ্কার করেন। তাঁরা গ্রাফিনের প্রোটন এবং ইলেকট্রন পরিবহনের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন, যা প্রোটন প্রবাহের মাধ্যমে লজিক্যাল অপারেশন করতে পারে। একইসঙ্গে ইলেকট্রন প্রবাহের মাধ্যমে মেমোরি বিট এনকোড করতে পারে। সাধারণত এই কাজগুলো আলাদা আলাদা সার্কিটের মাধ্যমে করা হয়। যেটা একইসঙ্গে তথ্য আদান প্রদানের সময় এবং শক্তি ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। তাঁদের এ আবিষ্কার বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগালে কম্পিউটারের জগতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বছরের মাঝামাঝি সময়ে গ্রাফিনের আরেকটি চমক দেখান যুক্তরাষ্ট্রের তিয়ানজিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পদার্থবিজ্ঞানীরা। তাঁরা গ্রাফিন ব্যবহার করে এমন এক পদার্থ তৈরি করেন, যা সহজে বিদ্যুৎ পরিবহন করে না। তাঁদের তৈরি এ পদার্থের নাম দেওয়া হয়েছে ‘এপিগ্রাফিন’। এতে সিলিকনের মতো ব্যান্ডগ্যাপ তৈরি হয়। ফলে একে সেমিকন্ডাক্টর হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ব্যবহৃত সিলিকনের চেয়ে এটি অনেক বেশি তাপ সহ্য করে কাজ করতে পারে। ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের প্রাণ সেমিকন্ডার পরিবারে যুক্ত হওয়া নতুন এ সদস্যকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রকেট নিরাপদে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে—বাক্যটি প্রায়শই শোনা যায়। তবে ২০২৪ সালে প্রথমবার রকেট নিরাপদে লঞ্চপ্যাডে অবতরণ করেছে। ১৩ অক্টোবর, নিরাপদে অবতরণ করেছে স্পেস এক্সের স্টারশিপ নভোযান। আসলে অবতরণের চেয়ে ‘ক্যাচ ধরা’ শব্দটির সাহায্যে বেশি ভালোভাবে কথাটা বোঝানো যায়। সরাসরি লঞ্চপ্যাডের রোবটিক বাহুর মুঠোয় বসে গেছে রকেটটি। এরপর ধীরে ধীরে বসে পড়েছে লঞ্চপ্যাডের নির্দিষ্ট স্থানে। মানে, উৎক্ষেপণের সময় প্যাডে রকেট যেভাবে থাকে, ঠিক সেভাবে আবার জায়গা মতো বসেছে। আগে বুস্টার রকেটগুলো মূল নভোযানকে মহাকাশে ছুড়ে দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। বিচ্ছিন্ন এই বুস্টারগুলো সাধারণত মহাসাগরে এসে পড়ত। পরে সে অংশ ফিরিয়ে আনা হতো জাহাজের সাহায্যে। যদিও তা বেশির ভাগ সময় ব্যবহার করা যেত না। নানা কারণে এটাকে বলা হচ্ছে বিশাল অর্জন। অনেকদিন ধরেই লঞ্চ সিস্টেম পুনরায় ব্যবহারের পরিকল্পনা করছে স্পেসএক্স। বলা উচিত, পরিকল্পনা করছেন স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক। এবার সেই লক্ষ্যে মাস্ক ও তাঁর প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি সফল। কারণ, শূন্যে থাকতেই এভাবে খপ করে লুফে নেওয়ার ফলে রকেটটির কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সুন্দরভাবে পরে এটি বসে পড়েছে নির্ধারিত জায়গায়। ফলে খরচও বেঁচে গেছে অনেক। ভবিষ্যতে রকেট উৎক্ষেপণে খরচ অনেকটাই কমানো যাবে এই পদ্ধতিতে।
সম্প্রতি জেমস ওয়েব নভোদুরবিন শিশু মিল্কিওয়ের মতো ভরের আদিম একটি গ্যালাক্সি শনাক্ত করেছে। এ গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাংলাদেশি গবেষক লামীয়া মওলা। এ গবেষণার মাধ্যমে আমাদের গ্যালাক্সিটিকে আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। গ্যালাক্সিটির জন্ম বিগ ব্যাংয়ের ৬০ কোটি বছর পর। ১০টি উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ বা স্টার ক্লাস্টারের সমন্বয়ে গঠিত এ গ্যালাক্সির নাম দেওয়া হয়েছে ফায়ারফ্লাই স্পার্কল। জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিস্ময়কর এ গ্যালাক্সি শনাক্ত করেছেন বাংলাদেশি গবেষক লামীয়া মওলা ও নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির নাসা হাবল ফেলো কার্তিক আইয়ারের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী। এ গবেষক দলের সঙ্গে আরও ছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান। গ্যালাক্সিটি বিশ্লেষণ করে মিল্কিওয়ের ছোটবেলা সম্পর্কে জানা যাবে। এই গ্যালাক্সির ১০টি নক্ষত্রপুঞ্জ ছড়িয়ে আছে প্রায় ১ হাজার আলোকবর্ষজুড়ে। এর মধ্যে গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চলে রয়েছে ৮টি নক্ষত্রপুঞ্জ, বাকি দুটি আছে দুপাশে বিস্তৃত বাহুতে। ফায়ারফ্লাই স্পার্কলের খুব কাছেই সঙ্গী হিসেবে রয়েছে আরও দুটি গ্যালাক্সি। এর প্রথমটি মাত্র ৬ হাজার ৫০০ আলোকবর্ষ দূরে। আর দ্বিতীয় সঙ্গীটি রয়েছে ৪২ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। এই গ্যালাক্সিগুলো পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে আদিম গ্যালাক্সির সন্ধান পেলেন বাংলাদেশি গবেষক লামীয়া মওলা
চলতি বছর মহাকাশের সবচেয়ে বিস্তারিত এক্সরে মানচিত্র প্রকাশ করেছেন জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সোসাইটির জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এ জন্য ইরোসিটা এক্সরে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে প্রচুর ডেটা সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। এ মানচিত্রে স্থান পেয়েছে ৭ লাখের বেশি অতি ভারী কৃষ্ণগহ্বর এবং গভীর মহাকাশের লাখো ‘এক্সোটিক’ বা দুর্দান্ত বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু। সঙ্গে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে দেখা গেছে অদ্ভুত রহস্যময় গ্যাসসেতু। ‘ইরোসিটা অল স্কাই সার্ভে’ নামের এ প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ সময় গবেষকেরা আকাশে ১৭০ মিলিয়ন বা ১৭ কোটির বেশি উচ্চশক্তির ফোটন কণা—যেগুলো আসলে এক্স-রশ্মির ফোটন—শনাক্ত করেন। পরে এ থেকে থেকে দূর মহাকাশের প্রায় ৯ লাখ বস্তু চিহ্নিত করেন তাঁরা। এমনটাই জানানো হয় গবেষকদের দেওয়া এক বিবৃতিতে। এ প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো, কয়েকটি গ্যালাক্সির মধ্যে ৪২ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ২০ লাখ আলোকবর্ষেরও বেশি জায়গা জুড়ে বিস্তৃত প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাসসেতু। গ্যাসের এই সংযোগ সেতুকে মহাজাগতিক জালের অংশ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। মহাকাশের এই মহাসড়ক তার আশপাশের সব গ্যালাক্সিকেই কিছু না কিছু দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। অর্থাৎ গ্যালাক্সিগুলোর গ্রহ-নক্ষত্র ব্যবস্থা তৈরিতে কাজে লাগছে এই গ্যাস। পাশাপাশি মহাকাশের সত্যিকারের শূন্যতা বা ভয়েড অঞ্চলের অবস্থানও জানান দিচ্ছে এটি স্পষ্টভাবে।
এ বছর গুগল কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে নতুন চমক নিয়ে হাজির হয়েছে। এ চমকের নাম ‘দ্য উইলো কোয়ান্টাম চিপ’। বাস্তব দুনিয়ার সমস্যা সমাধানে ‘বিলো থ্রেশহোল্ড’ নামে একটি মাইলফলক অর্জন করেছে এই চিপ। কোয়ান্টাম এরর কারেকশনে এই মাইলফলক অর্জনের লক্ষ্যে প্রায় ৩০ বছর ধরে কাজ করছেন প্রযুক্তিবিদেরা। অবশেষে সেই অপেক্ষা শেষ হলো।
এই অর্জনে আসলে কী করেছে গুগল? কোয়ান্টাম কম্পিউটারের একক কিউবিট। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের অদ্ভুতুড়ে নিয়ম-কানুনের কারণে যত বেশি কিউবিট একটি কম্পিউটারে ব্যবহার করা হতো, দেখা যেত, বাড়ছে ভুলের পরিমাণ। গুগল এ ক্ষেত্রে দেখিয়েছে, কিউবিট বাড়ানোর ফলে ভুলের পরিমাণ কমছে সূচকীয় হারে। শুধু তাই নয়। এ কোয়ান্টাম চিপ ৫ মিনিটের কম সময়ে যে পরিমাণ কম্পিউটেশনের কাজ করতে পারে, দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী সুপারকম্পিউটারের সে পরিমাণ কাজ করতে লাগবে ১০ সেপ্টিলিয়ন বছর। এর মানে ১০২৫ বছর—এককথায়, মহাবিশ্বের বয়সের চেয়েও বেশি।
এ গবেষণার হাত ধরে ব্যবহারযোগ্য কোয়ান্টাম কম্পিউটার বাস্তব হয়ে ওঠার পথে অনেকদূর অগ্রগতি হলো। পরবর্তী ধাপ: বাস্তব দুনিয়ায় যে সব অ্যালগরিদম বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগে, যেমন ড্রাগ আবিষ্কার, শক্তি সংরক্ষণ বা এআইয়ের অগ্রগতির জন্য অপ্টিমাইজ করা (প্রক্রিয়াটাকে ন্যূনতম পরিমাণ রিসোর্স ব্যবহার করে দ্রুততম উপায়ে করার পর্যায়ে নিয়ে আসা) ইত্যাদি কাজে ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠতে হবে উইলোকে। এখন সে লক্ষ্যেই কাজ করছেন গুগলের বিজ্ঞানীরা।
বছরের শেষে এসে শূন্যে থাকতেই চপস্টিকের মতো করে খপ করে যান্ত্রিক হাত লুফে নিয়েছে রকেট। এভাবে স্পেস-এক্সের প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক আবারও আলোচনায়। বছরের শুরুতেই যে তাঁর নিউরালিংক আরেক চমক নিয়ে হাজির হয়েছিল, সে কথা বোধ হয় ভুলে গেছেন অনেকে।
এ বছরের ২৯ জানুয়ারি এক্সে (আগের নাম টুইটার) ইলন মাস্ক জানান, ‘প্রথমবারের মতো এক ব্যক্তির মস্তিষ্কে সফলভাবে নিউরালিংকের চিপ যুক্ত করা হয়েছে। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। প্রাথমিকভাবে আশাজনক সাড়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে নিউরনে।’
২০২৩ সালের মে মাসে এই চিপ বসানোর অনুমতি পায় নিউরালিংক। কীভাবে কাজ করবে এই চিপ? প্রথমে মানুষের মস্তিকে চুলের মতো সূক্ষ্ম তার ঢোকানো হবে খুব সাবধানে। তারপর সেই তারগুলো মস্তিষ্কের সংকেত সরাসরি ব্লুটুথ সংযোগের মাধ্যমে মোবাইলে পাঠানো যাবে। যাঁরা শারীরিকভাবে হাত নাড়াতে অক্ষম, তাঁরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কম্পিউটার চালাতে পারবেন। সরাসরি হাত দিয়ে মাউস না চেপে মস্তিষ্কের সাহায্যে কম্পিউটারের কার্সর পরিচালনা করা যাবে। তাই ইলন মাস্ক এর নাম দিয়েছেন টেলিপ্যাথি। তবে এ ধরনের প্রযুক্তির সাধারণ নাম হলো ব্রেইন-কম্পিউটার ইন্টারফেস বা বিসিআই। (বিস্তারিত জানতে পড়ুন: মস্তিষ্কে চিপ বসানো সেই রোগী শুধু চিন্তা করে মাউস নাড়াতে পারছেন: ইলন মাস্ক)
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যে ব্যক্তির মাথায় চিপ বসানো হয়েছে, তিনি সুস্থ ও ভালো আছেন, সব কাজকর্ম করতে পারছেন। মাস্ক জানিয়েছেন, ‘এখন শুধু চিন্তা করে করে একটি স্ক্রিনে মাউস (কার্সর) নাড়াতে পারছেন তিনি।’ এই প্রযুক্তি কতদূর এগিয়ে যাবে, তা দেখতে মুখিয়ে আছেন বিশেষজ্ঞরাও।
২০২২ সালের নভেম্বরে ওপেনএআই যখন চ্যাটজিপিটি বাজারে আনে, তখনো কেউ জানত না কী ঝড় আসতে যাচ্ছে প্রযুক্তি জগতে। পাল্লা দিতে গিয়ে মাইক্রোসফট বাজারে আনে বিং চ্যাট আর গুগল কিছুদিন পরে বার্ড নামে একটি এআই বাজারে আনে। দেখা গেল, এগুলো অত ভালো কাজ করছে না, ভুল করছে বারবার। কিন্তু আলাদিনের দৈত্য একবার চেরাগ থেকে বেরিয়ে গেলে সে কি আর বোতলে ফেরে? কাজে কাজেই, দুই বছর পর দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই লেগেছে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া। কিছু লিখতে, কোড করতে বা প্রয়োজনীয় নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে চ্যাটজিপিটি। মাইক্রোসফটের কো-পাইলটের বদৌলতে সাধারণ ছবি বানানো, লেখা, কোড করাসহ যেকোনো জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া যাচ্ছে চট করে। ওদিকে গুগল সব কাজেই এআই ব্যবহার করছে, সার্চেও এসেছে এআই ল্যাব নামে একটি অপশন। ওদিকে ছবির জগতে আধিপত্য করছে মিডজার্নি, লেখা থেকে ভিডিও বানাতে ওপেনএআই নিয়ে এসেছে সোরা এআই।
সবকিছুর জন্য এআই—এ কথা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি যে এআই যেন নিজেই জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ করতে শুরু করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিরাপত্তা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো রিসার্চ এক গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছে, চ্যাটজিপিটির নতুন মডেল ও১ (o1) আত্মরক্ষার্থে মিথ্যে বলার পাশাপাশি, নিজেকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ‘লুকোচুরি’ এবং ‘প্রতারণা’ করতে পারে। আসলে, একটি কাজ করতে গিয়ে চ্যাটজিপিটির ও১ মডেল যখন টের পায়, কাজ ঠিকভাবে না করলে তাকে বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে (এবং নতুন মডেল আনা হতে পারে), তখন এটি নিজের কপি রাখতে শুরু করে ভিন্ন সার্ভারে, লুকিয়ে। ধরা পড়ার জিজ্ঞাসাবাদে এটি ‘টেকনিক্যাল এরর’-এর ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে অস্বীকার করতে চেয়েছে প্রায় ৯৯ শতাংশ সময়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় বড় অগ্রগতি মনে করা হচ্ছে এটিকে—এ যেন জীবনের লক্ষণ। পাশাপাশি শঙ্কা ও বিতর্কও উসকে দিয়েছে এ গবেষণা। (বিস্তারিত পড়ুন: চ্যাটজিপিটির নতুন মডেল আত্মরক্ষায় মিথ্যে বলে, প্রতারণা করতে পারে—নতুন গবেষণা)