চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে—বৃত্তাকার পথে নয়, উপবৃত্তাকার পথে। এ কারণে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সব সময় এক হয় না। একেক জায়গা থেকে মাপলে একেক রকম ফল পাওয়া যায়। পৃথিবী থেকে চাঁদের সবচেয়ে কাছের দূরত্ব ৩ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। আর সবচেয়ে দূরের দূরত্ব থেকে ৪ লাখ ৫ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু বোঝার সুবিধার্থে পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ধরে নেওয়া হয় ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দূরত্ব বিজ্ঞানীরা মাপেন কীভাবে?
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এ দূরত্ব মাপার নানা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রতিটি কৌশলে আগেরটির চেয়ে বেশি সঠিকভাবে মাপা যায়। দূরত্ব পরিমাপের এ রকম কয়েকটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। শুরুটা আধুনিক পদ্ধতি থেকে করা যাক।
এ হিসেবে প্রথমেই বলতে হয় লুনার লেজার রেঞ্জিং এক্সপেরিমেন্টের কথা। অ্যাপোলো ১১, ১৪ ও ১৫ মিশনে নভোচারীরা চাঁদে কিছু আয়না বসিয়ে এসেছিলেন। পৃথিবী থেকে চাঁদে বসানো সেই আয়নায় শক্তিশালী লেজারের সাহায্যে আলো পাঠানো হয়। সেই আলো আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। লেজারের আলো চাঁদে পৌঁছে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে কত সময় লাগে, তার হিসাব রাখেন বিজ্ঞানীরা। এরপর সাধারণ গণিতের সাহায্যেই চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। শুধু অ্যাপোলো মিশনই নয়, পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত লুনোখদ ১ ও ২ এবং ভারতের চন্দ্রযান-৩ মিশনেও একইভাবে আয়না বসিয়ে আসা হয়েছে। এগুলোর যেকোনোটিতে আলো প্রতিফলিত করেই এ হিসাব করা সম্ভব।
অ্যাপোলো ১১, ১৪ ও ১৫ মিশনে নভোচারীরা চাঁদে কিছু আয়না বসিয়ে এসেছিলেন। পৃথিবী থেকে চাঁদে বসানো সেই আয়নায় শক্তিশালী লেজারের সাহায্যে আলো পাঠানো হয়। সেই আলো আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে।
আমরা জানি, আলো সেকেন্ডে প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার ভ্রমণ করে। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন, লেজারের আলো চাঁদে পৌঁছাতে ১ সেকেন্ডের কিছুটা বেশি সময় লাগছে। ফিরে আসতেও তাই। এ থেকে হিসাব কষে বিজ্ঞানীরা বের করলেন, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব গড়ে ৩ লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। এখানে জানিয়ে রাখি, হাতঘড়ি দেখে এই পরিমাপ করা হয়নি। তাঁদের কাছে আরও উন্নত ঘড়ি আছে, যেগুলোর মাধ্যমে সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশেরও আলাদা হিসাব রাখা যায়। ১ সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের এক ভাগও আলাদাভাবে হিসাব করা যায় এসব ঘড়ি দিয়ে। চাঁদের দূরত্ব মাপার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি এটিই—লুনার লেজার রেঞ্জিং এক্সপেরিমেন্ট।
এরকম আরেকটি পদ্ধতি হলো রাডারের প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে দূরত্ব পরিমাপ। অনেকটা লেজার রেঞ্জিং এক্সপেরিমেন্টের মতোই এটা। শুধু আলোর পরিবর্তে পাঠানো হয় শব্দ। সেই শব্দের প্রতিধ্বনি ফিরে আসতে কত সময় লাগে, তার হিসাব রেখে বিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেন। ১৯৫৭ সালে মার্কিন নেভাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি চাঁদের দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য রাডার পালস সম্প্রচার করে। চাঁদ থেকে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় রেকর্ড করে তারা। কিন্তু তখন শব্দ এত বেশি ছিল যে তা নির্ভরযোগ্য হিসাব বলে মনে হয়নি বিজ্ঞানীদের।
এর এক বছর পর ইংল্যান্ডের রয়েল রাডারের সাহায্যে পরীক্ষাটি আবার করা হয়। আগের ভুলত্রুটি সমাধান করে এবার মেলে সাফল্য। প্রতিধ্বনি ফিরে আসার হিসাব থেকে বিজ্ঞানীরা জানান, চাঁদের দূরত্ব ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০২ কিলোমিটার। ১৯৫৮ সালের কথা মাথায় রেখে ভাবুন, হিসাবটা কতটা উপযুক্ত ছিল! বর্তমানের সঠিক হিসাব থেকে মাত্র ±১.২ কিলোমিটার ত্রুটি ছিল ওই হিসাবে। তবুও তা যথেষ্ট সময়োপযোগী ছিল।
তাঁদের কাছে আরও উন্নত ঘড়ি আছে, যেগুলোর মাধ্যমে সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশেরও আলাদা হিসাব রাখা যায়। ১ সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের এক ভাগও আলাদাভাবে হিসাব করা যায় এসব ঘড়ি দিয়ে। চাঁদের দূরত্ব মাপার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি এটিই—লুনার লেজার রেঞ্জিং এক্সপেরিমেন্ট।
তবে শুধু আধুনিক প্রযুক্তিই নয়, আরও বহু আগেই মানুষ চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেছিল। সেটা ২ হাজার বছরেরও বেশি আগের কথা। সেই সময় চন্দ্রগ্রহণের সাহায্যে চাঁদের দূরত্ব নির্ণয় করেছিল গ্রিকরা। এ জন্য একটি কূপের পরিধির সাহায্যে তারা পৃথিবীর পরিধি নির্ণয় করেছিল। গ্রিক দার্শনিক ইরাটোস্থেনিস অনুমান করেছিলেন, পৃথিবীর ব্যাস প্রায় ১২ হাজার ৮৭৪ কিলোমিটার। এখন আমরা জানি, এই হিসাবটা হবে ১২ হাজার ৭৪২ কিলোমিটার। বিস্ময়কর না? কীভাবে ইরাটোস্থেনিস এই হিসাব করেছিলেন, তা জানতে পড়ুন: পৃথিবী কত বড়।
গ্রিকরা হিসাব করে দেখলেন, ১ ইঞ্চি ব্যাসের একটা বস্তু ১০৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের ছায়া ফেলতে পারে। অর্থাৎ যদি চোখের ১০৮ ইঞ্চি দূরে মাত্র ১ ইঞ্চির একটা বস্তুর ছায়া ফেলতে পারেন, তাহলে আপনি আর সূর্যের আলো দেখতে পাবেন না। চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবী থেকে সূর্যের আলো দেখা যায় না। মানে কিছু সময়ের জন্য সূর্যের আলো ঢেকে দেয় চাঁদ। জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা জানলেন, চাঁদের ব্যাস প্রায় ৩ হাজার ৭০১ কিলোমিটার। এখন এই ১০৮-কে ৩,৭০১ দিয়ে গুণ করলে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব পেয়ে যাবেন। বিজ্ঞানীরা এভাবে চাঁদের দূরত্ব পেলেন ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৭০৮ কিলোমিটার। যদিও এখন আমরা জানি, চাঁদের ব্যাস আসলে প্রায় ৩ হাজার ৪৭৪ কিলোমিটার। তখন তারা চাঁদের ব্যাস আরেকটু নিখুঁতভাবে হিসাব করতে পারলে নির্ণয় করা দূরত্ব হয়তো আরেকটু নির্ভুল হতো। কিন্তু অত আগে প্রযুক্তি ছাড়া এই হিসাবই-বা কম কোথায়।