মহাজাগতিক শহরের ফাঁকে, দূর মফস্বলে

মহাবিশ্বটা কেমন?

একটু থেমে ভাবুন।

সাধারণত বইপত্র পড়ে আমাদের মাথায় মহাবিশ্বের একটা ছবি তৈরি হয়। পৃথিবী ছাড়িয়ে, মহাশূন্যের নিঃসীম শূন্যতার মাঝে ভেসে বেড়ানো কিছু কাঠামো মস্তিষ্কে উঁকি দিয়ে যায়। একদম সহজ করে বললে, ছবিটা হয়তো এমন—আমরা রয়েছি পৃথিবীর ওপরে। আমাদের চারপাশে বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে বেরোলে—হাবল বা জেমস ওয়েব নভোদুরবিনের মতো শক্তিশালী একটা চশমা চোখে দিয়ে বহুদূরে তাকালে—আমাদের চোখে পড়বে না কোনো দিগন্ত। বরং দেখতে পাব অন্ধকারের মাঝে ভেসে বেড়ানো একদল বলের মতো গঠন, আর বহুদূরে প্রচণ্ড উজ্জ্বল এক অগ্নিগোলক। ওই গোলকটি সূর্য। তাকে ঘিরে বলের মতো গঠনগুলোর কোনোটি গ্রহ, কোনোটি উপগ্রহ। আর এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ানো কিছু কাঠামোর দিকে চোখ পড়বে আমাদের। এদের কোনোটি গ্রহাণু, কোনোটি ধূমকেতু, কিছু বামন গ্রহ ইত্যাদি। সব কটিরই গতিপথে আসলে ছন্দ আছে, তাল আছে—হয়তো প্রথম দেখায় তা আমাদের চোখে নাও পড়তে পারে।

সৌরজগতের মতো হাজারো নক্ষত্রমণ্ডল রয়েছে একেকটি গ্যালাক্সিতে। এরকম একটি গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ে। একটু কাব্য করে বাংলায় যাকে ‘দুধসায়র’ হয়তো বলাই যায়। যদিও একদম সঠিক বাংলা এটা নয়। বিজ্ঞানমনস্ক কেউ কেউ হয়তো তাই মৃদু আপত্তি জানাতেই পারেন। তা হোক। পৃথিবী থেকে তো আসলে তা-ই মনে হয় মিল্কিওয়েকে—দুধের নহর। নামটিও সেরকম। সূর্য এর নিতান্ত সাধারণ এক তারা। এই মিল্কিওয়ের মতো আরও কত কত গ্যালাক্সি—ছায়াপথ; আঁচলে তাদের বিছানো হাজারো নক্ষত্রমণ্ডল। এই গ্যালাকটিক কাঠামোর সীমা পেরিয়ে—মানে, গ্যালাক্সিগুলোর বাইরে দাঁড়িয়ে, বা ভেসে ভেসে যদি দেখি, দেখব কয়েকটি করে গ্যালাক্সি একসঙ্গে আছে। গ্যালাক্সির এরকম ঝাঁককে বলা হয় ক্লাস্টার—ঠিক যেন নেকড়ের ‘প্যাক’। এরকম ক্লাস্টারদেরও দল আছে—সুপারক্লাস্টার।

কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এসব গ্যালাক্সির ফাঁকে ফাঁকে কী আছে? ধরুন, মিল্কিওয়ে একটা বড় শহর। তার পাশের বড় শহরটির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। জুম আউট করে মানচিত্র দেখলে তো এরকম শহরগুলোই দেখা যায়।
আরও পড়ুন
মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি

মহাবিশ্বের এমনই একটা ছবি—তাতে মাথা তুলে আছে এই গ্যালাক্সিরা। এই ছবিই ভেসে ওঠে আমাদের করোটির ভেতরে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এসব গ্যালাক্সির ফাঁকে ফাঁকে কী আছে? ধরুন, মিল্কিওয়ে একটা বড় শহর। তার পাশের বড় শহরটির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। জুম আউট করে মানচিত্র দেখলে তো এরকম শহরগুলোই দেখা যায়। মাঝের জায়গাটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় সহজেই। মিল্কিওয়ে ও অ্যান্ড্রোমিডার মাঝে কতটা জায়গা? ২.৫ মিলিয়ন, মানে ২৫ লাখ আলোকবর্ষ। মিল্কিওয়ের প্রান্তসীমা থেকে ছুট দিল আলোর একটি কণা। সেই কণাটি ২৫ লাখ বছর ধরে ছুটলে তবেই গিয়ে পৌঁছাবে অ্যান্ড্রোমিডায়। অথচ সৌরজগতের কেন্দ্র—সূর্য থেকে ছুট দিয়ে মাত্র সাড়ে ৮ মিনিটে পৃথিবীতে পৌঁছে যেতে পারে আলো। বুঝতে পারছেন, কী বিশাল দূরত্ব! কী আছে এখানে?

হয়তো ভাবছেন, শুধুই শূন্যতা। কিংবা ভাবতে পারেন, কিছু সামান্য পদার্থ হয়তো ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ে, প্রথম যখন জানতে পারি—গ্যালাক্সিগুলো আসলে কেবলই প্রহেলিকা; বড় শহরগুলো যেমন, মফস্বল বা গ্রামের সেই নির্মল আনন্দ থেকে মন সরিয়ে দেয় আমাদের, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়; মহাজাগতিক এই শহরগুলোও ঠিক তাই, অথচ গ্যালাক্সির ফাঁকে ফাঁকে ঘটে চলেছে মজার সব কাণ্ড-কারখানা, আছে নক্ষত্র, এমনকি খুদে গ্যালাক্সিরাও—একটু অবাকই হয়েছিলাম। সেই অবাক করা গল্পটিই বলতে চাই। চলুন, ঘুরে আসা যাক গ্যালাক্সিদের ফাঁকে ফাঁকে। মহাজাগতিক শহরগুলোর সীমা ছাড়িয়ে, বাইরের শূন্যতা, মিশমিশে অন্ধকারে একটু উঁকি দেওয়া যাক।

অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি

দুই

গ্যালাক্সি-শহরের ফাঁকে চোখ রাখতে চাইলে টেলিস্কোপ লাগবে। কেন? কারণ, দৃশ্যমান আলোয় মহাশূন্যকে মনে হবে অন্ধকূপ। তবে মহাবিশ্বে আলো আছে নানা ধরনের। এগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হতে পারে, তবে সংক্ষেপে এদের চিনে নেব আমরা। যেমন গামা রশ্মি—মহাকাশ এ ধরনের রশ্মিতে ভরা বলা চলে; অতিবেগুনি আলো—সূর্য থেকে পৃথিবীতে এ ধরনের আলো আসে; এক্স-রে—হাড়-টাড় ভেঙে গেলে যে এক্স-রে করা হয়, তা বোধ হয় বলার দরকার নেই আলাদা করে; দৃশ্যমান আলো—আমরা খালি চোখে দেখি; অবলোহিত আলো—তাপ হিসেবে টের পাই ইত্যাদি। এসব আলোর নানা ধরনের উৎস আছে, সূর্য থেকে অতিবেগুনি ছাড়াও অন্যান্য ধরনের আলোও আসে—আমরা শুধু সহজে চিনতে এটুকু বলেছি। যাহোক, এসব আলো দেখতে পায় আমাদের টেলিস্কোপ। এই টেলিস্কোপ না থাকলে গ্যালাক্সি-মাঝের বিশাল কর্মযজ্ঞ রয়ে যেত আমাদের চোখের আড়ালেই।

টেলিস্কোপে চোখ রাখলেই আমরা দেখব—ওখানেও রয়েছে গ্যালাক্সি! তবে এগুলো আকারে খাটো, মিল্কিওয়ের সঙ্গে তুলনা করলে মনে হবে লিলিপুট। এরকম ২০টির মতো গ্যালাক্সি আছে মিল্কিওয়ের কাছাকাছি। তবে আকারে খাটো হওয়ায় এদের বলা হয় বামন গ্যালাক্সি। এরকম বামন গ্যালাক্সি আছে আন্তঃগ্যালাকটিক ফাঁকা জুড়ে, সবখানেই। এর কোনোটি ছুটছে, কোনোটি বিস্ফোরিত হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে তাদের ভেতরের মাল-মশলা—নাড়িভুঁড়ি। এই মাল-মশলা দিয়ে গড়ে উঠবে নক্ষত্র, জন্ম নেবে গ্রহ-গ্রহাণু-ধূমকেতুরা।

২০টির মতো গ্যালাক্সি আছে মিল্কিওয়ের কাছাকাছি। তবে আকারে খাটো হওয়ায় এদের বলা হয় বামন গ্যালাক্সি। সাধারণ গ্যালাক্সিতে শত শত বিলিয়ন নক্ষত্র থাকে। বামন গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র থাকে মাত্র মিলিয়নখানেকের মতো।
আরও পড়ুন

এদের বামন গ্যালাক্সি বলা আসলে অন্যায়। কারণ, বামন গ্যালাক্সিরাই আসলে দলে ভারী। প্রতি দশটা বামন গ্যালাক্সির বিপরীতে মহাবিশ্বে কেবল বড় বা স্বাভাবিক আকারের একটা গ্যালাক্সি পাওয়া যাবে। তবু, আমরা তো আসলে নিজেদের গ্যালাক্সির সঙ্গে তুলনা করেই বলতে পছন্দ করি। খেয়াল করে দেখুন, এই লেখার শুরুটিও কিন্তু পৃথিবী, তথা মিল্কিওয়ে থেকে!

সাধারণ গ্যালাক্সিতে শত শত বিলিয়ন নক্ষত্র থাকে। বামন গ্যালাক্সিতে নক্ষত্র থাকে মাত্র মিলিয়নখানেকের মতো। ১ মিলিয়ন মানে ১০ লাখ, আর বিলিয়ন মানে ১০০ কোটি। বামন গ্যালাক্সিদের যে অনুজ্জ্বল, ম্লান দেখাবে তাতে আর আশ্চর্য কী! এ জন্য এদের শনাক্ত করাও খুব কঠিন।

মূলত তিনটা বৈশিষ্ট্যের কারণে বামন গ্যালাক্সিদের সহজে শনাক্ত করা যায় না। এক, এরা খুব ছোট। দূর মহাকাশে তাকালে বিশাল ও উজ্জ্বল সব সর্পিল গ্যালাক্সি যখন আপনার মনোযোগ কেড়ে নেবে, অমন ক্ষুদ্র কিছু তখন চোখে পড়বে কেমন করে? দুই, এদের উজ্জ্বলতা খুব কম। এ জন্য যেসব জরিপ করার সময় নির্দিষ্ট একটা উজ্জ্বলতার নিচের কোনো কিছু খোঁজা হয়নি, ওসব জরিপে এগুলো একেবারে বাদ পড়ে গেছে। আর যেগুলোতে অমন সীমানা ছিল না, অমন অনেকগুলোতেও এরা কম উজ্জ্বলতার জন্য রয়ে গেছে আড়ালে। তিন, এদের মাঝে যেসব নক্ষত্র আছে, এদের ঘনত্ব খুবই কম। কাজেই রাতের আকাশে পৃথিবীর চারপাশের আরও যেসব আলোর উৎস আছে, সেই হিসেবে এদের আলোর উজ্জ্বলতা আলাদা করে চোখে পড়ে না।

মিল্কিওয়ের চারপাশে বামন গ্যালাক্সিগুলো

মিল্কিওয়ের চারপাশের ২০টি বামন গ্যালাক্সির দুটি বিখ্যাত। বিখ্যাত নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলানের নামে এগুলোর নাম রাখা হয়েছে ম্যাগেলানের মেঘ। এরা মিল্কিওয়েকে ঘিরে ঘোরে উপগ্রহের মতো। কম্পিউটার সিমুলেশনে দেখা যায়, এক সময় মিল্কিওয়ের আকর্ষণে এই দুর্ভাগা বামনদের বেশির ভাগ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। মিল্কিওয়ে তাদের গিলে নেবে পেটের ভেতর। স্যাজিটারিয়ার ডোয়ার্ফ নামে এরকম একটা বামন গ্যালাক্সিব্যবস্থাকে এই সেদিন, গত ১ বিলিয়ন বছরের মধ্যেই ‘কোৎ’ করে গিলে ফেলেছে মিল্কিওয়ে।

কিন্তু এসব বামন গ্যালাক্সির জন্ম হয় কীভাবে? গ্যালাক্সি-ক্লাস্টার, মানে গ্যালাক্সিপুঞ্জের মধ্যকার উচ্চ ঘনত্বের অঞ্চলগুলোতে একাধিক গ্যালাক্সির মধ্যে সংঘর্ষ হয় মাঝেমধ্যে। এই সংঘর্ষে খুলে যায় গ্যালাক্সির পাকানো দেহ। সর্পিল আকৃতির বাহু খুলে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে অনেক নক্ষত্র। সংঘর্ষ হয় এদের মধ্যকার গ্যাসীর মেঘের মধ্যে। বিস্ফোরণের ফলে যে অঞ্চলে নক্ষত্রেরা জন্ম নেয়, ওসব অঞ্চল থেকে শত শত মিলিয়ন নক্ষত্র গ্যালাক্সির মহাকর্ষের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে চলে আসে, ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। এসব নক্ষত্রের কয়েকটা মিলে আবার এক হয়ে জোট পাকাতে থাকে। এগুলোই একসঙ্গে হয়ে গড়ে ওঠে বামন গ্যালাক্সি। ছড়িয়ে পড়া অন্য নক্ষত্রগুলো ভেসে চলে মহাশূন্যের মাঝে।

মিল্কিওয়ের চারপাশের ২০টি বামন গ্যালাক্সির দুটি বিখ্যাত। বিখ্যাত নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলানের নামে এগুলোর নাম রাখা হয়েছে ম্যাগেলানের মেঘ। স্যাজিটারিয়ার ডোয়ার্ফ নামে এরকম একটা বামন গ্যালাক্সিব্যবস্থাকে এই সেদিন, গত ১ বিলিয়ন বছরের মধ্যেই ‘কোৎ’ করে গিলে ফেলেছে মিল্কিওয়ে।
আরও পড়ুন

সাধারণ বা একটু বড় আকারের গ্যালাক্সিদের নিয়ে হিসেবে করলে দেখা যাবে, এদের মোটামুটি ১০ শতাংশ কখনো না কখনো এ ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে গিয়েছিল। আর, গ্যালাক্সিপুঞ্জের হিসাবে এ ধরনের সংঘর্ষের হার আরও ৫ গুণ বেশি!

কিন্তু আর কী আছে বামন গ্যালাক্সি ছাড়া?

এক্সরে সংবেদনশীল টেলিস্কোপে দেখা গেছে, গ্যালাক্সিপুঞ্জের মাঝের ফাঁকা জায়গায় একধরনের গ্যাস থাকে। এই গ্যাস ক্লাস্টারের ফাঁকা জায়গাগুলো দখল করে নেয়। এর তাপমাত্রা হয় মোটামুটি দশ মিলিয়িন ডিগ্রির মতো। এত বেশি উত্তপ্ত যে এরা এক্সরে হিসেবে জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই গ্যাসীয় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে গ্যাসভর্তি কোনো গ্যালাক্সি যখন ছুটে যায়, তখন এই গ্যাস গ্যালাক্সিগুলোর পাকানো দেহ, মানে সর্পিল প্যাঁচ খুলে ফেলে। ফলে গ্যালাক্সির নতুন নক্ষত্র তৈরি করার নিজস্ব যে ক্ষমতা, তা নষ্ট হয়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে এর ভেতরের নক্ষত্রগুলো। মহাশূন্যে ভেসে চলে ছন্নছাড়াভাবে।

মজার ব্যাপার হলো, এই প্রচণ্ড উত্তপ্ত গ্যাসের ভর হিসেব করলে দেখা যাবে, ক্লাস্টার বা পুঞ্জের সব গ্যালাক্সির চেয়ে ভয়ংকর এই গ্যাসের ভর প্রায় ১০ গুণ বেশি!

এগুলো তো আমাদের জানা বিষয়। অজানা জিনিসপত্রও আছে। ভর মাপতে গেলেই টের পাবেন, অদ্ভুত একধরনের ভর পাওয়া যাচ্ছে, অথচ কীসের ভর, তা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। এরকম অজানা ভরকে বিজ্ঞানীরা ইংরেজিতে বলেন ডার্ক ম্যাটার। এরকম ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান পাওয়া গেছে আন্তঃগ্যালাকটিক স্থানে। দেখা গেছে, এরকম এক অজানা ভরের স্তূপ ৩০ হাজার আলোকবর্ষ জুড়েও ছড়িয়ে আছে!

স্যাজিটারিয়ার ডোয়ার্ফ নামের গ্যালাক্সিটিকে যেভাবে গিলে নিল মিল্কিওয়ে
প্রথমেই আপনার দেহ মহাবিশ্বের তাপমাত্রার সঙ্গে সমতা করতে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দিকে এগোতে থাকবে। শিগগির জমে বরফ হয়ে যাবেন আপনি।
আরও পড়ুন

তবে মহাশূন্য বা ফাঁকা বলতে আমরা যা বুঝি, যেখানে বামন গ্যালাক্সি নেই, ছড়িয়ে থাকা তারা নেই, সেই মহাশূন্যও কিন্তু আসলে শূন্য নয়। কোনো কারণে আপনি যদি সেখানে যেতে চান, তাহলে একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে দিই—ওসব আন্তঃগ্যালাকটিক জায়গা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর!

ওখানে গেলে, প্রথমেই আপনার দেহ মহাবিশ্বের তাপমাত্রার সঙ্গে সমতা করতে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার দিকে এগোতে থাকবে। শিগগির জমে বরফ হয়ে যাবেন আপনি। বায়ুমণ্ডলীয় চাপের অভাবে আপনার দেহের রক্তকোষগুলো বিস্ফোরিত হবে। ফেটে ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে। তবে এগুলো আসলে বড় ব্যাপার না। বলা যায়, সাধারণ সমস্যা।

গ্যালাক্সির ফাঁকে ফাঁকে এ জায়গার আসল সমস্যা হলো, প্রচণ্ড দ্রুতগামী ও ভয়ংকর শক্তিশালী চার্জিত একধরনের অতিপারমাণবিক কণা। বিজ্ঞানীরা বলেন মহাজাগতিক রশ্মি। সর্বোচ্চ শক্তির এ ধরনের কণার শক্তি এলএইচসি বা আরও শক্তিশালী পার্টিকেল অ্যাকসিলারেটরে গতিশীল কণার চেয়ে অন্তত ১০০ মিলিয়ন গুণ বেশি তো হবেই। কিন্তু কোত্থেকে এল এগুলো?

এদের উৎপত্তি আমাদের কাছে আজও রহস্য। কিন্তু এর মধ্যে বেশির ভাগ চার্জিত কণা যে প্রোটন, মানে হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস, এটুকু আমরা জানি। মহাজাগতিক রশ্মিতে এদের গতিবেগ হয় প্রচণ্ড, আলোর বেগের ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯৯ শতাংশ!

এরপর আছে ভ্যাকুয়াম। এই হলো, আপনি যাকে এতক্ষণ ধরে শূন্য ভাবছেন, সেই শূন্য। অথচ, এই শূন্যও শূন্য নয়! মহাবিশ্বের তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে অদ্ভুত জায়গা এসব ভ্যাকুয়াম। কারণ, এর মধ্যে প্রতিমুহূর্তে জন্ম নিচ্ছে ভার্চ্যুয়াল কণা। আবার মুহূর্তেই ধ্বংসও হয়ে যাচ্ছে!

আন্তঃগ্যালাকটিক স্থানে কণা-প্রতিকণা জোড় তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় বলে এদের বলা হয় ভার্চ্যুয়াল কণা
ভ্যাকুয়ামের এই শক্তি যেন তেন শক্তি নয়। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, এই শক্তি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে, করে চলেছে, প্রতিমুহূর্তে।

এগুলো আসলে পদার্থ ও প্রতিপদার্থ কণাজোড়। মুহূর্তের মধ্যে জন্ম নিয়ে ভ্যাকুয়াম থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে, পরমুহূর্তে আবার বিলীন হয়ে যায়। এই মুহুর্তের বেরিয়ে আসার ব্যাপারটাকে ফুটন্ত পানির কড়াই থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসা পানির বুদবুদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। কোনোভাবেই এদের অস্তিত্ব  শনাক্ত করা যায় না, ইংরেজিতে যাকে বলে আনডিটেক্টেবল। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের এই অদ্ভুত অনুমানকে বলা হয় ‘ভ্যাকুয়াম শক্তি’।

ভ্যাকুয়ামের এই শক্তি যেন তেন শক্তি নয়। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, এই শক্তি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে, করে চলেছে, প্রতিমুহূর্তে। এর জোরেই মহাকর্ষের বাধা ঠেলে বিস্তৃত হয়ে চলেছে মহাবিশ্ব। এর পোষাকী নাম, ডার্ক এনার্জি। বাস্তবতা হলো, ডার্ক মানে অজানা। হ্যাঁ, রহসম্যয় ডার্ক এনার্জি হতে পারে ভ্যাকুয়ামের এই শক্তিই। কিন্তু জিনিসটা আসলে কী, কেউ জানে না।

বুঝতেই পারছেন, গ্যালাক্সির ভেতরের চেয়ে বাইরের অংশগুলো কোনো হিসেবেই কম চমকপ্রদ নয়। মহাজাগতিক এই শহরগুলোই আমাদের চিন্তায় মহাবিশ্বের কাঠামো হিসেবে ধরা দেয়। অথচ মহাবিশ্বের রহস্যময় ঘটনাগুলোর বড় একটি অংশ ঘটে চলেছে ছায়াপথের ফাঁকে ফাঁকে।

এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কতটা ক্ষুদ্র। অথচ নিজেদের আমরা বরাবরই বড় বেশি গুরুত্ব দিই। আমরা ভুলে যাই, মহাবিশ্বে আসলে কোনো কেন্দ্র নেই। বড় গ্যালাক্সি, বামন গ্যালাক্সি, প্রাণের ঠিকানা কিংবা নানা নাম, ভাগ-বিভাগ—এসবই আমাদের দেওয়া। অথচ আমরা এই বিশাল মহাবিশ্বের নিতান্ত সাধারণ এক গ্রহের মানুষ।

এ আলোচনা নিজেদের সেই ক্ষুদ্রতার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। আর কিছু নয়।

সূত্র:

অ্যাস্ট্রোফিজিকস ফর পিপল ইন আ হারি/ নীল ডিগ্র্যাস টাইসন

নাথিং/ ফ্র্যাঙ্ক ক্লোজ

নাসা

স্পেস ডটকম

উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন