নতুন মহাকাশ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আগে চীন চাঁদে নভোচারী পাঠালে কী হবে
১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রেখেছিলেন মার্কিন নভোচারী নীল আর্মস্ট্রং। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের পর কেটে গেছে প্রায় ৫৬ বছর। কিন্তু মহাকাশ জয়ের সেই দৌড় আবার শুরু হয়েছে। এবার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন। উভয় দেশই তাদের নভোচারীদের চাঁদে পাঠানোর জন্য জোরেশোরে কাজ করছে। নাসার কর্মকর্তারা যদিও দাবি করছেন, আমেরিকা এই দৌড় জিতবে। কিন্তু যদি আমেরিকার আগে চীন প্রথম চাঁদে সফলভাবে নভোচারী পাঠায়, তাহলে কী হবে?
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তাদের আর্টেমিস কর্মসূচির মাধ্যমে চাঁদে ফেরার জন্য জোরেশোরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে নাসা আগামী বছরের শুরুর দিকে আর্টেমিস ২ মিশনে নভোচারীদের চাঁদের চারপাশে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। এই মিশনে নভোচারীরা চাঁদে নামবেন না। মূলত আর্টেমিস ২ মিশন হবে একটি পরীক্ষামূলক অভিযান। সবকিছু ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য এই মিশন চালাবে নাসা। এরপর ২০২৭ সালে আর্টেমিস ৩ মিশনে নাসা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে মানুষ নামানোর পরিকল্পনা করেছে। অ্যাপোলো প্রোগ্রামের পর প্রথম নভোচারীদের চাঁদে অবতরণ করাই এই মিশনের লক্ষ্য।
চীন যদি সবার আগে চাঁদে পৌঁছে যায় তাহলে পুরো বিশ্বেই ক্ষমতার পরিবর্তন দেখা যাবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে বড় ধরনের প্রভাব পরবে।
অন্যদিকে, চীনও পিছিয়ে নেই। তারা ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের প্রথম মানববাহী চন্দ্রাভিযান সম্পন্ন করার কথা জানিয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য চীন তাদের নিজেদের তৈরি অত্যাধুনিক রকেট এবং ল্যান্ডার ব্যবহার করবে। সম্প্রতি তারা তাদের নতুন শক্তিশালী রকেট লং মার্চ ১০ এবং ল্যান্ডার ল্যানিউয়ের কথা জানিয়েছে। এই ল্যান্ডারটি চাঁদের পৃষ্ঠে নভোচারীদের নিরাপদে অবতরণ ও উৎক্ষেপণে সাহায্য করবে।
নাসার ২০২৭ সালের মধ্যে মিশন পরিচালনা দেখে মনে হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রই চাঁদে নামার এই প্রতিযোগিতায় অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের একটি শুনানিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমেরিকার চীনের কাছে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণও তাঁরা দেখিয়েছেন। এখানে বলে রাখি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট হলো দেশটির আইনসভার উচ্চকক্ষ। সেখানে প্রতিটি অঙ্গরাজ্য থেকে দুজন করে মোট ১০০ জন সদস্য থাকেন।
আমেরিকার এই চন্দ্রাভিযানের ব্যবহার করা হবে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের তৈরি বিশাল রকেট স্টারশিপ। তবে এই রকেটটি তৈরি করতে অনেক দেরি হচ্ছে। যা আর্টেমিস ৩ মিশনকে পিছিয়ে দিতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই রকেটটিকে সরাসরি পৃথিবী থেকে চাঁদে পাঠানো যাবে না। কারণ, স্টারশিপ চাঁদে যাওয়ার আগে মহাকাশে এর ট্যাঙ্ক একাধিকবার ভর্তি করতে হবে। মহাকাশে এভাবে জ্বালানি ভরা খুব কঠিন কাজ। এটি যদি সফল না হয়, তাহলে পুরো অভিযানই ঝুঁকির মুখে পরবে।
চীন প্রথমে তাদের নভোচারীদের চাঁদের মধ্য অক্ষাংশে নামানোর কথা ভাবছে। সেখানে বরফ তুলনামূলকভাবে কম। তবে এর পাশাপাশি তারা একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে।
নাসার প্রাক্তন প্রশাসক জিম ব্রাইডেনস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা সিনেটের সেই শুনানিতে সতর্ক করেছেন মিশনের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে। মহাকাশ কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার সময় তিনি বলেছেন, ‘যদি বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কখনোই চীনের আগে চাঁদে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।’
মহাকাশ আইন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ মাইক গোল্ড মনে করেন, ‘চীন যদি প্রথমে চাঁদে অবতরণ করে, তবে এর গভীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে বিশ্বে।’ তিনি বলেন, ‘চীন চাঁদে পৌঁছানোর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র শুধু মহাকাশ নিয়ে না, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও বাণিজ্য চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। চাঁদে প্রথম অবতরণ করলে চীন ও তাদের সহযোগী দেশগুলোর রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর এবং শক্তিশালী হবে।
চীনের মহাকাশ কর্মসূচি দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য খুব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়। মহাকাশ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীন যদি সবার আগে চাঁদে পৌঁছে যায় তাহলে পুরো বিশ্বেই ক্ষমতার পরিবর্তন দেখা যাবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে বড় ধরনের প্রভাব পরবে।
আমেরিকা যদি সবার আগে চাঁদে নভোচারী না পাঠাতে পারে, তাহলে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে থাকা বরফের মজুদ তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এই বরফকে ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ হিসেবে দেখেন।
এই বরফকে ভেঙে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন তৈরি করা সম্ভব। এ দুটি গ্যাস রকেটের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই গ্যাস ব্যবহার করে ভবিষ্যতে চাঁদ থেকে বা মহাকাশে আরও দূরের অভিযানের জন্য কাজে আসবে। এছাড়াও, নভোচারীদের বেঁচে থাকার জন্য এই বরফ থেকে পানি তৈরি করা যাবে। এতে পৃথিবী থেকে পানি বহন করার খরচ এবং ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে।
চীন যদি প্রথমে চাঁদে অবতরণ করে, তবে এর গভীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে বিশ্বে।
চীন প্রথমে তাদের নভোচারীদের চাঁদের মধ্য অক্ষাংশে নামানোর কথা ভাবছে। সেখানে বরফ তুলনামূলকভাবে কম। তবে এর পাশাপাশি তারা একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। তারা ২০২৬ সালে তাদের রোবটিক অভিযান চাং’ই ৭ (Chang'e 7) এবং ২০২৮-২৯ সালে চাং’ই ৮ (Chang'e 8) কে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পাঠাবে। এই অভিযানগুলোর মূল লক্ষ্য হবে সেখানে বরফ আছে কিনা, তা খুঁজে বের করা এবং চাঁদে থাকার জন্য স্থায়ী বসতি তৈরির প্রযুক্তি পরীক্ষা করা।
কোয়ালিশন ফর ডিপ স্পেস এক্সপ্লোরেশনের সভাপতি এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যালেন কাটলার বলেছেন, ‘চাঁদে যে দেশ প্রথমে অবতরণ করবে, তারা আগামী কয়েক দশক মহাকাশের নিয়ম তৈরি করবে।’