চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে মানুষের আগে কোন প্রাণী বসবাস করবে
চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে মানুষের স্থায়ী বসতি স্থাপনের স্বপ্ন এখন আর কল্পবিজ্ঞানের কোনো গল্প নয়। শিগগিরিই বাস্তবে পরিণত হতে চলেছে। এই দশকের শেষ দিকে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে চাঁদে মানুষের একটি স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করা হবে। এর মূল উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মানুষের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া।
যেহেতু মহাকাশে মানুষের টিকে থাকার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি, তাই যেকোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মতোই এ ক্ষেত্রেও মানুষের আগে প্রাণীদের ওপরই পরীক্ষা করা হবে। এতে বিজ্ঞানীরা যাচাই করে দেখবেন, মহাকাশের পরিবেশ মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ।
তাহলে প্রশ্ন হলো, মানুষের আগে মহাকাশে নতুন বসতি গড়তে প্রথম কোন কোন প্রাণী যাবে? আর চাঁদ ও মঙ্গলে মানুষের টিকে থাকার জন্য যে বাস্তুতন্ত্র তৈরি হবে, সেখানে কোন কোন প্রাণী নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে?
মহাকাশে মানুষের টিকে থাকার জন্য প্রাণীরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করবে। যেমন, পরাগায়নের জন্য পোকামাকড় লাগবে, ছোট জায়গায় লালন-পালন করা যায় এমন চিংড়ি ও মাছ চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও টার্ডিগ্রেডদের মতো প্রাণী আমাদের বিকিরণ প্রতিরোধ করার কৌশল শিখতে সাহায্য করতে পারে মহাকাশে। নভোচারীদের সঙ্গে চাঁদ, মঙ্গল এবং এর বাইরে বসতি স্থাপন করার জন্য কোন কোন প্রাণী সবচেয়ে উপযুক্ত?
মহাকাশে কোন প্রাণীদের নিয়ে প্রথমে যাওয়া হবে, সে ব্যাপারে এখনো বিজ্ঞানীরা কোনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেভিড ক্যাটলিং জানিয়েছেন, ‘পৃথিবীর বাইরে একটি পূর্ণাঙ্গ বাস্তুতন্ত্র তৈরি করার বিষয়টি বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষণার চেয়ে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির অংশই বেশি। তবে খুব বেশি গবেষণা ছাড়াও এটি স্পষ্ট যে, মহাকর্ষ বলের মতো মৌলিক শক্তিগুলো মহাকাশে জীবন ধারণের ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে।’
নাসার অ্যামেস রিসার্চ সেন্টারের গ্রহবিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ম্যাককে বলেন, ‘মহাকাশে বসবাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কম মাধ্যাকর্ষণ। মঙ্গল গ্রহে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ এবং চাঁদে পৃথিবীর চেয়ে এক-ষষ্ঠাংশ মাধ্যাকর্ষণ রয়েছে। পৃথিবীর মতো তাপমাত্রা, চাপ এবং বায়ুমণ্ডলীয় পরিবেশ তৈরি করে বসবাসের স্থান বানানো সম্ভব। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ পরিবর্তন করার কোনো উপায় নেই।’
মহাকাশে বসতি স্থাপনের জন্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং উচ্চ দক্ষতা খুবই জরুরি। নাসার বিজ্ঞানী ক্রিস্টোফার ম্যাককের জানান, ‘যেহেতু মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী পানিতে ভাসমান থাকে, তাই মহাকর্ষীয় পরিবর্তনগুলো এদের বৃদ্ধিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। মাছ স্থলভাগের প্রাণীদের চেয়ে কম খাবার গ্রহণ করে এবং কম বর্জ্য উৎপাদন করে। তাই খাদ্যের উৎস হিসেবে খুবই কার্যকর হতে পারে।’
বিজ্ঞানীরা এই সম্ভাবনা যাচাই করতে ২০১৯ সাল থেকে লুনার হ্যাচ প্রোগ্রাম মহাকাশে মাছের ডিম পাঠানোর সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করছে। যদি ডিমগুলো মহাকাশে টিকে থাকতে পারে, তাহলে মাছ হবে একটি উচ্চ-প্রোটিনযুক্ত এবং কম বর্জ্য উৎপাদনকারী আদর্শ খাদ্যের উৎস।
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক মহাকাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মহাকাশে পোকামাকড়ও খাদ্যের একটি কার্যকর উৎস হতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝিঁঝিঁ পোকা (Acheta domesticus) সবচেয়ে উপযুক্ত ও সাশ্রয়ী। কারণ, প্রথাগত প্রোটিন উৎসের তুলনায় এরা কম জায়গা ও কম পানি ব্যবহার করে প্রোটিন সরবরাহ করে।
পোকামাকড়ের মতোই, চিংড়ি এবং অন্যান্য ক্রাস্টেসিয়ানও মহাকাশে খাদ্যের একটি কার্যকর উৎস হতে পারে। এগুলো ছোট ট্যাঙ্কে সহজেই লালন-পালন করা যায়। চাঁদে বসতি স্থাপনের জন্য গবেষকেরা টার্ডিগ্রেড প্রাণীর দিকে নজর দিচ্ছেন। এই ক্ষুদ্র ও অত্যন্ত শক্তিশালী প্রাণীগুলো চরম তাপ, ঠান্ডা এবং বিকিরণ সহ্য করতে পারে।
যদিও এরা সরাসরি মানুষের বাস্তুতন্ত্রের অংশ নয়, তবুও মহাকাশে এদের নিয়ে গবেষণা করে জানা যাবে কীভাবে এরা বিকিরণের মতো চরম পরিস্থিতি সহ্য করে। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে অন্যান্য জীবের মধ্যেও সেই ক্ষমতা তৈরির চেষ্টা করা যাবে।