আপনার ঘরের প্রতিটি বিন্দুতেও ঘটেছে বিগ ব্যাং

বিগ ব্যাং। মানে, মহাবিস্ফোরণ। জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বদৌলতে হয়তো শুনেছেন কথাটা। ইন্টারনেটের কল্যাণে এ শব্দগুচ্ছ এখন বহুল প্রচলিত। হালে এই নাম আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে একটি টিভি সিরিজের কল্যাণে। দ্য বিগ ব্যাং থিওরি।

হয়তো জানেন, মহাবিশ্বের সূচনা ব্যাখ্যা করা হয় এর মাধ্যমে। বিগ ব্যাং থিওরি বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব। নামটা যেন কেমন। একটা ভুল ধারণা মাথায় আসে চট করে। মনে হয়, একটি বিন্দুতে বিস্ফোরণ হয়েছে প্রচণ্ডভাবে। সেই বিন্দু থেকে সূচনা হয়েছে মহাবিশ্বের। আদতে বিষয়টি ঠিক এমন নয়। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ একটা ঘটনা। আমরা বিস্ফোরণ মানে যেরকম ভয়ংকর কিছু বুঝি—এ সময় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সব, এই বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণে এমনটা হয়নি আসলে। তা ছাড়া এই বিস্ফোরণটি শুধু একটি বিন্দুতে ঘটেনি। ঘটেছে মহাবিশ্বের সব বিন্দুতে, একই সঙ্গে! সত্যি, আপনি যে ঘরে বসে আছেন, সেই ঘরেও হয়েছে বিগ ব্যাং। এবং এর প্রমাণ আমরা চাইলেই দেখতে পারি। স্বচক্ষে। নিজের ঘরে বসেই। আপনার বাসায় বাবা বা দাদার কালের সেই বিশাল কালো বাক্স, মানে সিআরটি টেলিভিশন যদি থাকে, তবে আপনি চাইলেই দেখতে পাবেন বিগ ব্যাংয়ের প্রমাণ। বলা ভালো, বিগ ব্যাংয়ের অবশেষ। এর নাম, মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ।

হাঁটার আগে দৌড়ানো কোনো কাজের কথা নয়। মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ বা বিগ ব্যাং—আমাদের এই মহাবিশ্বের সূচনার গল্পটা শুনতে চাইলে, এর স্বরূপ বুঝতে চাইলে আমাদের বরং মানুষের জ্ঞানের পথ ধরেই এগোনো উচিৎ। ধাপে ধাপে। চলুন, সে জন্য ফিরে যাওয়া যাক ১৯২২ সালে।

আরও পড়ুন
এই সাড়ে সর্বনেশে ব্যাপার হাবল স্বচক্ষে দেখলেন বটে, তবে সে তো দুরবিনে চোখ রেখে। হেঁয়ালি নয়তো? ধাঁধা লেগে যেতে পারত।

এডুইন হাবলের নাম হয়তো শুনেছেন। হাবল টেলিস্কোপের তোলা মহাকাশের দারুণ সব ছবিও হয়তো দেখেছেন ইন্টারনেটের কল্যাণে। এই ভদ্রলোকের নামেই টেলিস্কোপটির অমন নাম। টেলিস্কোপটি আজ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, আর অহর্নিশ তুলে চলেছে মহাকাশের ছবি। এসব ছবিতে ভর করে বিজ্ঞানীরা পেয়ে যান নানা মহাজাগতিক রহস্যের সন্ধান। খুঁজতে খুঁজতে সমাধানও করে ফেলেন অনেক সময়। যার বেশির ভাগের উত্তর পাওয়া যায় কোনো না কোনো টেলিস্কোপের তোলা ছবিতে।

এডুইন হাবল নিজেও এক মহাজাগতিক গোয়েন্দা। টেলিস্কোপে চোখ রেখে তিনি দেখলেন, এ কী কাণ্ড! এ তো সাড়ে সর্বনাশ! আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো দুঁদে বিজ্ঞানীরাও এতদিন বলে এসেছেন, মহাবিশ্বটা স্থিতিশীল। মহাবিশ্ব মানে, এই তো সব—জন্ম, মৃত্যু, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের মতো নিতান্ত মানবিক ধারণা তাকে ছুঁতে পারে নাকি? এই বিশ্ব, জগৎ সংসার আছে—চিরদিন, একইরকম। অথচ হাবল দেখলেন, স্পষ্ট দেখলেন, গ্যালাক্সিগুলো সব পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যে গ্যালাক্সি যত দূরে, ওটা দূরে সরে যাচ্ছে তত দ্রুত।

এই সাড়ে সর্বনেশে ব্যাপার হাবল স্বচক্ষে দেখলেন বটে, তবে সে তো দুরবিনে চোখ রেখে। হেঁয়ালি নয়তো? ধাঁধা লেগে যেতে পারত। লাগল না যার কল্যাণে, তাঁর নাম আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান। ১৯২২ সালে তিনি এক কাণ্ড করলেন। সেই কাণ্ডের শিকড় অবশ্য সেই দুঁদে বিজ্ঞানীরই কাজের ফসল। বুঝতেই পারছেন, দুঁদে বিজ্ঞানীটি আর কেউ নন, আলবার্ট আইনস্টাইন।

১৯১৫ সালে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব নিয়ে নিজের গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। হাল আমলে বড় পরিসরের জগৎ সংসারের জন্য বৈজ্ঞানিক যত তত্ত্ব বা কর্মকাণ্ড, এর প্রায় সবকিছুর পেছনেই ওই তত্ত্ব। বিগ ব্যাং? আপেক্ষিকতা। কৃষ্ণগহ্বর? সেও আপেক্ষিকতা। শুধু কি তাই? এই যে বিমান চলছে, রকেট ছুটছে, কিংবা বহু দূর মহাকাশের সংবাদ জেনে যাচ্ছি আমরা ঘরে বসেই—এই সবকিছুর শিকড় সেখানেই। তা, আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের সঙ্গে বিগ ব্যাংয়ের সম্পর্ক কী?

হাবল টেলিস্কোপ
নাসা

তত্ত্বটির একটি সমীকরণ সমাধান করতে গিয়ে রুশ পদার্থবিদ আলেক্সান্ডার ফ্রিডম্যান প্রথম অঙ্ক কষে দেখালেন, মহাবিশ্বটা সম্প্রসারিত হচ্ছে। বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে। এ তো ভয়ংকর কথা। স্বয়ং আইনস্টাইন নিজেও যে তা মানতে পারেননি, সে কথা তো ইতিমধ্যেই বলেছি। কিন্তু এডুইন হাবল যখন বিষয়টা স্বচক্ষে দেখে ফেললেন, তখন বিষয়টা আর না মেনে উপায় রইল না।

তা, হাবল কীভাবে বুঝলেন, গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? এই বিষয়টা সহজে বোঝা যায় ডপলার এফেক্ট বা ডপলার প্রভাব (প্রচলিত বাংলা নাম: ডপলার ক্রিয়া) থেকে।

মহাকাশের বহু দূর দূর প্রান্ত থেকে কী নক্ষত্র কী গ্যালাক্সি—সবাই প্রতিনিয়ত আলোর চিরকুটে ছুড়ে দিচ্ছে গোপন বার্তা। বিজ্ঞানীরা এই বার্তা পড়তে পারেন। আলো আবার বহুরূপী। এর কোনোটা আমরা দেখতে পাই, কোনোটা পাই না। যে অংশটা দেখতে পাই, তাকে বলা হয় দৃশ্যমান আলো। নামেই পরিচয়! আর যে অংশটা দেখতে পাই না, তাদেরকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ভাগের আলোর (সঠিকভাবে বললে, তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ) তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর চেয়ে ছোট। যেমন অতিবেগুনি আলো, এক্স-রে বা গামা রশ্মি। আলো বা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের নিয়ম হলো, যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট, তার কম্পাঙ্ক বা তীব্রতা বেশি। বুঝতেই পারছেন, এই আলোগুলোর কম্পাঙ্ক বেশি। আরেকটি ভাগের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বড়। যেমন অবলাল (বা অবলোহিত) আলো, মাইক্রোওয়েভ, রেডিও ওয়েভ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন

খেয়াল করলেই দেখবেন, দৃশ্যমান আলোর একপ্রান্তে লাল আলো, তারপর দৃশ্যমানের চেয়ে বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলাল আলো। দৃশ্যমান আলোর অন্যপ্রান্তে নীল আলো, তার সীমানা পেরোলেই অতিবেগুনি। একদম সহজ করে বললে, কোনো আলো বা তরঙ্গ যখন আমাদের দিকে এগিয়ে আসে, তখন তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হতে থাকে। এই আলোটাকে তখন (আমাদের চোখে বা যন্ত্রে) নীলচে দেখায়। আর আলো আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড় হয়। তখন সেটাকে লালচে দেখায়। এটাই ডপলার ক্রিয়া। বিষয়টা অবশ্য শুধু আলো নয়, শব্দতরঙ্গের জন্যও সত্যি। শব্দতরঙ্গের উদাহরণ হিসেবে ট্রেন বা অ্যাম্বুলেন্সের হর্নের কথা বলা যায়। যখন কাছে এগিয়ে আসে, হর্নের তীব্রতা বেড়ে যায় (কারণ, তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হলে কম্পাঙ্ক বা তীব্রতা বেড়ে যায়)। আবার দূরে সরে গেলে দেখা যায়, হর্নটা আর অত কানে লাগছে না। অর্থাৎ তীব্রতা বা কম্পাঙ্ক ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে তরঙ্গদৈর্ঘ্য।

হাবল গ্যালাক্সিদের আলোর চিরকুট পড়ে দেখলেন, ওগুলো লাল কালিতে ভরা। যে গ্যালাক্সি যত দূরে, তার কালি (পড়ুন, আলো) তত লাল। তার মানেটা দাঁড়ায়, ওগুলো তত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। এই মহাসর্বনাশা ব্যাপারটি থেকে আমরা এবার চট করে একটা মানস পরীক্ষায় চলে যাই।

ধরে নিই, আমরা মহাবিশ্বটার একটা ভিডিও দেখছি। ইতিমধ্যেই ভিডিওর কিছু সময় পেরিয়ে গেছে। এখন ভিডিও যত সামনে এগোচ্ছে, গ্যালাক্সিগুলোকে দেখা যাচ্ছে, কী এক সর্বনাশা নেশায় তারা ছুটে যাচ্ছে দূরে, আরও দূরে। ভিডিওটা এবার পজ করে, উল্টো করে চালিয়ে দেওয়া যাক। কী দেখব? দেখব, গ্যালাক্সিগুলো উল্টো ছুটছে, পরস্পরের কাছে; আরও কাছে। একসময় সেগুলো একদম কাছাকাছি চলে আসবে, মিলেমিশে এক হয়ে যাবে—অন্তত এমনই কিছু একটা দেখা যাওয়ার কথা। তার মানে কি মহাবিশ্বের সবকিছু এককালে একসঙ্গে জড়ো হয়ে ছিল? মহাবিশ্বটা কি তাহলে একটা ডিমের মতো, যেই ডিম ফেটে বেরিয়ে দিগবিদিক ছুটছে গ্যালাক্সিগুলো?

জর্জ লেমিত্রি
উইকিপিডিয়া

১৯২৯ সালে ঠিক এই কথাটিই বললেন বেলজিয়ামের এক পাদরি ও গণিতবিদ। জর্জ লেমিত্রি। তিনি বললেন, এককালে খুব ক্ষুদ্র একটি জায়গায় একসঙ্গে ছিল মহাবিশ্বের সব। এই ক্ষুদ্র জায়গাটির নাম তিনি দিলেন ‘কসমিক এগ’। মহাজাগতিক ডিম। ‘ব্রহ্মাণ্ড’ শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ ভেবে দেখলেই মাথায় ছবিটা ভেসে ওঠে সুন্দর ভাবে। স্থিতিশীল মহাবিশ্ব তত্ত্বের সমর্থক বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল এরকম ‘ঘোড়ার ডিমের মহাবিশ্ব’ মানতে পারেননি। বিবিসি রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে ১৯৪৯ সালে তিনি লেমিত্রির তত্ত্বকে বিদ্রুপ করে আখ্যা দিলেন ‘বিগ ব্যাং’—বিপুল বিস্ফোরণ।

হয়েল জানতেন না, গোটা পৃথিবী এই নামটি লুফে নেবে সিরিয়াসলি। আর প্রতিবার এই নামের ব্যাখ্যায় বলতে হবে, হয়েল নামটি দিয়েছিলেন বিদ্রুপ করে!

আরও পড়ুন
পেনজিয়াস ও উইলসন যতই চেষ্টা করেন, ঝামেলা আর যায় না। যেদিকেই তাঁরা অ্যান্টেনা ঘোরান, এই সিগন্যাল, এই নয়েজ পাওয়া যায়। কী একটা অবস্থা! হার মানলেন দুই বিজ্ঞানী। মহাবিশ্বের সঙ্গে তো আর লড়াই চলে না!

‘বিগ ব্যাং’ এখন তত্ত্ব বটে, তবে সে কালে এটি ছিল হাইপোথিসিস। অর্থাৎ সম্ভাব্য তত্ত্ব। এর কোনো প্রমাণ তখনো মেলেনি। মহাবিশ্বটা প্রসারিত হচ্ছে বটে, এটুকু তো বোঝাই গেল; কিন্তু বিগ ব্যাং যে হয়েছে, মহাবিশ্বের সব যে একসঙ্গে ছিল, তার প্রমাণ তো লাগবে। পাশার দান উল্টে গেল ১৯৬৫ সালে এসে, আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন নামের দুই বিজ্ঞানীর হাত ধরে।

এর বছরখানেক আগের কথা। সে সময় এই দুই মার্কিন পদার্থবিদ যুক্তরাষ্ট্রের বেল ল্যাবরেটরিতে কর্মরত। বিখ্যাত টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান এটিঅ্যান্ডটির গবেষণা শাখা এটি। সে কালে, অর্থাৎ ৬০-এর দশকে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গের কথা সবাই জানত। কিন্তু তেমন করে এটি শনাক্ত করার মতো প্রযুক্তি ছিল না।

মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ দিয়ে টেলিযোগাযোগ, এই হলো উদ্দেশ্য। সমস্যা হলো, এর পিছু পিছু ‘বিধেয়’র মতো চলে আসে নয়েজ। মানে অপ্রয়োজনীয় উল্টাপাল্টা শব্দ। এই দুই বিজ্ঞানী চান এসব অপ্রয়োজনীয় শব্দ ঝেড়ে ফেলতে। মাইক্রোওয়েভ একধরনের তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, মানে একধরনের আলো। এই আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে যা যা নয়েজ আছে, যেগুলো ঝামেলা করে দিচ্ছে তাঁদের মূল তরঙ্গে, সেগুলো ঝেড়ে ফেলতে গিয়ে একে একে সব ঝামেলাকে তাঁরা গলা ধাক্কা দিয়ে বিদায় করলেন। তবু নয়েজ রয়ে গেল। ঝামেলা বলে কথা!

আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন
বাল্বঅ্যাপ

ওদিকে জর্জ গ্যামো, র‍্যালফ আলফার এবং হ্যানস বেথে ততদিনে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এই গবেষণাপত্র ‘আলফা-বিটা-গামা’ (αβγ) পেপার নামে পরিচিত। যদিও এই তিন বিজ্ঞানীর নামানুসারে এখন এটিকে আলফার, বেথে, গ্যামো পেপারও বলা হয়। একধরনের রসিকতা হিসাবে বেথে এই গবেষণায় কাজ না করলেও তাঁর নামটি গ্যামো পেপারে ঢুকিয়ে দেন। এই পেপারের একটি অনুমান ছিল, বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ সত্যিই হয়েছে। এর একটি ছাপ রয়ে গেছে মহাবিশ্বে, একধরনের তড়িৎচৌম্বকীয় বিকিরণ। আলোর চিরকুটে মহাবিশ্ব লিখেছে নিজের সূচনার কথা। সেই চিঠি নিয়ে পায়রা রওনা দিয়েছে—অর্থাৎ ছুট দিয়েছে আলো। ছুটতে ছুটতে আমরা যেমন ক্লান্ত হই, দিনে দিনে আলোও তেমনি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এককালের প্রচণ্ড উত্তপ্ত বিগ ব্যাংয়ের ছাপ হিসেবে চিরকুটের তরঙ্গদৈর্ঘ্য, অর্থাৎ কালি, আজ নেমে এসেছে মাইক্রোওয়েভের কাতারে। ক্লান্ত এই তাপমাত্রা কত হতে পারে? র‍্যালফ আলফার ও রবার্ট হারমান হিসাব কষে দেখালেন, এর তাপমাত্রা হতে পারে ৫ ডিগ্রি কেলভিন।

ওদিকে পেনজিয়াস ও উইলসন যতই চেষ্টা করেন, ঝামেলা আর যায় না। যেদিকেই তাঁরা অ্যান্টেনা ঘোরান, এই সিগন্যাল, এই নয়েজ পাওয়া যায়। কী একটা অবস্থা! হার মানলেন দুই বিজ্ঞানী। মহাবিশ্বের সঙ্গে তো আর লড়াই চলে না! ১৯৬৫ সালে এ নিয়ে তাঁরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেটার মূল বিষয় ছিল ‘অ্যান্টেনায় অকারণে পাওয়া অতিরিক্ত তাপমাত্রা’। এই অকারণ তাপমাত্রা বা বিকিরণ ধরা পড়ে টেলিভিশনের ঝিরিঝিরিতে (ওর সবটা নয়, কিছু অংশ), ধরা পড়ে রেডিওতেও। দেখা গেল, এর মান ২.৭৫ ডিগ্রি কেলভিন।

১৯৭৮ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন আলোর চিরকুট শনাক্তের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। ২০০৬ সালে আবার জন সি ম্যাথার এবং জর্জ এফ স্মুট এই বিকিরণ আরও বড় পরিসরের তরঙ্গদৈর্ঘ্যজুড়ে শনাক্ত করার জন্য ফের নোবেল পেয়েছেন।

অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক রবার্ট ডিকের নেতৃত্বে এই অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা মহাবিশ্বের চিরকুটই খুঁজে ফিরছিলেন। কিন্তু বেল ল্যাবের মতো সুযোগ-সুবিধা তো আর তাঁর হাতে নেই। আস্তেধীরে কাজ এগোচ্ছে। এ সময় তাঁরা শুনতে পেলেন, কোনো পদার্থবিদ বা জ্যোতিঃপদার্থবিদ নয়, একদল ইঞ্জিনিয়ার কিনা শনাক্ত করে ফেলেছে মহাবিশ্বের সেই চিরকুট! তারা আবার সেটাকে বলছে অতিরিক্ত তাপমাত্রা! মেজাজটা কেমন খারাপ হওয়ার কথা, সেটা বোঝাতে দ্য বিং ব্যাং থিওরির শেলডন কুপারের একটি ডায়ালগের কথাই বলা যায়। শেলডন হাওয়ার্ডকে বলেছিল, ‘ইউ আর অ্যান ইঞ্জিনিয়ার। ইউ আর গুড এট হোয়াট ইউ ডু, ইট ইজ জাস্ট নট ওর্থ ডুয়িং!’ মানে, ‘তুমি প্রকৌশলী, নিজের কাজটাও ভালোই পারো। কিন্তু ওটা তো করার মতো কাজই না!’

পেনজিয়াস এবং উইলসনের জন্য এ কথা অবশ্য খাটেনি। করার মতো কাজই তাঁরা করে ফেললেন। অতিরিক্ত এই তাপমাত্রাই আলোর চিরকুটে লেখা প্রমাণ। এই তাপমাত্রা বা বিকিরণ পাওয়া যাবে মহাবিশ্বের সবদিক থেকে। সবখানেই এ তাপমাত্রার মান প্রায় এক—২.৭৫ ডিগ্রি। অর্থাৎ এই গোটা মহাবিশ্বের সবটাজুড়ে এককালে সমান তাপমাত্রা বিরাজ করছিল। সে কালে প্রচণ্ড উত্তপ্ত ছিল গোটাটাই। আর সেটা ছিল একটা বিন্দুর মতো, কিংবা লেমিত্রির ভাষায় ‘কসমিক এগ’। সেটা আজ বড় হয়েছে, গোটা মহাবিশ্ব এখন বিপুল এক অস্তিত্ব, কালের আবর্তে এর তাপমাত্রা কমে গেছে। তবু মহাবিশ্বের পটে লেখা রয়েছে সেই বিন্দুসম শিশু মহাবিশ্বের কথা।

তবে আলফার ও হারমানের হিসাবে সামান্য ভুল ছিল। তাঁরা ২.৭৫ ডিগ্রিকে ভেবেছেন ৫ ডিগ্রি কেলভিন। মহাবিশ্বের বিশালতার খাতায় এইটুকু সামান্য ভুল আসলে বড় ব্যাপার নয়। বরং বলা যায়, তাঁদের এ কাজ ছিল অতিমানবীয়।

১৯৭৮ সালে পেনজিয়াস ও উইলসন আলোর চিরকুট শনাক্তের জন্য নোবেল পুরস্কার পান। ২০০৬ সালে আবার জন সি ম্যাথার এবং জর্জ এফ স্মুট এই বিকিরণ আরও বড় পরিসরের তরঙ্গদৈর্ঘ্যজুড়ে শনাক্ত করার জন্য ফের নোবেল পেয়েছেন। এই বিকিরণের হাত ধরেই এতদিনের ধারণার বিপরীতে মিলেছে শক্ত প্রমাণ। সত্যিকার এক বিজ্ঞান হিসেবে যাত্রা করেছে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা।

আরও পড়ুন
এই যে মহাবিশ্বের সবকটি বিন্দুতে বিস্ফোরণ—মহাবিশ্বের সবটা ভর, সবটুকু শক্তি যে বিস্ফোরণের ফলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, সেটিই মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং।

কেমন ছিল সেই বিন্দুসম মহাবিশ্ব? মহাবিশ্বের সব একটা বিন্দুতে বন্দী ছিল, তারপর বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সব—বিষয়টি কি তা-ই? মহবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই বোঝা প্রয়োজন, আমাদের সীমিত মস্তিষ্কে সেই বিন্দুসম অসীম কল্পনা করা অনেকটাই অসম্ভব। তবু একটু চেষ্টা করা যাক।

সেই যে মহাজাগতিক ভিডিওটির কথা বলেছিলাম, উল্টো করে তা চালিয়ে দেওয়া হলো। দেখা গেল, গ্যালাক্সিগুলো পরস্পরের সঙ্গে এসে মিলে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের সবটুকু বিশালতা, সব পদার্থ, সবটুকু শক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে একটি বিন্দুতে। জনপ্রিয় বিজ্ঞানে বলা হয়, সেই বিন্দুতে একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হলো। তারপর সেখান থেকে সূচনা হলো মহাবিশ্বের। বিষয়টি তা নয়। বিন্দুটিই মহাবিশ্ব। প্রচণ্ড ঘন, বিপুল ভারী সেই মহাবিশ্ব যেন এক অসীম বিন্দু। বিস্ফোরণটি মহাবিশ্বের ভেতরে কোথাও হয়নি। মহাবিশ্বটিই বিস্ফোরিত হয়েছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের একটি বিন্দুতে নয়, সব কটি বিন্দুতে বিস্ফোরণ হয়েছে। আপনি যে ঘরে বসে আছেন, সেই ঘরের প্রতিটি বিন্দু থেকে শুরু করে বহু বহুদূরের গ্যালাক্সি—সব কটি বিন্দুতে বিস্ফোরণটি হয়েছে একসঙ্গে। তারপর ধীরে ধীরে মহাবিশ্বটি প্রসারিত হতে শুরু করেছে। ভিডিওটি চলতে শুরু করেছে ঠিক দিকে।

এই যে মহাবিশ্বের সবকটি বিন্দুতে বিস্ফোরণ—মহাবিশ্বের সবটা ভর, সবটুকু শক্তি যে বিস্ফোরণের ফলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, সেটিই মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং।

আমরা যখন বিগ ব্যাং তত্ত্বের কথা বলি, তখন আসলে বলি, মহাবিশ্বটা একসময় সবদিকে প্রচণ্ড উত্তপ্ত ও ঘন ছিল। তবে এই বিষয়গুলো একদম একশ ভাগ নিশ্চিত করে আমরা জানতে পারি না। নিশ্চিতভাবে মহাবিশ্বের ইতিহাসটুকু আমরা জানতে পারি এর সূচনার প্রায় ৩ লাখ ৮০ বছর পর থেকে। কেন?

এক কথায় এর উত্তর, প্ল্যাঙ্ক স্কেলের চেয়ে ক্ষুদ্র জগতে তাকানোর উপায় আমরা জানি না। প্ল্যাঙ্ক স্কেল আবার কী? সেখানে ভেঙে পড়ে আমাদের জানা সবকিছু। বিস্তারিত জানতে পড়ুন: প্ল্যাঙ্ক স্কেলের রহস্য: যেখানে সবকিছু ভেঙে পড়ে

সূত্র: মহাজাগতিক প্রথম আলো/ আবুল বাসার

অ্যাস্ট্রোফিজিকস ফর পিপল ইন আ হারি/ নীল ডিগ্র্যাস টাইসন

উইকিপিডিয়া