মহাকাশে যানজট: কেসলার সিনড্রোম এবং আমাদের ভবিষ্যৎ
চলুন, একটু কল্পনার জগৎ থেকে ঘুরে আসি। পৃথিবীর চারপাশের কক্ষপথকে এক বিশাল মহাসড়ক হিসেবে ভেবে নিন। ধরা যাক, সেখানে হাজার হাজার উপগ্রহ একেকটি গাড়ির মতো নিরবচ্ছিন্ন গতিতে ছুটে চলেছে। এই মহাসড়কে যদি হঠাৎ দুটি গাড়ির সংঘর্ষ হয়, তবে ছিটকে পড়া ধ্বংসাবশেষ আরও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, তাই না?
ঘটনাটি কিন্তু কেবল কল্পনা নয়। সত্যি সত্যিই যখন মহাকাশে দুটি উপগ্রহ বা স্পেস জাঙ্কের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, তখন অসংখ্য টুকরো টুকরো ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয়। এই ধ্বংসাবশেষ আবার নতুন উপগ্রহকে আঘাত হানে। তৈরি হয় আরও নতুন ধ্বংসাবশেষ। এই চেইন প্রতিক্রিয়াকে বিজ্ঞানীরা বলেন কেসলার সিনড্রোম।
পৃথিবীর চারপাশে ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে আছে লাখ লাখ স্পেস জাঙ্ক। পুরোনো মৃত উপগ্রহ, ব্যবহৃত রকেটের অংশ, এমনকি নাট-বল্টু বা রঙের খোসাও রয়েছে এই আবর্জনার তালিকায়। কিন্তু সমস্যা হলো, এদের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার! এত বিশাল গতিতে ছুটে আসা একটি ছোট্ট নাটও একটি কার্যকর স্যাটেলাইটকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে।
তাই প্রতিটি সংঘর্ষে তৈরি হয় নতুন নতুন টুকরো। সেই নতুন টুকরো আবার আরেকটি সংঘর্ষ ঘটায়। কক্ষপথ ক্রমশ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের জিপিএস, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ইন্টারনেট কিংবা যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো অগণিত প্রযুক্তি বিপদের মুখে পড়ে।
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার বিজ্ঞানী ডোনাল্ড কেসলার ১৯৭৮ সালে তাঁর একটি গবেষণাপত্রে প্রথম এ ধারণাটি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেন। অনেকে ভাবতে পারেন, এটা হয়তো অনেক দূরের কোনো ঝুঁকি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেশ কিছু ঘটনা কেসলার সিনড্রোমকে এর মধ্যেই সত্যি করে তুলতে শুরু করেছে।
দুটি ঘটনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০০৭ সালে চীন নিজেদের একটি পুরোনো আবহাওয়া স্যাটেলাইট ধ্বংস করতে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে। মাত্র একটি ঘটনায় কয়েক হাজার শনাক্তকরণযোগ্য টুকরো আবর্জনা পৃথিবীর কক্ষপথে যুক্ত হয়।
মহাকাশে আবর্জনার এই সমস্যা আমাদের চোখের আড়ালে থাকলেও এর প্রভাব প্রতিদিন আমাদের জীবনে পড়ছে। প্রতিটি নতুন সংযোজন আমাদের জন্য সুবিধা বয়ে আনলেও, একই সঙ্গে ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
২০০৯ সালে রাশিয়ার একটি নিষ্ক্রিয় স্যাটেলাইট এবং আমেরিকার একটি সক্রিয় ইরিডিয়াম স্যাটেলাইটের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। ফলে তৈরি হয় আরও হাজার হাজার টুকরো। এখন পর্যন্ত এই টুকরোগুলো মহাকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং নতুন স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি করছে।
বিজ্ঞানীরা কেসলার সিনড্রোমের অগ্রগতিকে কয়েকটি ধাপে ব্যাখ্যা করেন:
১. শনাক্ত করা যায় না এমন ক্ষুদ্র টুকরোর মধ্যে সংঘর্ষ।
২. ক্ষুদ্র টুকরোর বড় স্যাটেলাইটে আঘাত হানা।
৩. বড় আকারের ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে আরেকটি বড় বস্তুর সংঘর্ষ।
৪. সংঘর্ষগুলো চেইন বিক্রিয়ার মতো একের পর এক ঘটতে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া।
প্রথম তিনটি ধাপ এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। বর্তমানে নিম্নকক্ষপথে ১ মিলিমিটারের চেয়ে বড় আকারের প্রায় ১৪ কোটির বেশি ছোট-বড় টুকরো রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। সেগুলোর বেশিরভাগই শনাক্ত করা সম্ভব নয়। স্টারলিংকের মতো বড় স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ককে সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য প্রতি মাসে কয়েক হাজারবার স্যাটেলাইটের কক্ষপথ পরিবর্তন করতে হয়। কিছু নির্দিষ্ট উচ্চতা—যেমন ৭৭৫ কি.মি. বা ৮৪০ কি.মি.—এখন ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে ধ্বংসাবশেষের ঘনত্ব এত বেশি যে, একটি বড় সংঘর্ষই নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে।
মহাকাশে আবর্জনার এই সমস্যা আমাদের চোখের আড়ালে থাকলেও এর প্রভাব প্রতিদিন আমাদের জীবনে পড়ছে। প্রতিটি নতুন সংযোজন আমাদের জন্য সুবিধা বয়ে আনলেও, একই সঙ্গে ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। তবে সমাধানের পথও খোঁজা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে, যেমন অ্যাকটিভ ডেব্রিস রিমুভাল (ADR)–এর মাধ্যমে বিশেষ রোবটযান বা নভোযান ব্যবহার করে পুরোনো স্যাটেলাইটকে বায়ুমণ্ডলে নামিয়ে আনা। সেখানে তা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। একই সঙ্গে নেট বা হারপুন দিয়ে ধ্বংসাবশেষ ধরার প্রকল্পও চলছে।
আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নিই, তবে ভবিষ্যতের মহাকাশ হয়ে উঠবে মাইনফিল্ডের মতো। সেখানে প্রতিটি নতুন উপগ্রহ উৎক্ষেপণ মানেই হবে এক অজানা ঝুঁকি।
শক্তিশালী লেজার রশ্মি ব্যবহার করেও টুকরোগুলোকে ধীরে ধীরে কক্ষপথ থেকে সরানোর পরীক্ষা চলছে। তবে কেবল প্রযুক্তি নয়, নীতিমালারও নবায়ন প্রয়োজন। মহাকাশ চুক্তি (Outer Space Treaty, 1967) আজকের জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অনেকটাই পুরোনো হয়ে গেছে। আধুনিক সময়ের জন্য আন্তর্জাতিক ‘স্পেস ট্র্যাফিক কন্ট্রোল’ ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। কে, কোথায়, কত উপগ্রহ পাঠাতে পারবে এবং দুর্ঘটনার দায়ভার কীভাবে ভাগ করা হবে, তা সেখানে নির্ধারিত হবে। জাতিসংঘের UNOOSA (United Nations Office for Outer Space Affairs) মতো সংস্থাগুলো এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সমন্বয় তৈরিতে কাজ করছে। এই সমস্যার সমাধান কোনো দেশের পক্ষে এককভাবে করা সম্ভব নয়। মহাকাশ যেহেতু সবার, তাই এর সুরক্ষার দায়িত্বও সবাইকে নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক সমন্বয়, কঠোর নীতিমালা আর নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা না হলে মহাকাশের এই মহাসড়ক একদিন সত্যিই অচল হয়ে যাবে। এডিআর-এর মতো উদ্যোগ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্র্যাকিং সিস্টেম এর মধ্যেই তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এগুলোর প্রয়োগ আরও বিস্তৃত ও বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নিই, তবে ভবিষ্যতের মহাকাশ হয়ে উঠবে মাইনফিল্ডের মতো। সেখানে প্রতিটি নতুন উপগ্রহ উৎক্ষেপণ মানেই হবে এক অজানা ঝুঁকি। স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট বিপর্যস্ত হবে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে এবং মহাকাশে মানুষের যাত্রা হবে আরও বিপজ্জনক।
কেসলার সিনড্রোম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সংখ্যা বাড়লেই সব সময় সাফল্য আসে না। মাঝেমধ্যে সেটাই বিপদ হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে যেমন বন বা সাগর রক্ষা করা জরুরি, তেমনি প্রযুক্তির অগ্রযাত্রার জন্য মহাকাশকেও রক্ষা করা জরুরি।
সবশেষে প্রশ্ন একটাই, আমরা কি আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্মুক্ত ও নিরাপদ মহাকাশ রেখে যেতে পারব, নাকি তাদের জন্য রেখে যাব ভাঙা টুকরোর এক বিপজ্জনক ফাঁদ? এর উত্তর নির্ভর করবে আমাদের এই সময়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর ওপর।