ধূমকেতু। ধোঁয়ার মতো ধুলো-গ্যাসের কেতন উড়িয়ে ছুটে চলে মহাকাশ চিরে। গ্রহ-উপগ্রহ, গ্রহাণু বা নক্ষত্রের সঙ্গে এই মহাজাগতিক বস্তুর মূল পার্থক্য লেজ। আকারে ছোটখাটো গ্রাম বা শহরের মতো। সাধারণত বরফকণা, ধুলো আর পাথরে গঠিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, সৌরজগৎ গঠনের পর অবশিষ্টাংশ থেকে তৈরি এসব ধূমকেতুর আদি অবস্থান ছিল কুইপার বেল্ট ও ওর্ট ক্লাউড অঞ্চলে। গ্রহের আকর্ষণে সময়ের পরিক্রমায় কখনো-সখনো এদের কোনো কোনোটা আটকা পড়ে সূর্যের চারপাশে ভিন্ন এক কক্ষপথে। এরপরই শুরু হয় লেজ ছড়িয়ে ছুটে চলা। লেজের কারণে নিয়মিত নিজের উপাদান হারায় ধূমকেতু। প্রশ্ন হলো, এভাবে কি ধূমকেতুর উপাদান একেবারে ফুরিয়ে যায়? ধূমকেতুর শেষ পরিণতিটা আসলে কেমন?
উত্তর জানতে ধূমকেতুর মৌলিক গঠনটা একটু বলে নেওয়া দরকার। মূলত তিনটি অংশ থাকে। এক, নিউক্লিয়াস। ধূমকেতুর সবচেয়ে কঠিন অংশ। মাথার দিকে থাকে। চাইলে কেন্দ্রও বলতে পারেন। পাথর, ধুলো ও বরফ দিয়ে তৈরি। দুই, কোমা। গ্যাস ও ধুলোর তৈরি এ অংশ নিউক্লিয়াসের চারপাশ ঘিরে তৈরি হয়। বিশেষ করে ধূমকেতু যখন সূর্যের কাছাকাছি চলে যায়। আসলে, এই দুইয়ে মিলেই মূল ধূমকেতু।
সবশেষের অংশটি লেজ। মহাশূন্যে লাখো কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে যায়। ধূমকেতুর ছুটে চলার দিকের বিপরীতে এর অবস্থান। এটাও গ্যাস ও ধূলিকণা দিয়ে তৈরি। এসব কণা ধূমকেতুর মূল অংশ থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে নিজের উপাদান হারিয়ে বিলীন হয়ে যায় অসীম শূন্যতায়।
অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন, গ্রহাণু আসলে এক্সটিঙ্ক কমেট বা মলিন ধূমকেতু। তবে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই
ধূমকেতুর এই বিলীন হওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে সূর্য। সূর্যের কাছাকাছি গেলে প্রচণ্ড উত্তাপে ধূমকেতুর কেন্দ্রের বরফ সরাসরি গ্যাস বা বাষ্পে পরিণত হয়। এই গ্যাস ও ধূমকেতুর ধূলিকণা মিলেমিশে তৈরি করে ধূমকেতুর কোমা ও লেজ।
প্রতিবার সূর্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা করে বরফ ও গ্যাস হারায় ধূমকেতু। এগুলোই দেখা যায় লেজ হিসেবে। অর্থাৎ ধূমকেতুর লেজ হলো ক্ষয়ে যাওয়ার চিহ্ন। সময়ের সঙ্গে সূর্যকে বারবার প্রদক্ষিণ করতে করতে ধূমকেতু হারাতে থাকে বরফ ও উদ্বায়ী উপাদান। একটা সময় আর লেজ তৈরির মতো উপাদান অবশিষ্ট থাকে না।
ধূমকেতুর উদ্বায়ী উপাদান ফুরিয়ে গেলেও সেটা সূর্যের চারদিকে ঘুরতে পারে। কোমা বা লেজ ছাড়া এসব ধূমকেতুকে বলা হয় এক্সটিঙ্কট কমেট। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন, গ্রহাণু আসলে এক্সটিঙ্ক কমেট বা মলিন ধূমকেতু। তবে এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই।
ধূমকেতুর উপাদান ফুরিয়ে আসার হার কিন্তু খুব ধীর। গড়পড়তা একটি ধুমকেতুর ভর হয় প্রায় ১০১৩ কেজির মতো। সূর্যের কাছাকাছি গেলে এদের সক্রিয়তা, অর্থাৎ লেজের পরিমাণ বাড়ে। সূর্য থেকে দূরে গেলে কমে। সব সময় যদি এদের ক্ষয়হার একই ধরে হিসেব করা হয়, তাতেও সাধারণ একটি ধূমকেতুর জীবনকাল শেষ হতে প্রয়োজন প্রায় ২ হাজার বছরের বেশি সময়। মহাজাগতিক সময়কালে শত-সহস্র বছর কিছুই না আসলে। চোখের পলক ফেলার মতো ঘটনা। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা অনেক বড় সময়। এ কারণেই আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একই ধূমকেতুর ছুটে চলা দেখি। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হ্যালির ধূমকেতু। আকাশে দেখা দিয়ে যায় প্রায় ৭৫ বছর পরপর।