১৯৭২ সালের এপ্রিল। পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরে। ধুলোয় মাখামাখি চাঁদের মাটিতে হাঁটছিলেন দুই মানুষ—চার্লস ডিউক আর জন ইয়ং। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। কোনো জনমানব তো দূরের কথা, প্রাণ বলতে আমরা যা বুঝি, তার কোনো অস্তিত্ব নেই সেখানে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার চন্দ্র অভিযানে সেবার চাঁদে গিয়েছিলেন এই দুই নভোচারী। অ্যাপোলো ১৬ মিশন।
চাঁদের মাটিতে বেশকিছু হাঁটলেন দুজন। ছবি তুললেন নানা ভঙ্গিমায়। সংগ্রহ করলেন চাঁদের ধুলো, পাথর। সবশেষে ফিরলেন নিজেদের মডিউলে। সেখানে ফিরেই একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে এসে লাগল দুই নভোচারীর। ঠিক যেন পোড়া বারুদের মতো গন্ধ। একটু যেনো থমকে গেলেন দুজন। চাঁদে তো কোথাও আগুন লাগেনি, কেউ পটকা বা বাজিও ফোটায়নি, তাহলে এই গন্ধের উৎসটা কী?
খেয়াল করে দেখা গেল, তাঁদের স্যুট থেকে ঝরে পড়া চাঁদের সূক্ষ্ম ধুলো কেবিনের বাতাসে মিশে গেছে। আর সেই ধুলো তাঁদের নাক-মুখে ঢুকে পড়েছিল নিঃশ্বাসের সঙ্গে। পরে নভোচারী ডিউক বলেছিলেন, ঠিক যেন পিস্তল চালানোর পর যে গন্ধটা পাওয়া যায়, ঠিক সেইরকম।
চাঁদের ধুলো পৃথিবীতে এনে পরীক্ষাও করা হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীতে আনার পর সেই গন্ধটা আর পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না, ঠিক কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে এই গন্ধ হয়।
মিশন শেষে পৃথিবীতে ফিরলেন এই দুই নভোচারী। সঙ্গে নিয়ে এলেন চাঁদের ধুলো, পাথর, একগাদা ছবি আর অভিজ্ঞতার ঝুলি। পৃথিবীতে আসার পর চাঁদের ধুলো পরীক্ষা করে দেখা হলো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, তেমন কোনো গন্ধ পাওয়া গেল না!
শুধু অ্যাপোলো ১৬-ই নয়, এর আগে এবং পরের চন্দ্রাভিযানে নভোচারীরা একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। অ্যাপোলো ১৭ মিশনে নভোচারী ছিলেন হ্যারিসন জ্যাক শ্মিট। তিনি ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ। সেই মিশনে তাঁর সঙ্গী নভোচারী ইউজিন সেরনানকে তিনি বলেছিলেন, ‘গন্ধটা একেবারে পোড়া বারুদের মতো’। কিন্তু চমক এখানেই থেমে থাকেনি। শ্মিট জানান, চাঁদের ধুলোয় নাকি তাঁর অ্যালার্জি হয়েছিল! নাক বন্ধ, চোখে অস্বস্তি। গ্রাউন্ড কন্ট্রোল তখন ঠাট্টা করে বলেছিল, শ্মিট বুঝি সঙ্গে করে হে ফিভারের সেন্সর নিয়ে গেছেন!
কিন্তু চাঁদের ধূলিতে এরকম গন্ধ থাকার কারণ কী? আর পৃথিবীতে আনার পর তা উবে যাওয়ার কারণটাই-বা কী?
সেটা আজও রহস্য। চাঁদের ধুলো পৃথিবীতে এনে পরীক্ষাও করা হয়েছে, কিন্তু পৃথিবীতে আনার পর সেই গন্ধটা আর পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না, ঠিক কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে এই গন্ধ হয়। আর কেনই-বা গন্ধটা পৃথিবীতে এসে স্রেফ উবে যায়। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন, পৃথিবীতে অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া হওয়ার আগেই সেই ধুলোর গন্ধটা হয়তো হারিয়ে যায়।
পৃথিবীতে যারা খনির কাজ করে, তারা সূক্ষ্ম খনিজ ধুলো শ্বাস নেয়। বিশেষ করে কোয়ার্টজ। কোয়ার্টজ নিজে বিষাক্ত না হলেও এর গুঁড়ো কাঁচের মতো ক্ষুদ্র ও ধারালো।
তবে গন্ধ নিয়ে যতই রহস্যই থাক, আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। চাঁদের ধুলো দেখতে নিরীহ হলেও তা কিন্তু ভয়ঙ্কর। পৃথিবীর ধুলো যেমন নদীর ঘষামাজা পাথরের মতো মসৃণ, চাঁদের ধুলো ঠিক তার উল্টো। সেগুলো ধারালো, খসখসে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁচের কণার মতো। অসংখ্য উল্কাপিণ্ডের আঘাতে যে পাথর ভেঙে চূর্ণ হয়েছে, বাতাসের অভাবে তার কোনো প্রান্ত নরম হয়নি। ফলে এই ধুলো নভোচারীদের স্যুটে, গ্লাভসে, কিংবা ফিল্টারে ঢুকে পড়লে সেটা শুধু যন্ত্রপাতির ক্ষতি নয়, তাঁদের শরীরের ভেতরেও শুরু করে ক্ষয়।
চাঁদের ধুলো এতই সূক্ষ্ম আর তীক্ষ্ণধার যে, অ্যাপোলো মিশনের সময় ভ্যাকুয়াম সিল করা কিছু ব্যাগও ছিঁড়ে গিয়েছিল। অক্সিজেন ঢুকে সেগুলো দূষিত হয়ে পড়েছিল। আর এই ধুলো নভোচারীদের স্যুটে লেগে গেলে, সেগুলো ঝেড়ে ফেললেও সেভাবে দূর করা যেত না। স্থির বিদ্যুতের কারণে ধুলো এমনভাবে স্যুটের সঙ্গে আটকে থাকত, যেন ইচ্ছা করেই আলগা হচ্ছে না।
নভোচারীরা যখন চাঁদের মাটিতে হাঁটু গেড়ে বিভিন্ন ধরনের নমুনা সংগ্রহ করতেন, তখন তাঁদের স্যুটে, গ্লাভসে, এমনকি মুখের কাছে থাকা ফিল্টারেও ধুলো ঢুকে যেত। কেউ কেউ বলেছেন, এই ধুলো চোখে-মুখে গেলে চুলকানিও হতো। আর শ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকে গেলে, তখন ক্ষতিটা হতো আরও মারাত্মক।
আসলে এগুলো শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে ভেতরে গেলে ফুসফুসের টিস্যুর মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, যা সহজে সারে না। কারণ ধুলোর কণাগুলো এত ছোট আর ধারালো হয় যে, কাশলেও সেগুলো বের করা যায় না। ফলে সেগুলো ফুসফুসে গেঁথে থাকে, ক্রমাগত ক্ষতি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মারাত্মক নিউমোনিয়ার মতো সমস্যা তৈরি করে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের জন্য মঙ্গলের ধুলো সম্ভবত আরও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। মঙ্গলের ধুলোও কাঁচের গুঁড়োর মতো ধারালো। তাছাড়া সেগুলো আমাদের দেহের জন্য খারাপ।
বিজ্ঞানীরা বলেন, এই ধুলোর প্রভাব অনেকটা সিলিকোসিস রোগের মতো। পৃথিবীতে যারা খনির কাজ করে, তারা সূক্ষ্ম খনিজ ধুলো শ্বাস নেয়। বিশেষ করে কোয়ার্টজ। কোয়ার্টজ নিজে বিষাক্ত না হলেও এর গুঁড়ো কাঁচের মতো ক্ষুদ্র ও ধারালো। তাই সেগুলো মানুষের ফুসফুসে গিয়ে চিরস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। চাঁদের ধুলোও তেমনি—ক্ষুদ্র, ধারালো এবং ভয়াবহ।
চাঁদের ধুলো যে এত সহজে লুনার মডিউলে ঢুকে পড়ে এবং শ্বাস নেওয়ার সময় শরীরেও প্রবেশ করে, তা ভবিষ্যতে চাঁদে দীর্ঘ সময় থাকার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একটা বড় চিন্তার কারণ। কারণটা তো বুঝতেই পারছেন—চাঁদের ধুলো মোটেই আমাদের শ্বাসযন্ত্রের জন্য ভালো নয়।
এই সমস্যা শুধু চাঁদের নয়, মঙ্গলের ক্ষেত্রেও রয়েছে। সেটা বরং আরও জটিল। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মানুষের জন্য মঙ্গলের ধুলো সম্ভবত আরও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। মঙ্গলের ধুলোও কাঁচের গুঁড়োর মতো ধারালো। তাছাড়া সেগুলো আমাদের দেহের জন্য খারাপ। নাসার পাঠানো নভোযান ফিনিক্স ল্যান্ডার দিয়ে মঙ্গলের মাটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেখানকার মাটি খুব বেশি অ্যাসিডিক বা ক্ষারীয় নয়। কিন্তু মঙ্গলের ধুলোতে এমন সব রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা পানিতে মিশলে তৈরি করে হাইড্রোজেন পারক্সাইড। সেটা কোয়ার্টজের ধুলোর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। এমন ধুলো শুধু ফুসফুস নয়, ত্বক আর চোখেরও ক্ষতি করতে পারে।
তাই ভবিষ্যতে যদি মানুষ চাঁদে কিংবা মঙ্গলে দীর্ঘ সময় থাকার পরিকল্পনা করে, তাহলে সবচেয়ে বড় বাধা হবে এই ধুলো। শুধু রোভার, ক্যাম্প বা স্যুট বানালেই চলবে না, তাদের ধুলোপ্রতিরোধীও হতে হবে। এমনকি বায়ুচাপ নিয়ন্ত্রিত এমন ঘর বানাতে হবে, যেখানে ধুলো ঢুকতে পারবে না। তা না হলে, চাঁদে বা মঙ্গলে পাঠানো অভিযাত্রীদের অকালমৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
