বন্ধ হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন, এরপর নভোচারীরা কোথায় থাকবেন

আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনছবি: নাসা

২০০২ সালের ২ নভেম্বর। আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগের কথা। বিল শেফার্ড, ইউরি গিডজেঙ্কো এবং সের্গেই ক্রিকালেভ নামে তিন নভোচারী প্রথমবার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গেলেন থাকার জন্য। আর সেদিনই একটা ইতিহাস রচিত হলো। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও মহাকাশ স্টেশন মানুষহীন থাকেনি! পৃথিবীর কোনো না কোনো মানুষ সবসময়ই তাদের জন্মভূমি ছেড়ে মহাকাশে গিয়ে থেকেছেন। 

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস ছিল এক বিশাল বিপ্লব। এটি কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের ছিল না, বরং ১৫টি দেশের যৌথ চেষ্টায় এটি তৈরি হয়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, কানাডা ও ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি অন্যতম। এই স্টেশনটি বানাতে মোট ৪২ বার নভোযান পাঠাতে হয়েছে! মানে আইএসএস সম্পূর্ণ পৃথিবীতে বানিয়ে তারপর মহাকাশে পাঠানো হয়নি। বরং আলাদা আলাদা অংশ মহাকাশে পাঠিয়ে সেখানেই এটা তৈরি হয়েছে। গত ২৫ বছরে ২৬টি দেশের ২৫০ জনেরও বেশি নভোচারী এই স্টেশনে গিয়েছেন। তাঁরা সেখানে ১০০টিরও বেশি দেশের গবেষকদের জন্য হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ওষুধ তৈরি থেকে শুরু করে পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সব রহস্যের সমাধান করেছেন পৃথিবীর ৪১০ কিলোমিটার ওপরে ভেসে ভেসে। 

মির স্পেস স্টেশন
ছবি: উইকিপিডিয়া

পৃথিবীর ৪১০ কিলোমিটার ওপরে কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বল প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ করে! তাহলে প্রশ্ন হলো, নভোচারীরা ভেসে থাকেন কীভাবে? এর আসল কারণ হলো গতি! আইএসএস কোনো রকেটের জ্বালানির ওপর নির্ভর করে ভেসে থাকে না। এটি আসলে পৃথিবীর দিকে সবসময় পড়তে থাকে। কিন্তু এটি একই সঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে ৭.৬৬ কিলোমিটার বা ঘণ্টায় প্রায় ২৭ হাজার কিলোমিটার বেগে সামনের দিকেও ছুটছে। এই প্রচণ্ড গতির কারণেই এটি পড়তে পড়তেও পড়ে না। বরং পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতেই থাকে। আর এই অবিরাম পড়ে যাওয়ার কারণেই ভেতরের সবকিছু ওজনহীন বা ভেসে থাকে। একে বলে মাইক্রোগ্র্যাভিটি।

একটা সুতোর এক মাথায় ছোটো ভারী কিছু বেঁধে দিন। একটা চাবির গোছা বা ছোটো পাথরও হতে পারে। সুতার অন্য প্রান্তটা নিজের আঙুলে পেঁচিয়ে নিন। এবার আঙুল দিয়ে সুতাসহ ঘুরাতে শুরু করুন। দেখবেন, সুতোর মাথায় বাঁধা জিনিসটা গোল করে ঘুরতে থাকবে। যতক্ষণ আপনি আঙুল ঘোরাতে থাকবেন, ততক্ষণ সেই ভারী জিনিসটাও ঘুরতে থাকবে। কিন্তু একবার হাত থামিয়ে দিলে, ওটা ধীরে ধীরে ঘোরা বন্ধ করবে আর নিচে পড়ে যাবে। কারণ তখন আর কোনো শক্তি তাকে ঘুরিয়ে রাখছে না। আইএসএসও পৃথিবীর চারপাশে এমন একই গতিতে ঘোরে বলে পৃথিবীতে পড়ে যায় না। 

আরও পড়ুন
রাজনীতি যা-ই হোক, ২০৩১ সালে আইএসএসকে ধ্বংস হতেই হবে। স্কাইল্যাব বা মির স্টেশনের মতোই একে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে। এর শেষ ঠিকানা হবে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক নির্জন জায়গায়।

কিন্তু এতক্ষণ যে মহাকাশ স্টেশন নিয়ে আলোচনা করলাম, তা আয়ু প্রায় শেষের দিকে। আইএসএস এখন বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। এর মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ২০৩১ সালেই এটিকে অবসরে পাঠানো হবে। কিন্তু এই অবসর নিয়েও শুরু হয়েছে নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েন। এতদিন আইএসএসকে ঠিক কক্ষপথে রাখার জন্য কাজ করত রাশিয়ার সয়ুজ রকেট। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। ফলে রাশিয়া এই কাজ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। এই হুমকির পর নাসা দ্রুত স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুল দিয়ে ওই একই কাজ করা যায় কিনা, তা পরীক্ষা করে। পরীক্ষা সফলও হয়। 

রাজনীতি যা-ই হোক, ২০৩১ সালে আইএসএসকে ধ্বংস হতেই হবে। স্কাইল্যাব বা মির স্টেশনের মতোই একে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে। এর শেষ ঠিকানা হবে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক নির্জন জায়গায়। সেই জায়গার নাম 'পয়েন্ট নেমো'। এটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জনতম স্থান। এর সবচেয়ে কাছের দ্বীপটিও প্রায় ২ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দূরে! ফলে মানুষের ক্ষতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। 

এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সামনে আসবে। আইএসএস শেষ হয়ে গেলে মহাকাশে মানুষের এই একটানা থাকার রেকর্ড কি ভেঙে যাবে? মানুষ কি আর মহাকাশে থাকবে না? না, চিন্তার কিছু নেই। মহাকাশে মানুষের বসবাস বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। আইএসএসের উত্তরসূরি হিসেবে হয়তো কাজে লাগানো হবে চীনের তিয়াংগং স্পেস স্টেশনকে। এটিই এখন মহাকাশে একমাত্র দ্বিতীয় স্থায়ী স্পেস স্টেশন। যদিও এটি আইএসএসের তুলনায় প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। অন্যান্য দেশও পিছিয়ে নেই। রাশিয়াও নিজেদের স্টেশন বানানোর কথা বলছে। ভারতও ২০৩৫ সালের মধ্যে নিজস্ব স্টেশন চালু করার পরিকল্পনা করছে।

আরও পড়ুন
এখন হয়তো আরেকটি আইএসএস বানানোর পরিকল্পনা নেই নাসার। কিন্তু ভবিষ্যতে যে আরেকটি মহাকাশ স্টেশন বানাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

নাসা ঠিক করেছে, তারা এখন পৃথিবীর কক্ষপথে নিজেরা স্টেশন না বানিয়ে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে দিয়ে স্টেশন বানাবে। পাশাপাশি নাসা এখন মানুষকে চাঁদে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। প্রথমে চাঁদের কক্ষপথে একটি নতুন গেটওয়ে স্টেশন তৈরি করা হবে। তারপর চাঁদের মাটিতেই তৈরি হবে একটি স্থায়ী ঘাঁটি। সেখানেই বিজ্ঞানীরা গিয়ে নানা গবেষণা করবেন। ইতিমধ্যে সেই পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। চাঁদে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আর্টেমিস প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। এই প্রোগ্রামের প্রথম মিশন আর্টেমিস ১ ইতিমধ্যে সফল হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে আর্টেমিস ২ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা আছে। আর সবশেষ ২০২৭ সালে আর্টেমিস ৩ মিশনে মানুষ আবার চাঁদে পৌঁছাবে। 

সুতরাং, মানুষ মহাকাশে সব সময়ই থাকবে। আর এখন হয়তো আরেকটি আইএসএস বানানোর পরিকল্পনা নেই নাসার। কিন্তু ভবিষ্যতে যে আরেকটি মহাকাশ স্টেশন বানাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া নাসা স্পেস স্টেশন না বানালেও অন্য দেশগুলো তো কাজ চালিয়েই যাচ্ছে। ফলে চিন্তার কোনো কারণ নেই!

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটভেঞ্চ

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স, নাসা