ইউরেনাসের ছোট চাঁদগুলো এত অদ্ভুতুড়ে কেন

ইউরেনাসের নীল পৃষ্ঠে হালকা মেঘ ও একটি নিরক্ষীয় অঞ্চল স্পষ্ট, আর মেরু অঞ্চলের ওপর ঝুলে আছে একটি বৃহৎ ফ্যাকাশে মেঘছবি: নাসা

সৌরজগতের অদ্ভুতুড়ে গ্রহের তকমা দেওয়া যায় ইউরেনাসকে। এই গ্রহটি সোজা হয়ে না ঘুরে, কাত হয়ে লাটিমের মতো ঘোরে। এবার জানা গেল, শুধু গ্রহটা নয়, এর উপগ্রহগুলোও ঘোরে অদ্ভুতভাবে। অর্থাৎ ইউরেনাসের দূরের বড় চাঁদগুলোর সঙ্গে এদের কোনো মিল নেই। এরা কালো, লালচে আর ভীষণ শুকনো!

যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ম্যাট হেডম্যান ও তাঁর দল জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন এক নতুন চিত্র। আগামী ১৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্সে অনুষ্ঠিতব্য আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে বিজ্ঞানীরা এই তথ্য তুলে ধরবেন।

১৯৮৬ সালে ভয়েজার-২ যখন ইউরেনাসের পাশ দিয়ে গিয়েছিল, তখন গ্রহটাকে খুব বেশি জানাশোনার সুযোগ হয়নি। ভয়েজার তখন ১১টি নতুন চাঁদ খুঁজে পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর আসল রূপ বোঝা যায়নি। এত দিন আমরা জানতাম, ইউরেনাসের মোট চাঁদ ২৭টি। কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এবার ইনফ্রারেড বা অবলোহিত রশ্মির সাহায্যে জানিয়েছে গ্রহটির ভেতরের খবর। ফলে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮।

ম্যাট হেডম্যান বলছেন, ‘ইনফ্রারেড আলোতে ইউরেনাস গ্রহটি বেশ অনুজ্জ্বল দেখায়। আর ঠিক এই সুযোগেই এর চারপাশের ছোট চাঁদগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখা সম্ভব হয়েছে।’

আরও পড়ুন
এত দিন আমরা জানতাম, ইউরেনাসের মোট চাঁদ ২৭টি। কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এবার অবলোহিত রশ্মির সাহায্যে জানিয়েছে গ্রহটির ভেতরের খবর। ফলে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮।

দেখা গেল, ইউরেনাসের কাছে থাকা ছোট চাঁদগুলো দেখতে বড় চাঁদের মতো বরফশীতল নয়। বরং এদের পৃষ্ঠ বা ওপরিভাগ অনেক বেশি লালচে এবং অন্ধকার। আর পানি? নেই বললেই চলে!

তবে সব গল্পের একটা ব্যতিক্রম চরিত্র থাকে। ইউরেনাসের এই লাল ও কালো চাঁদের ভিড়েও এমন একটা চরিত্র আছে। সেটি অন্যগুলো থেকে আলাদা। এর নাম ‘ম্যাব’।

গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জ্যাকব হারম্যান জানিয়েছেন, অন্য সব ছোট চাঁদ যখন লাল আর খটখটে শুকনো, তখন ম্যাব নীলচে। এই উপগ্রহে আছে পানিও। অনেকটা ইউরেনাসের বড় চাঁদ মিরান্ডার মতো। বিজ্ঞানীদের ধারণা, হয়তো সুদূর অতীতে মিরান্ডার সঙ্গে ম্যাবের কোনো সংঘর্ষ হয়েছিল। ইউরেনাসের মিউ রিং তৈরির পেছনেও হয়তো এই ম্যাবের ভূমিকা আছে।

ইউরেনাসের বড় চাঁদ মিরান্ডা
ছবি: উইকিপিডিয়া

মিউ রিং হলো ইউরেনাসের খুব সূক্ষ্ম ও ধুলোময় একটি বলয়। এটি আছে ইউরেনাসের প্রধান বলয়গুলোর বাইরে। এটি মূলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধুলিকণায় তৈরি। এই রিং এতটাই পাতলা যে সাধারণ টেলিস্কোপে একে দেখা যায় না। ১৯৮৬ সালে নাসার ভয়েজার–২ নভোযান ইউরেনাসের পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় প্রথম এই বলয়টির অস্তিত্ব ধরা পড়ে।

তবে এখানেই চমকের শেষ নয়। বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে যেখানে চাঁদগুলোকে থাকার কথা ভেবেছিলেন, বাস্তবে গিয়ে দেখেন সেগুলো সেখানে নেই! ভয়েজার ২-এর পুরোনো হিসাবের সঙ্গে জেমস ওয়েবের নতুন পর্যবেক্ষণে মিল পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে কিউপিড এবং পার্ডিতা নামে ছোট চাঁদগুলো রীতিমতো জায়গা বদল করেছে। কর্ডেলিয়া ও ওফেলিয়াও ঠিক জায়গায় নেই।

আরও পড়ুন
গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক জ্যাকব হারম্যান জানিয়েছেন, অন্য সব ছোট চাঁদ যখন লাল আর খটখটে শুকনো, তখন ম্যাব নীলচে। এই উপগ্রহে আছে পানিও। অনেকটা ইউরেনাসের বড় চাঁদ মিরান্ডার মতো।

এর কারণ কী? হতে পারে ইউরেনাসের জগৎটা আমাদের ভাবনার চেয়েও অনেক বেশি বিশৃঙ্খল। এর মধ্যেই আবার উঁকি দিয়েছে নতুন এক অতিথি। বিজ্ঞানীরা ইউরেনাসের এপসিলন রিংয়ের ঠিক বাইরে নতুন একটা চাঁদ খুঁজে পেয়েছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে S/2025 U1।

S/2025 U1
ছবি: সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ম্যাগাজিন

ইউরেনাস আমাদের সৌরজগতের এমন এক রহস্যপুরী, যেখানে আমরা মাত্র একবারই গিয়েছি। মানে ভয়েজার-২ গেছে আরকি। জেমস ওয়েব এখন দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছে, আর তাতেই বেরিয়ে আসছে একের পর এক চমক। লাল চাঁদ, নীল চাঁদ আর পথ হারানো চাঁদ মিলিয়ে ইউরেনাসের সংসারটা বেশ জটিল। ভবিষ্যতে হয়তো আরও ভালো কোনো মিশন গেলে জানা যাবে, কেন ইউরেনাসের ছোট চাঁদগুলো এমন পোড়া ইটের মতো লাল হলো।

 

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা

সূত্র: স্পেস ডটকম

আরও পড়ুন