মহাকাশে অনেক জায়গাতেই দেখা যায় আবছা আলোর দ্যুতি। নক্ষত্রের চারদিকে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়, যা থেকে রংবেরঙের আলো বেরোতে দেখি আমরা। সেই রঙের সমারোহ তাক লাগানোর মতো! দুরবিনে তোলা নীহারিকার ছবিগুলো তাই আমাদের নজর কাড়ে। দুরবিন আবিষ্কারের পর থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চোখে পড়ছিল মহাকাশের বিভিন্ন অংশে এই রঙিন আলোর আভা। তাঁরা নাম রেখেছিলেন নেবুলা বা নীহারিকা। ইংরেজি ‘নেবুলাস’ শব্দের অর্থ আবছা, সেই জন্য। তবে নীহারিকা কী দিয়ে তৈরি এবং কিসের জন্য সেখান থেকে রংবেরঙের আলো বিকিরিত হয়, সে কথা জানতে অনেক বছর লেগেছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে নীহারিকার রং নিয়ে গবেষণা শুরু হলেও এর প্রকৃত কারণ বোঝা গিয়েছিল বিশ শতকে।
আমরা জানি, একেকটি মৌলিক পদার্থ কিছু বিশেষ রঙের আলো বিকিরণ করে। যেমন সোডিয়াম গরম করলে তা থেকে হলুদ আলো বেরোয়। কোয়ান্টাম বিদ্যা আবিষ্কারের পর এর কারণ বোঝা গিয়েছিল। এর জন্য দায়ী পরমাণুর গঠন। বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুর গঠন ভিন্ন। পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে প্রোটন ও নিউট্রন এবং কেন্দ্রের চারদিকে ইলেকট্রনের দল ঘুরতে থাকে। এই ইলেকট্রনগুলোর শক্তি নির্ধারিত হয় পরমাণুর গঠন অনুযায়ী। তাই বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের ইলেকট্রনগুলোর শক্তির স্তর হয় আলাদা রকমের। একটি ইলেকট্রন যখন কোনো কারণে শক্তি ক্ষয় করে, তখন সেই পরমাণু থেকে একটি আলোর কণা বেরিয়ে আসে। ঠিক যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হয়েছিল, সেটুকু শক্তিই সম্বল থাকে সেই আলোর কণা বা ফোটনের।
দুরবিন আবিষ্কারের পর থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের চোখে পড়ছিল মহাকাশের বিভিন্ন অংশে এই রঙিন আলোর আভা। তাঁরা নাম রেখেছিলেন নেবুলা বা নীহারিকা। ইংরেজি ‘নেবুলাস’ শব্দের অর্থ আবছা, সেই জন্য
আমরা এখন জানি, বিভিন্ন রঙের আলোর কণার শক্তি সমান নয়। আলোকে যদি তরঙ্গ হিসেবে ভাবি, তাহলে রঙের তফাত বলতে বিভিন্ন তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তফাত বোঝায়। নীল রঙের আলোর কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি) লালের তুলনায় বেশি এবং নীল রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য তুলনায় কম। কোয়ান্টাম বিদ্যা আমাদের বলে দেয়, আলোকে তরঙ্গ হিসেবে যেমন ভাবা যায়, তেমনি কণা হিসেবেও ধরা যেতে পারে। তখন সেই কণার শক্তির সঙ্গে কম্পাঙ্কের একটা সম্পর্ক থাকে। কম্পাঙ্ক বেশি থাকার অর্থই হলো শক্তির আধিক্য। অর্থাৎ নীল রঙের আলোর কণার শক্তি লালের চেয়ে বেশি।
মোটকথা, কোনো রঙের আলোর কণার সঙ্গে শক্তির একটা সম্পর্ক আছে এবং সেখানেই ইলেকট্রনের শক্তির প্রসঙ্গ চলে আসে। ইলেকট্রন যখন খুব বেশি শক্তি ক্ষয় করে ফেলে, তখন তা থেকে নীল রঙের আলো বেরোয়। আর কম শক্তি ক্ষয় করলে যে রঙের আলো বেরোয়, তা হয় লালঘেঁষা। যেহেতু বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুর গঠন আলাদা, সেগুলোর ইলেকট্রনের শক্তির মাপও ভিন্ন। তাই ইলেকট্রনগুলোর শক্তি ক্ষয়ের পরিমাণও আলাদা। ফলে নানা মৌলিক পদার্থ থেকে যে আলো বেরিয়ে আসে, তাতে থাকে কিছু বিশেষ রং। একেকটি মৌলিক পদার্থের ক্ষেত্রে সেই রংগুলো আলাদা।
যেমন হাইড্রোজেনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রং হলো ৬৫৬ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর রং। অর্থাৎ লাল। এর পোশাকি নাম বামার (Balmer) সিরিজের প্রথম ‘বর্ণরেখা’ (Spectral line)—কারণ, বর্ণালিতে এই রঙের আলো একটি রেখার মতো দেখায়। মহাবিশ্বে যেহেতু অন্যান্য মৌলিক পদার্থের তুলনায় হাইড্রোজেনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তাই নীহারিকায় এই রঙের আলোই প্রাধান্য পায়।
তবে মাঝেমধ্যে পরমাণুকেন্দ্রের আকর্ষণে ধরা পড়ে যায় স্বাধীন ইলেকট্রনগুলো। তখন ইলেকট্রনগুলো আবার সংসারে এসে ঢোকে, যার জন্য এদের কিছুটা শক্তি খোয়াতে হয়। সেই শক্তি বেরিয়ে আসে আলো রূপে। এভাবেই নীহারিকার গ্যাস আলো বিকিরণ করে
নীহারিকার আলো বিকিরণের ব্যাপারটা আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক। মহাকাশে নক্ষত্র তৈরি হয় গ্যাসপুঞ্জ থেকে। স্বাভাবিকভাবেই নক্ষত্রের চারপাশে বেশ কিছু পরিমাণে গ্যাস রয়ে যায়। সেটাই নীহারিকারূপে আমাদের চোখে প্রতিভাত হয়। এই গ্যাসে থাকে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন। এবারে যখন নতুন নক্ষত্র থেকে আলো বেরোয়, তার প্রভাব গিয়ে পড়ে গ্যাসের ওপর। এই আলোর কণার মধ্যে অনেকগুলো ফোটন থাকে, যেগুলোর শক্তি অনেক বেশি। এদিকে পরমাণুর অধীন ইলেকট্রনগুলোর শক্তি আসলে নেগেটিভ। ঋণাত্মক। শক্তির ব্যাপারে এরা ঋণী বলেই পরমাণুর শাসন মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু যদি কোনো আলোর কণার দৌলতে শক্তি জুগিয়ে সেই ঋণ মওকুফ করিয়ে নিতে পারে, তাহলে ইলেকট্রনটি পরমাণুর বাইরে বেরিয়ে পড়তে পারে। স্বাধীন হিসেবে ঘোরাফেরা করতে পারে গ্যাসের মধ্যে। নীহারিকার গ্যাসে তাই ইলেকট্রনহারা পরমাণু এবং স্বাধীন ইলেকট্রনের বসবাস।
তবে মাঝেমধ্যে পরমাণুকেন্দ্রের আকর্ষণে ধরা পড়ে যায় স্বাধীন ইলেকট্রনগুলো। তখন ইলেকট্রনগুলো আবার সংসারে এসে ঢোকে, যার জন্য এদের কিছুটা শক্তি খোয়াতে হয়। সেই শক্তি বেরিয়ে আসে আলো রূপে। এভাবেই নীহারিকার গ্যাস আলো বিকিরণ করে। আমরা জানি, আলো একেক মৌলিক পদার্থের সংসারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রঙের হয়। হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে শক্তির তৃতীয় স্তর থেকে দ্বিতীয় স্তরে নেমে আসার সময় বেরোয় লাল রঙের আলো। দ্বিতীয় থেকে প্রথম স্তরে নামার সময় যে আলো (লাইম্যান-বর্ণরেখা) বিকিরিত হয়, সেটি হলো অতিবেগুনি রঙের। কিন্তু সেই আলো বেরিয়ে আসতে পারে না নীহারিকা থেকে। শক্তিশালী সেই আলো সেখানকার গ্যাসের কোনো পরমাণুর মধ্যে ঢুকে ইলেকট্রনকে স্বাধীন করে দেয়। অর্থাৎ নীহারিকার গ্যাসেই আটকা পড়ে যায় হাইড্রোজেনের অন্যান্য রঙের আলো। বাকি থাকে লাল রং। সেই আলোতেই উজ্জ্বল হয় নীহারিকার গ্যাস। মনে রাখা উচিত, এই দীপ্তির মূলে রয়েছে নক্ষত্রের আলো। এদের নীল আলোর শক্তিই একসময় ইলেকট্রনকে ঘরছাড়া করে এবং এরা যখন পরমাণুর ঘরে ফিরে আসে, তখন সেই শক্তিই অন্য রঙের আলো হয়ে বেরিয়ে আসে, যার মধ্যে থাকে লাল রঙের প্রাধান্য। তাই এসব নীহারিকার লাল রঙের গ্যাসের মধ্যে দেখা যায় নীল নক্ষত্রের ছড়াছড়ি। মহাকাশে নীল ও লালের এই সমাবেশ মুগ্ধ করে আমাদের।
শুধু লাল নয়, নীহারিকায় অনেক সময় হলদে-সবুজ রঙের আলোও দেখা যায়। সেই আলো আসে অক্সিজেন পরমাণু থেকে। কোয়ান্টাম বিদ্যা আবিষ্কারের আগে এই কথা জানা ছিল না। ১৮৬৪ সালে উইলিয়াম ও মেরি হাগিন্স ক্যাটস আই নীহারিকার বর্ণালিতে একটি হলদে-সবুজ রঙের বর্ণরেখা দেখেছিলেন। প্রায় ৫০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো এটি। এই বিশেষ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করে, এমন কোনো মৌলিক পদার্থ জানা ছিল না তখনকার দিনে। তাই তাঁরা ভেবেছিলেন, এই আলো হয়তো নতুন এক মৌলিক পদার্থের চিহ্ন। তাঁরা নতুন পদার্থের নাম দিয়েছিলেন ‘নেবুলিয়াম’। এখানে উল্লেখ করা যায়, এভাবেই সূর্যের বর্ণালিতে হিলিয়াম আবিষ্কৃত হয়েছিল।
কিন্তু ১৯২৭ সাল নাগাদ বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই হলদে-সবুজ আলো নতুন কোনো মৌলিক পদার্থের সংকেত নয়। এই আলো আসে অক্সিজেনের পরমাণু থেকে বিকিরিত হয়ে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেটা তাহলে বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে আগে ধরা পড়েনি কেন? আগে জানা থাকলে হাগিন্স দম্পতি নতুন এক পদার্থের কথা ভাবতেনই না! এর ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছিল কোয়ান্টাম বিদ্যা আবিষ্কারের পর। অক্সিজেন পরমাণু যখন তার আটটি ইলেকট্রনের একটি হারিয়ে ফেলে, তখনই এই বিশেষ রঙের আলো বেরোয়। বাকি ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে একটির শক্তি এমন মাপের হয় যে সেটা খোয়াতে তার সময় লাগে প্রচুর। গ্যাসের ঘনত্ব যদি বেশি হয়, তাহলে সেই শক্তি ক্ষয়ের আগেই আরেকটি পরমাণুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ইলেকট্রনটি অন্য শক্তিস্তরে চলে যায়। আলো বিকিরণ করার ফুরসত পায় না। পৃথিবীর গবেষণাগারে রাখা অক্সিজেনের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটে। কারণ, এখানে গ্যাসের ঘনত্ব অনেক বেশি। আমাদের বায়ুমণ্ডলে ১ ঘন সেন্টিমিটারে প্রায় ১০১৯ সংখ্যক অণু রয়েছে। অর্থাৎ ১-এর পেছনে ১৯টি শূন্য বসালে যে সংখ্যা দাঁড়ায়, তৎসংখ্যক অণু! এর তুলনায় মহাকাশে গ্যাসের ঘনত্ব খুব কম। ১ ঘন সেন্টিমিটারে ১০০ বা তার চেয়েও কম। তাই সেখানে অন্য পরমাণুর সঙ্গে ধাক্কা লাগার সম্ভাবনাও খুব কম। সুতরাং ইলেকট্রনগুলো ধীরেসুস্থে আলো বিকিরণ করে শক্তি খোয়াতে পারে।
অর্থাৎ অক্সিজেন পরমাণুর এই হলদে-সবুজ আলো অপার্থিব বলা যায়। পৃথিবীর পরিবেশে দেখা মেলে না এই রঙের আলোর। গ্যাস যেখানে খুব হালকা, অর্থাৎ মহাশূন্যের পরিবেশেই এই আলো বিকিরিত হতে পারে। সে জন্য নীহারিকাগুলো একধরনের গবেষণাগার বলা চলে। সেখানকার পরিবেশ কোয়ান্টাম বিদ্যার এমন কিছু সূক্ষ্ম ফলাফলের যথার্থতা যাচাই করার সুযোগ করে দেয়, যা বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর গবেষণাগারে পান না। যেহেতু এই বর্ণরেখার, অর্থাৎ এই বিশেষ রঙের আলো বিকিরণের সঙ্গে নীহারিকার গ্যাসের ঘনত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাই এই আলোর পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা সেই গ্যাস কতটুকু হালকা বা ঘন, তার মাপজোখ করতে পারেন। শুধু অক্সিজেন-উদ্ভূত এই হলদে-সবুজ বর্ণরেখাই নয়, আরও বেশ কটি এ রকম বিশেষ রঙের আলোর বিকিরণ কাজে লাগে নীহারিকা গবেষণায়।
কয়েকটি নীহারিকায় আবার নীল রঙের বিচ্ছুরণ দেখা যায়। যেমন কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জের নীহারিকা। দুরবিনে আকাশের সেই অংশে দেখা যায়, নক্ষত্রপুঞ্জের নীল তারার আলোর আভা ছড়িয়ে আছে তারাগুলোর আশপাশে। গবেষণায় জানা গেছে, এই নীহারিকায় ধুলার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি। এই ধূলিকণা থেকে চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত হয় নীল তারার আলো। তাই আমাদের চোখে নীলচে দেখায় এই নক্ষত্রপুঞ্জের অঞ্চলটি।
মহাকাশের নীহারিকার রং তাই আমাদের শুধু মুগ্ধ করে না, বিজ্ঞানীরা এই রংগুলোর হিসাব তাঁদের গবেষণায় ব্যবহার করেন এবং এই রংগুলোর গবেষণা নীহারিকার গ্যাস গবেষণায় খুব জরুরি। কারণ, এর সাহায্যে নীহারিকার গ্যাসের ঘনত্ব, তাপমাত্রা ইত্যাদির মাপজোখ করতে পারেন বিজ্ঞানীরা। গ্যাসের সঙ্গে ধুলা মিশে আছে কি না, সেই খবরও জানতে পারেন তাঁরা।