রহস্যময় বেতার সংকেতের খোঁজে

৭২ সেকেন্ড ধরে বেতার তরঙ্গের প্রচণ্ড শক্তিশালী এক সিগন্যাল রিসিভ করেন বিজ্ঞানীরা। সেটা কি এলিয়েনদের পাঠানো সিগন্যাল?

বহির্জাগতিক প্রাণ বা এলিয়েনদের কথা শুনলে একই সঙ্গে হাস্যকর ও অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তবে কোনো কিছু আসলেই সম্ভব কি অসম্ভব, সেটা আগে থেকে বলার কি আদৌ কোনো উপায় আছে? পৃথিবী যে সূর্যের চারদিকে ঘোরে এবং এটি যে খুবই নগণ্য এক গ্রহ, এ কথা ষোড়শ শতকের কাউকে বললে তিনি কি তা বিশ্বাস করতেন? এই নগণ্য গ্রহের এক কোণে বসে, হিসাব কষে নক্ষত্র থেকে ছায়াপথ—সবকিছুর গতি-প্রকৃতি বের করে ফেলা সম্ভব—কে ভাবতে পেরেছিল? তার ওপর আমাদের এত দিনের চেনাজানা ডিএনএতে নাইট্রোজেন বেস (ক্ষার) ছিল কেবল চারটি। গত ২২ ফেব্রুয়ারির সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি পেপার থেকে আমরা এখন জানি, বিজ্ঞানীরা আটটি নাইট্রোজেন বেসযুক্ত কৃত্রিম ডিএনএ তৈরি করেছেন। যেটি সম্পূর্ণ স্থিতিশীল এবং পুরোপুরি প্রাকৃতিক ডিএনএর মতোই আচরণ করে!

বহির্জাগতিক প্রাণ নিয়ে এই চিন্তাভাবনা কিন্তু কোনো সাম্প্রতিক ঘটনা নয়। সেই ষোড়শ শতকেই জিওর্দানো ব্রুনো বহির্জাগতিক প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন।

কিন্তু কথা হলো, বহির্জাগতিক প্রাণ যদি থাকে, সেটা আমরা বুঝব কীভাবে? কীভাবে যোগাযোগ করব তাদের সঙ্গে? এই যোগাযোগ আসলে দুভাবে হতে পারে। আমাদের পাঠানো বার্তার জবাবে সাড়া দিতে পারে অন্য ভুবনের কেউ। অথবা তারা নিজে থেকেই যোগাযোগ করতে পারে।

ভয়েজারের গোল্ডেন রেকর্ড; কখনো কি ভিনগ্রহী কোনো প্রাণী এ রেকর্ড পাবে?

প্রথমে আমাদের কথাই বলি। বেতার তরঙ্গ আবিষ্কৃত হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই মানুষ বহির্জাগতিক প্রাণের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে মহাকাশে সিগন্যাল পাঠিয়ে যাচ্ছে। এই তরঙ্গের শক্তি প্রচণ্ড। দূরপাল্লায় তথ্য পাঠানোর জন্য আমাদের কাছে বেতার তরঙ্গের চেয়ে ভালো আর কিছু নেই। আলোর বেগে মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় বহির্জাগতিক কোনো প্রাণের হাতে পড়তে পারে এই সিগন্যাল। তবে সেই প্রাণ আদৌ বুদ্ধিমান হবে কি না, আমাদের সিগন্যালের মর্ম বুঝতে পারবে কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন। তা ছাড়া অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়ার ফলে বেতার তরঙ্গ শক্তি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে। তবে বহির্জাগতিক সভ্যতা যদি যথেষ্ট উন্নত হয় এবং মহাকর্ষীয় লেন্স ব্যবহার করতে জানে, তাহলে আশা করা যায় তারা সিগন্যালটি ধরতে পারবে। মহাকর্ষীয় লেন্স আসলে গ্রহ, উপগ্রহ বা গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের মতো ভারী কোনো বস্তু থেকে উৎপন্ন হয়। এসব বস্তু নিজেদের বিপুল ভরের জন্য সৃষ্ট মহাকর্ষ ব্যবহার করে আলো থেকে শুরু করে বেতার তরঙ্গ—যেকোনো তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গকে বেঁকে ফেলতে পারে এরা। এ সময় এরা তরঙ্গটিকে কিছুটা বিবর্ধিত করে দিতে পারে। ফলে তরঙ্গটি কিছুটা শক্তি হারালেও, মহাকর্ষীয় লেন্স ব্যবহার করে এ ধরনের সিগন্যাল রিসিভ করা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব।

এবার উল্টো দিক থেকে ভাবা যাক। কোনো বহির্জাগতিক প্রাণী যদি নিজে থেকে আমাদের বার্তা পাঠায়, তাদের সেই বার্তা কেমন হবে? এটা যে বহির্জাগতিক প্রাণীদের পাঠানো বার্তা, সেটা বোঝার উপায়ই–বা কী?

এ ধরনের কিছু নিশ্চিত করতে মূলত প্রসেস অব এলিমিনেশন ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ যেটা প্রমাণ করা প্রয়োজন, শুরু করতে হবে তার উল্টো দিক থেকে। এ ক্ষেত্রে যেমন প্রথমে ধরে নিতে হবে, এই বার্তা বহির্জাগতিক কোনো প্রাণী পাঠায়নি। তারপর একে একে মহাজাগতিক সব বস্তু থেকে আসা সিগন্যালের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে হবে। যদি সিগন্যালটি এর কোনোটির সঙ্গেই না মেলে, তারপর আরও বেশ কিছু পরীক্ষা দেখা লাগবে। যেমন এই সিগন্যাল আসলেই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব কি না। সিগন্যালটা একবারই এসেছে, নাকি বারবার আসছে ইত্যাদি।

ওয়াও সিগন্যাল

এ রকম একটা ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৭ সালের আগস্টে। ওয়াও সিগন্যাল নামে পরিচিত এই ঘটনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ৭২ সেকেন্ড ধরে বেতার তরঙ্গের প্রচণ্ড শক্তিশালী এক সিগন্যাল রিসিভ করেন বিজ্ঞানীরা। এর কম্পাঙ্ক ছিল সেটি প্রকল্পের বিজ্ঞানীদের অনুমিত তরঙ্গের কাছাকাছি। মানে, তাঁরা ভেবেছিলেন, বহির্জাগতিক প্রাণীরা বার্তা পাঠালে এর কম কম্পাঙ্কের সিগন্যাল-ই পাঠাবে। ওহাইয়োতে অবস্থিত বিগ ইয়ার বেতার টেলিস্কোপ থেকে পাওয়া এই সিগন্যালের প্রিন্টআউট দেখে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরি এহম্যান প্রবল উত্তেজনায়, প্রিন্ট আউটের ওপরেই লাল কালি দিয়ে লিখে ফেলেছিলেন, ‘ওয়াও!’ কিন্তু তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সেই কম্পাঙ্কে এ ধরনের আর কোনো সিগন্যাল পাওয়া যায়নি। তবে একই কম্পাঙ্কে একই ধরনের সিগন্যাল যদি বারবার পাওয়া যেত, গল্পটা অন্য রকম হতে পারত।

যেকোনো টেলিস্কোপে গৃহীত সিগন্যাল দেখে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, সেটা কোত্থেকে বা কত দূর থেকে এসেছে। ডপলার ক্রিয়া ব্যবহার করে এটা খুব সহজেই বের করা যায়। সে জন্য গৃহীত সিগন্যালের বর্ণালি পরীক্ষা করে দেখতে হয়। যদি কোনো সিগন্যাল বহির্জাগতিক প্রাণীদের পাঠানো নয় বলে প্রমাণ করা সম্ভব না-ই হয়, তখন একে আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থা বলে গণ্য করা হবে। ‘ইটিআই সিগন্যাল ডিটেকশন’ প্রটোকল অনুযায়ী, জাতিসংঘের মহাসচিব এবং পৃথিবীর সব আন্তর্জাতিক সংগঠনকে দ্রুত এ ব্যাপারে জানিয়ে দেওয়া হবে। বিজ্ঞানীরা সেই কম্পাঙ্কটুকুকে জরুরি বলে ঘোষণা করে দেবেন, যাতে পৃথিবীর কোনো প্রান্তের কেউ এই কম্পাঙ্ক ব্যবহার করে কোনো সিগন্যাল না পাঠায়। সেই সঙ্গে সিগন্যালটির বিস্তারিত তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এতে যে কেউ সিগন্যালটি নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পারবে, একে স্বাভাবিক সিগন্যাল বলে কোনোভাবে প্রমাণ করা যায় কিনা। এবং আন্তর্জাতিকভাবে পুরোপুরি নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে এই সিগন্যালের কোনো জবাব পাঠানো হবে না। কারণ, এই প্রাণীরা বন্ধুবৎসল হবে, নাকি নির্মম—সেটা আগে থেকে জানা সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদের দিকে তাকালেই এর কারণ বোঝা যাবে। মানুষ কি বন্ধুবৎসল প্রাণী, নাকি নির্মম? প্রিয় পাঠক, এ প্রশ্নের ভার না হয় আপনার কাছেই তোলা থাকুক!

এখানে দুটো বিষয় বলে রাখা দরকার। এক, চলচ্চিত্রে যেমন দেখা যায়, সে রকম কোনো কথোপকথন এ ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের সবচেয়ে কাছের বহির্জাগতিক সভ্যতাও শত-সহস্র আলোকবর্ষ দূরে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে একেকটা প্রশ্ন পাঠাতে যেমন শত-সহস্র আলোকবর্ষ লেগে যাবে, তেমনি এর উত্তর ফিরে আসতেও একই সময় লাগবে। দুই, বহির্জাগতিক প্রাণীদের পাঠানো বার্তার অর্থ কী, সেটা আমরা কীভাবে বুঝব? ইংরেজি মুভিতে যেমন দেখায়, সব এলিয়েনের তো আর ইংরেজি জানার কথা না! আসলে, পৃথিবীর কোনো ভাষা-ই তাদের জানার কথা নয়। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই যোগাযোগের মাধ্যম হতে পারে গণিত। এখন পর্যন্ত আমাদের জানা মৌলিক সংখ্যার তালিকা, পাইয়ের মান কিংবা ফিবোনাচ্চি ধারা—এমন কিছু আদান-প্রদানের মাধ্যমে হয়তো যোগাযোগ শুরু হতে পারে। যদি ও প্রান্তের প্রাণীরা গণিত বোঝে-ই, তাহলে পরে বাইনারি সিগন্যাল ব্যবহার করে আরও বিস্তারিত বার্তা, এমনকি ছবিও আদান-প্রদান করা সম্ভব।

তবে এই যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বড় শর্তটা হচ্ছে, বহির্জাগতিক সেই প্রাণীদের বুদ্ধিমান হতে হবে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে যে প্রশ্নটা আসে, তা হলো, দৈহিকভাবে কেমন হবে সেই প্রাণীরা?

কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যাটা আসলে গাণিতিক প্রতীক বা সিম্বল নিয়ে। যেমন দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি বা ১০ ভিত্তিক গণনার পেছনে যথাসম্ভব আমাদের ‘হাত-পায়ে ১০টা করে আঙুল থাকা’টা একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। কথা হলো, বহির্জাগতিক কোনো সভ্যতার সঙ্গে যদি আমাদের গণিত দিয়েও কথা হয়, তারা ঠিক কত ভিত্তিক সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহার করবে? এসব সমস্যা সমাধানের জন্য গণিতের সর্বজনীনতাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, এ নিয়ে বিখ্যাত পদার্থবিদ কার্ল সাগানের বেশ কিছু তত্ত্ব আছে। যেমন, ‘২+৩ = ৫’— এটা দিয়ে সত্য বোঝানো যেতে পারে, এবং ‘২+২ = ৫’— এটা দিয়ে মিথ্যা বোঝানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংখ্যা পদ্ধতি ভিন্ন হলেও বহির্জাগতিক সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়তো সম্ভব হবে।

তবে এই যোগাযোগের জন্য সবচেয়ে বড় শর্তটা হচ্ছে, বহির্জাগতিক সেই প্রাণীদের বুদ্ধিমান হতে হবে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার আগে যে প্রশ্নটা আসে, তা হলো, দৈহিকভাবে কেমন হবে সেই প্রাণীরা?

এই প্রশ্নের উত্তর আবার আরেকটা প্রশ্নের ওপর নির্ভর করে। তাদের বাসভূমিটা কেমন? যদি বহির্জাগতিক প্রাণীদের আবাসস্থল পৃথিবীর মতো হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, সেই প্রাণীরাও প্রায় আমাদের মতোই হবে। প্রাণের বিকাশের স্বাভাবিক নিয়ম হলো, একই ধরনের পরিবেশে সে সাধারণত একইভাবে বিকশিত হয়। পরিবেশ ভিন্নতার কারণে তাদের বুদ্ধিমান হতে কোনো সমস্যা নেই। যেমন, ডলফিন। পানিতে থাকলেও এরা বেশ বুদ্ধিমান প্রাণী। এর মধ্যে অবশ্যই একটা ‘কিন্তু’ আছে। বহির্জাগতিক প্রাণের সূচনা পানিতে হোক কিংবা বায়ুতে, আমাদের মতো কিংবা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান হতে হলে তাদের একসময় অবশ্যই মাটিতে বসবাস করা শুরু করতে হবে। মাটির বুকে, আগুনের চারপাশে জড়ো হয়ে বসে গল্প করা এবং আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা আমাদের সভ্যতার পেছনে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। সহজ কথায়, ভিনগ্রহী প্রাণীদের গ্রহটি যদি পৃথিবীর মতোই হয়, তাহলে তাদের দৈহিক গঠনও আমাদের মতোই হবে। যদি তাদের গ্রহের মহাকর্ষ বল তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়, তাহলে তাদের আকৃতি হবে লম্বা এবং সরু। আর মহাকর্ষ বল অনেক শক্তিশালী হলে তাদের আকৃতি হবে মোটা এবং খাটো ধরনের।

প্রাণীদের আকৃতি নিয়ে এত কথা বলার কারণ কী? কারণ, স্নায়ুবিদেরা মনে করেন, গৃহপালিত বিড়ালের চেয়ে ছোট আকৃতির কোনো প্রাণীর মস্তিষ্কের আকার এত ছোট যে, তাদের পক্ষে খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়া সম্ভব না। তবে আকৃতিতে ছোট হলেও তারা যদি ‘সামষ্টিক বুদ্ধিমত্তা’ হিসেবে কাজ করতে পারে, মানে, পুরো গ্রহের সব প্রাণী মিলে যদি একটি প্রাণীর মতো চিন্তা করতে পারে, তাহলে তারা এই সমস্যা এড়াতে পারবে।

ভিনগ্রহী প্রাণীদের আকৃতি কেমন, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; তবে শিল্পীর কল্পনায় এ ধরনের ছবি দেখা যায় প্রায়ই
আরও পড়ুন

এসব কিছুর পেছনের কথাটি ছিল, বহির্জাগতিক প্রাণীদের আবাসস্থল পৃথিবীর মতো হতে হবে। তা-ই যদি হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, তাদের প্রাণও হবে আমাদের মতোই কার্বন-ভিত্তিক। তবে সেটা যদি না হয়? অন্য গ্রহের প্রাণ যদি অন্য কোনোভাবে গড়ে ওঠে? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মহাবিশ্বের যেকোনো প্রান্তে প্রাণ তৈরি হলে সেটা কার্বন-ভিত্তিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, কার্বন একসঙ্গে চারটি জিনিসের সঙ্গে স্থিতিশীলভাবে যুক্ত হতে পারে। তার ওপর, কার্বন নিজেই নিজের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত হতে পারে। কার্বনের বিকল্প হিসেবে সবার আগে আসবে সিলিকনের কথা। প্রায় কার্বনের মতোই কাজ করলেও, কার্বনের মতো স্থিতিশীল বন্ধন গঠন করতে পারে না এই মৌলটি।

প্রাণের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো পানি। আমাদের প্রতিটি কোষের বিশাল একটি অংশ পানির দখলে। ধারণা করা হয়, প্রাণের উৎপত্তিও হয়েছে পানিতে। সবচেয়ে বড় কথা, পানি ছাড়া আমরা এতই অসহায় যে, এ নিয়ে একটি প্রবাদবাক্যই তৈরি হয়ে গেছে। পানির অপর নাম জীবন। এর বিকল্প আর কিছু বিজ্ঞানীরা আজও ‘ভেবেই’ বের করতে পারেননি। বাস্তবে বের করতে পারা তো আরও দূরের কথা! তাদের হিসাবে, পানিবিহীন রুক্ষ, শুষ্ক কোনো গ্রহে প্রাণের বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। তবে বরফাচ্ছাদিত কোনো গ্রহে প্রাণের বিকাশ হলেও হতে পারে! কারণ, জমাট বরফের আবরণের নিচে পানি তরল অবস্থায় থাকতে পারে। হতে পারে, সেই পানিতেই জন্ম নিয়েছে প্রাণ। তবে তারা যদি বরফের আবরণ ভেঙে বেরিয়ে আসতেই না পারে, তাহলে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করা তাদের জন্য বেশ কঠিন হবে বৈকি!

এসব কিছুর পেছনের কথাটি ছিল, বহির্জাগতিক প্রাণীদের আবাসস্থল পৃথিবীর মতো হতে হবে। তা-ই যদি হয়, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, তাদের প্রাণও হবে আমাদের মতোই কার্বন-ভিত্তিক। তবে সেটা যদি না হয়? অন্য গ্রহের প্রাণ যদি অন্য কোনোভাবে গড়ে ওঠে?

এসব কিছুই কেবল সম্ভাবনা। তবে কোনো কিছু আবিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত তা কিন্তু সম্ভাবনাই থাকে। আবিষ্কৃত হওয়ার পরেই কেবল সেটা হয়ে ওঠে নিখাদ বাস্তব। এ নিয়ে শুরুতেই বলেছি। প্রকৃতি তার পরতে পরতে কী লুকিয়ে রেখেছে, তার বেশির ভাগটাই আমরা আজও জানি না।

মহাবিশ্বের ইতিহাস হলো প্রায় ১৪ বিলিয়ন বছরের ইতিহাস। আর আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের পুরো বিপ্লবটুকু হয়েছে মোটামুটি গত দুই শ বছরে। এই দুই শ বছরের মধ্যেই আমরা আবিষ্কার করেছি, মিল্কিওয়ের এক পাশে, ছোট্ট বিন্দুসম এক গ্রহে আমাদের বাস। আবিষ্কার করেছি, মিল্কিওয়ের বাইরে আরো শত-সহস্র গ্যালাক্সি ক্লাস্টার আছে। কৃষ্ণগহ্বর, গুপ্তবস্তু, এমনকি প্রতিপদার্থের মতো বিচিত্র জিনিসও আছে আমাদের এই মহাবিশ্বে। আর এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই প্রাণের বসবাস উপযোগী গ্রহ আছে প্রায় ৬০ বিলিয়ন!

গত ১৪ বিলিয়ন বছরের রহস্য, ইতিহাস বনাম মাত্র দুই শ বছরের অর্জিত জ্ঞান—বহির্জাগতিক প্রাণের অস্তিত্বের কথা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিলাসিতা করা কি আমাদের সাজে?

সূত্র: বিবিসি নলেজ, সায়েন্স ইলাস্ট্রেটেড