গম্ভীর কোনো ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা চশমাটা নাকের ডগায় রেখে চশমার ওপর দিয়ে তাকাচ্ছেন। খুব একটা অপরিচিত দৃশ্য নয়। বয়স্ক মানুষদের অনেক সময় এমনটা করতে দেখা যায়। অনেকে জিনিসটা নিয়ে হাসি-তামাশা করতেও ছাড়েন না। তবে চশমার ওপর দিয়ে তাকানোর পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকে। কারণটা জানার আগে চোখ কীভাবে কাজ করে, সেটা একটু দেখা যাক।
কোনো বস্তু থেকে আলো আমাদের চোখে এসে পড়লে ওই বস্তু দেখি, এ তো জানা কথা। কিন্তু ছোট্ট চোখ দিয়ে কীভাবে বিশাল দুনিয়া দেখি, তা ভাবনার বিষয়। বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই কারণটা বের করেছেন। চোখের উপরিভাগের একদম ওপরে থাকে কর্ণিয়া। স্বচ্ছ গম্বুজের মতো অংশ। সবার আগে আলো এসে এখানেই পড়ে। এরপর সেটা পিউপিল নামের ছোট্ট ছিদ্রপথ ধরে ঢুকে পড়ে চোখের ভেতরে। কতটুকু আলো পিউপিলে প্রবেশ করবে, তা নির্ধারণ করে আইরিস।
সাদা চোখের মধ্যে গাঢ় বৃত্তটার নামই আইরিস। জিনগত কারণে আইরিসের রং কালো, ধূসর, বাদামি, নীল, এমনকি সবুজও হয়। আইরিসের মধ্যে আরও গাঢ় রঙের যে ছোট বৃত্ত থাকে, সেটাই পিউপিল। এই পিউপিলে আলো প্রবেশ করার পর তা একটি জৈব লেন্সে আঘাত করে। লেন্স এবার ছড়ানো আলোকরশ্মিকে একত্রিত করে পাঠিয়ে দেয় রেটিনার কাছে। এ কাজে লেন্সকে সাহায্যে করে কর্ণিয়া। রেটিনায় থাকা সংবেদী কোষ তখন আলোক সংকেতকে তড়িৎ সংকেতে রূপান্তর করে মস্তিষ্কে পাঠায়। এই পর্যায়ে এসে আমরা বস্তুটা দেখি। মোটা দাগে এই হলো চোখের কাজকর্ম।
এমন অবস্থায় একক লেন্সের চশমা ব্যবহার করলে বাধ্য হয়েই তাকে দূরে দেখার জন্য চশমার ওপর দিয়ে তাকাতে হয়
নানা কারণে আমাদের চোখের লেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিংবা জন্ম থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত থাকে। ফলে চোখ আলোকরশ্মিকে ঠিকভাবে এক করতে পারে না। দৃষ্টি হয়ে আসে ঝাপসা। কারো কাছের জিনিস দেখতে সমস্যা হয়, কারো দূরের। চোখের এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চিকিৎসকেরা চশমা পরার পরামর্শ দেন।
চশমা মূলত প্রয়োজন অনুযায়ী আলোকরশ্মিকে একত্রিত করার কাজে সাহায্য করে। এ জন্য চশমায় কাচ বা প্লাস্টিকের লেন্স ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট লেন্স মোটামুটি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে আসা আলোক তরঙ্গকে একবিন্দুতে ফেলতে পারে। আর এখানেই তৈরি হয় সমস্যাটা।
অনেকে খালি চোখে কাছের বস্তু ঝাপসা দেখলেও দূরের বস্তু স্পষ্ট দেখতে পান। উল্টো ঘটনাও ঘটে। অর্থাৎ খালি চোখে দূরের বস্তু অস্পষ্ট দেখলেও হয়তো কাছের জিনিস খুব স্পষ্ট দেখতে পান। এমন অবস্থায় একক লেন্সের চশমা ব্যবহার করলে বাধ্য হয়েই তাকে দূরে দেখার জন্য চশমার ওপর দিয়ে তাকাতে হয়। কিংবা দূরের জিনিস চশমা দিয়ে দেখা স্পষ্ট দেখা গেলে কাছের জিনিস দেখার জন্য তাকাতে হয় খালি চোখে বা অতিরিক্ত লেন্স ছাড়া।
মজার বিষয় হলো, বিশেষ একধরনের চশমার সাহায্যে একই সঙ্গে খুব কাছে, খুব দূরে এবং মাঝামাঝি স্থান স্পষ্ট দেখা সম্ভব। এগুলোকে বলা হয় ভেরিফোকাল লেন্সের চশমা। এই চশমায় যে লেন্স ব্যবহৃত হয়, তা ভ্যারিলাক্স লেন্স হিসেবে পরিচিত। ফ্রান্সের এক চশমা প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে কর্মরত প্রকৌশলী বার্নার্ড মাইতেনাজ ১৯৫৯ সালে উদ্ভাবন করেন ভেরিফোকাল চশমা।
আধুনিক ভেরোফোকাল লেন্সের চশমায় একই লেন্সের মধ্যে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভিন্ন দূরত্ব দেখার ব্যবস্থা থাকে। সাধারণত কাছের বস্তু দেখার জন্য লেন্সের নিচের অংশ, দূরে দেখার জন্য ওপরের অংশ এবং মাঝামাঝি দূরত্ব দেখার জন্য মধ্যবর্তী অংশ ব্যবহৃত হয়। বাইফোকাল লেন্সের সাহায্যেও দূরে-কাছের বস্তু দেখা যায়। এমন চশমায় সাধারণত নিচের অংশে প্রয়োজন অনুযায়ী একটি লেন্স বসানো থাকে। ওপরের অংশে লেন্স থাকতেও পারে, নাও পারে। বাইফোকাল লেন্সের প্রধান সমস্যা হলো, হঠাৎ কাছে থেকে দূরে তাকালে লেন্স পরিবর্তনের বিষয়টা চোখে অস্বস্তিকর লাগে। ভেরিফোকাল চশমায় সে সমস্যা হয় না। লেন্সের পরিবর্তনটা এখানে খুব মসৃণভাবে করা হয়। ফলে দৃষ্টিসীমা বদলালে চোখে আর অস্বস্তিকর লাগে না।
তবে এ জন্য ভেরিফোকাল চশমাকে সর্বেসর্বা ভাবার কোনো কারণ নেই। এরও অসুবিধার দিক আছে। সব চোখের ত্রুটির জন্য ভেরিফোকাল লেন্সের চশমা সমাধান নয়। তা ছাড়া ব্যবহারকারীর অনেক সময় মাথাঘোরা বা মাথাব্যথার মতো সমস্যা হতে পারে এর ফলে। তাই ভেরিফোকাল চশমা ব্যবহারের আগে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।