শুরুটা হয়েছিল কথা কাটাকাটির মধ্য দিয়ে।
১৯৯৫-এর গ্রীষ্মে দেখা দুজনের। সার্গে ব্রিন তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির মাস্টার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়ছেন কম্পিউটারবিজ্ঞান। তাঁর ঘাড়ে দায়িত্ব পড়েছে নতুন শিক্ষার্থীদের ঘুরিয়ে দেখানোর। এই শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছে সদ্যই, তবে সত্যিই ক্লাস করবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এখনো। এই গল্পের সদ্য নতুন ভর্তি ছাত্রটির নাম ল্যারি পেজ। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান থেকে প্রকৌশল নিয়ে পড়েছেন, এখন এসেছেন মাস্টার্স করতে।
কথায় কথায় নানা বিষয়ে একের পর এক তর্ক বেঁধেই যাচ্ছে। দুজনেই নিজেদের মতামত নিয়ে যথেষ্ট একগুঁয়ে, কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নন। এই তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে শুরু করে।
ল্যারি পেজ নিজের থিসিস নিয়ে খুব চিন্তিত। সে লক্ষ্যেই শুরু করলেন ইন্টারনেটভিত্তিক একটি সার্চ ইঞ্জিন বানানোর কাজ। ইন্টারনেটে নানারকম ওয়েব পেজ পাওয়া যায়। কিন্তু একটা ওয়েবপেজে ক্লিক করলে, ওর ভেতরে অন্য কোনোটার কথা থাকলে, লিঙ্ক করা থাকলে আগে থেকে বোঝা যায় না, ওই ওয়েব পেজটা আসলে কী ধরনের। কিন্তু ল্যারি পেজ সেটা জানতে চান। এরকম লিঙ্কের মাধ্যমে কোনো একটি ওয়েব পেজের গুরুত্ব নির্ধারণ করা যায় কি না, ভাবলেন। আসলে, সম্ভব। অনেক ওয়েব পেজ যদি একটি নির্দিষ্ট পেজের লিঙ্ক দিতে থাকে, তবে সেটার নিশ্চয় গুরুত্ব আছে। এই গুরুত্ব ধরেই কাজ শুরু করলেন তিনি। সঙ্গে যোগ দিল বন্ধু সার্গে ব্রিন। তৈরি হলো সার্চ ইঞ্জিন ব্যাকরাব (Backrub)। সেটা ১৯৯৬ সালের আগস্টের কথা।
এই ব্যাকরাবের নাম শিগগিরই বদলে রাখা হলো গুগল। ১ এর পরে ১০০টি শূন্য বসালে যে বিশাল সংখ্যাটি হয়, সেখান থেকেই এই নাম। নামেই ফুটে উঠল গুগলের উদ্দেশ্য—ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের সব তথ্য গুছিয়ে সবার কাজে লাগে, এমনভাবে বিশ্বের সবার সামনে উপস্থাপন করা। যেন বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ যেকোনো তথ্য পেতে পারে।
পরের তিন বছরে অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডলের বাইরের মানুষও গুগলের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারীদের চোখ যায় গুগলের দিকে। ১৯৯৮ সালের আগস্টের শেষ দিকে অ্যান্ডি বেখটোলশেইম ১ লাখ ডলারের চেক লিখে দেন দুই বন্ধুকে। ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সেই চেকের অর্থ তাদের হাতে পৌঁছে। জন্ম হয় গুগলের।
দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন, একটা অফিস নেওয়া দরকার। ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কে একটা গ্যারেজ ভাড়া নিলেন দুজনে। দিনটা ছিল ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। পুরাতন ডেস্ক কম্পিউটার, একটা পিং পং টেবিল এবং উজ্জ্বল নীল কার্পেটের সেই গ্যারাজে রাত জেগে কাজ করে চললেন তাঁরা। সঙ্গে যুক্ত হলো আরও কিছু মানুষ। এমনকি সেই গ্যারেজের মালিক সুজান ওজোসিকিও ছিলেন তাঁদের কর্মী। গুগলের ১৬তম কর্মী তিনি, ইউটিউবের সাবেক সিইও।
সেই গ্যারেজ থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে গুগল আজ পা রেখেছে ২৫-এ। বর্তমান দুনিয়ার জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন। এই ৮ বিলিয়ন মানুষের একদম শিশুরা ছাড়া, মোবাইল চালাতে পারে অথচ গুগলের পণ্য ব্যবহার করেনি—এমন কাউকে আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বিশাল এক জগৎ গড়ে তুলেছে গুগল, বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছে ইন্টারনেটের জগতে। পৃথিবীর ১ নম্বর সার্চ ইঞ্জিন গুগল, দুই নম্বর সার্চ ইঞ্জিনটি ইউটিউবের, যা আসলে গুগলেরই। গুগল ফটোস, গুগল ড্রাইভ, ডক, শিট বা স্লাইডের মতো নিত্য ব্যবহার্য প্রযুক্তি যেমন আছে, তেমনি আছে অপরিহার্য জিমেইল এবং স্মার্টফোনের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা অ্যান্ড্রয়েড।
১-এর পরে ১০০টি শূন্যের মতোই বিশাল সাম্রাজ্য আজ গুগলের। চলুন, সেই পথচলার কথা জেনে নেওয়া যাক সংক্ষেপে।
আগস্ট ১৯৯৬
ল্যারি পেজ ও সার্গে ব্রিন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সির নেটওয়ার্কে গুগল লঞ্চ করেন। তখন এটি পরিচিত ছিল ব্যাকরাব নামে।
৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
১ লাখ ডলারের চেকের অর্থ হাতে আসে দুই বন্ধুর।
২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮
টাকা পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কে একটি অফিস নেন ল্যারি পেজ ও সার্গে ব্রিন। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় গুগলের।
গ্রীষ্ম, ২০০২
গুগলের ক্রমোন্নতি হতে থাকে। তবে এর অনেক আগে থেকেই ইয়াহু সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। কিন্তু ২০০০ সাল থেকে ইয়াহুর সার্চ ইঞ্জিনের কাজে সহায়তা করতে শুরু করে গুগল। ২০০২ সালের গ্রীষ্মে ইয়াহু তাই গুগলকে ৩ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেওয়ার চেষ্টা করে। গুগল সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। সার্গে ব্রিন ও ল্যারি পেজের মনে হয়েছিল, এর মূল্য অন্তত ৫ বিলিয়ন হবে। মাত্র দুই বিলিয়ন ডলারের জন্য গুগলকে কিনতে ব্যর্থ হয় ইয়াহু। আজ সেই গুগলের মার্কেট ক্যাপিটাল কত, জানেন? ১.৬২৫ ট্রিলিয়ন ডলার!
জুলাই, ২০০৩
২০০৩ সালে গুগল অনেকটাই বড় হয়ে ওঠে পরিসরে। তখন গুগলের কর্মীর সংখ্যা ১ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৬০০ অ্যাম্ফিথিয়েটার পার্কওয়ের একটি কমপ্লেক্স বিল্ডিং লিজ নিয়ে সেখানে অফিস নেয় গুগল। আজ সেই বিল্ডিংয়ের নাম গুগলপ্লেক্স।
১ এপ্রিল, ২০০৪
২০০১ সালে গুগলের কর্মী পল বুকেইট ই-মেইল পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রতিষ্ঠানের আন্তঃযোগাযোগ ও স্টোরেজ বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছিলেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল গুগল ১ জিবি স্টোরেজসহ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয় জিমেইল। সে কালের মেইলগুলো মাত্র কয়েক মেগাবাইট স্টোরেজ দিত। সে জন্য অনেকে ভেবেছিল, এটা এপ্রিল ফুলে গুগলের মজা করার চেষ্টা। সেই জিমেইল আর পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ই-মেইল ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
১৯ আগস্ট, ২০০৪
এই দিনে গুগল প্রথম নিজেদের পাবলিক কোম্পানি হিসেবে ঘোষণা করে।
৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫
প্রথমবারের মতো গুগল ম্যাপ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে প্রতিটি বাঁক ও জিপিএস নেভিগেশনসহ ম্যাপ বাজারে আসে ২০০৯ সালে।
৯ অক্টোবর, ২০০৬
মাইক্রোসফট, ভিয়াকম এবং ইয়াহুর মতো প্রতিষ্ঠানকে হারিয়ে গুগল ইউটিউব নামের ছোট্ট এক ভিডিও দেখার ওয়েবঅ্যাপ কিনে নেয় ১.৬৫ বিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে এই ইউটিউব হয়ে উঠেছে ভিডিওর মহাবিশ্ব। ইউটিউবের সার্চ ইঞ্জিন এখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত সার্চ ইঞ্জিন।
২ সেপ্টেম্বর, ২০০৮
প্রথমবারের মতো ক্রোম ব্রাউজার উন্মুক্ত করে দেয় গুগল। তবে এটা ছিল শুধু উইন্ডোজের জন্য। সঙ্গে ৪০ পৃষ্ঠার একটা কমিক ছাড়া হয় এই ব্রাউজারের কর্মপদ্ধতি নিয়ে। বর্তমানে এটি পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় ব্রাউজার।
অক্টোবর, ২০১০
সেলফ-ড্রাইভিং বা স্বচালিত কার নিয়ে কাজ শুরু করে গুগল।
২৪ এপ্রিল, ২০১২
গুগল ড্রাইভ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ব্যবহারকারীদের জন্য। অনলাইনভিত্তিক এই স্টোরেজ ব্যবস্থা ছাড়া বর্তমানে জীবন কল্পনা করাও কঠিন।
২৪ জানুয়ারি, ২০১৪
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণাগার ডিপমাইন্ড কিনে নেয় গুগল। বর্তমান এআই বিপ্লবের নেপথ্যে গুগলের এই উদ্যোগের বড় ভূমিকা আছে। ডিপমাইন্ডের বানানো আলফাগো নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দাবার মতো খেলা ‘গো’তে হারিয়ে দেয় মানুষকে।
১০ আগস্ট, ২০১৫
এত এত পণ্য বাজারে আসার পর গুগল নতুন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে—অ্যালফাবেট ইনকর্পোরেটেড। এর অধীনে চলে যায় গুগলের সব পণ্য ও সেবা। গুগল নিজেও বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে রয়েছে। অর্থাৎ এটি গুগলের মাতৃপ্রতিষ্ঠান বা মাদার অরগানাইজেশন।
২৮ মে, ২০১৫
প্রথমবারের মতো গুগল ফটোস উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সবার জন্য।
১৮ মে, ২০১৬
অ্যাপলের সিরির ৫ বছর পর ও অ্যামাজনের অ্যালেক্সা বাজারে আসার ২ বছর পর গুগল অ্যাসিসটেন্ট বাজারে আসে এই দিনে। অথচ বর্তমানে অন্যতম নির্ভরযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট সহকারী হয়ে উঠেছে এটি।
২১ মার্চ, ২০২৩
চ্যাটজিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় একরকম বিপ্লব তৈরি করেছে। আরও অনেক আগে থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করলেও চ্যাটজিপিটির প্রায় অর্ধ বছর পর গুগল বাজারে এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বার্ড। দ্রুতই এটি হয়ে উঠেছে চ্যাটজিপিটির বড় প্রতিপক্ষ ও নির্ভরযোগ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
সংক্ষেপে এই হলো গুগলের ২৫ বছরের পথচলা। ছোট্ট এ লেখায় অবশ্য গুগলের বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরা সম্ভব নয়। তবে খানিকটা ধারণা হয়তো পাওয়া যাবে। প্রতিনিয়ত নতুন সব চমক, পণ্য ও সেবা বাজারে নিয়ে আসছে গুগল। এই একটি প্রতিষ্ঠান আধুনিক ইন্টারনেটকে রূপ দেওয়ার পেছনে যেমন বড় ভূমিকা রেখেছে, তেমনি সহজ করে দিয়েছে জীবনযাত্রাও।
শুভ জন্মদিন, গুগল!