বি-২ বিমান: উড়ন্ত অবস্থায় বিমান কীভাবে জ্বালানি সংগ্রহ করে

সম্প্রতি ইরানে হামলা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্পিরিট। সে জন্য একটানা ৩৭ ঘণ্টা আকাশে উড়েছে এই বিমান। এ জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি প্রয়োজন, সে জন্য মাঝ আকাশেই জ্বালানি সংগ্রহ করতে হয়েছে বিমানটিকে। কিন্তু এসব বিমান উড়ন্ত অবস্থায় কীভাবে জ্বালানি সংগ্রহ করে? বিস্তারিত জেনে নিন...

২২ জুন, রোববার। সকাল সকাল ইরানিরা ঘুম থেকে উঠেই তাদের দেশের পারমাণবিক স্থাপনা আক্রান্ত হতে দেখেছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবর অনুযায়ী, ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ভারী বোমা ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই পারমাণবিক স্থাপনা হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে বি-২ স্পিরিট বিমান। এটি মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি বোমারু বিমান।

ইরানে হামলা করার আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি এয়ারবেজ থেকে আকাশে ওড়ে বি-২। ৩৭ ঘণ্টা একটানা আকাশে ওড়ে এবং ভিন্ন তিনটি শহরে আক্রমণ করে। এ থেকেই বোঝা যায়, ৩৭ ঘণ্টা আকাশে ওড়ার জন্য অনেক জ্বালানি প্রয়োজন। একটানা চলার জন্য তাই এই বিমানকে দক্ষতার সঙ্গে জ্বালানি নিতে হয়। এটি বিমানটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

নর্থরপ গ্রুম্যান বি-২ বিমানের একদম ওপরের অংশে একটি ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্রের মাধ্যমে অন্য বিমান থেকে আকাশপথে জ্বালানি নিতে পারে এটি। জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের বিমান।

এটির আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। বিমানটি পারমাণবিক অস্ত্র বহন করতে পারে। বিশেষ করে রাডার ফাঁকি দেওয়া বা শনাক্তকরণ সিস্টেমগুলো এড়াতে সক্ষম এটি। এ জন্য এটিকে বলা হয় ‘স্টেলথ’ বিমান। দেখতে সাধারণ বিমান থেকে বেশ আলাদা। মার্কিন বিমান বাহিনীর সামরিক অস্ত্রগুলোর মধ্যে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

বিমানটি প্রথম আকাশে উড়েছিল ১৯৮৯ সালে। ১৯৯৭ সালে এই বিমান সার্ভিসে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। ইতিমধ্যেই বলেছি, বি-২ স্পিরিট মিশন চালানোর সময় রিফুয়েলিং, তথা জ্বালানি নিতে পারে। কিন্তু মাঝ আকাশে এটি জ্বালানি নেয় কীভাবে?

আরও পড়ুন

আকাশে চলা বা ক্রুজিং করার সময় বি-২ প্রতি ছয় ঘণ্টা পরপর জ্বালানি সংগ্রহ করে। প্রতিবার ৪৫ হাজার কেজি জ্বালানি গ্রহণ করতে পারে। এই বিমান তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থরপ গ্রুম্যান কোম্পানি। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান মহাকাশ এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সংস্থা। মার্কিন সামরিক বাহিনী এবং বিশ্বজুড়ে অন্যান্য গ্রাহকদের জন্য উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ করে এই প্রতিষ্ঠান।

নর্থরপ গ্রুম্যান বি-২ বিমানের একদম ওপরের অংশে একটি ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্রের মাধ্যমে অন্য বিমান থেকে আকাশপথে জ্বালানি নিতে পারে এটি। জ্বালানি সরবরাহ করার জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের বিমান। এগুলোকে বলা হয় এয়ার-ট্যাংকার বা ট্যাংকার এয়ারক্রাফট। এই ট্যাংকার এয়ারক্রাফট বি-২ এর খানিকটা ওপরে একটি স্থির দূরত্বে অবস্থান করে নির্ধারিত গতিতে উড়তে থাকে। পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক নিয়ম মেনে জ্বালানি গ্রহণকারী বিমানটি, অর্থাৎ বি-২ স্পিরিটও নির্ধারিত সেই একই গতিতে উড়ে চলে। মৌলিক নিয়ম মানার কথাটা এল কেন? কারণ, সমবেগ বা সমান গতিতে চলমান দুটি বিমান (বা যেকোনো কিছু) একে অন্যের তুলনায় স্থির। তখন আর একটির কাছে অন্যটিকে চলমান বা ছুটন্ত বলে মনে হয় না।

জ্বালানি নিতে ট্যাংকারের পেছনে যুদ্ধবিমান (এ ক্ষেত্রে বি-২) ২০ মিটার দূরে চলে আসে। যত দ্রুত বিমান দুটি নির্ধারিত অবস্থানে আসে এবং যুক্ত হয়, জ্বালানি সরবরাহের প্রক্রিয়া শুরু হয় তত তাড়াতাড়ি।

এ সময়ে বি-২ স্পিরিটের জ্বালানি গ্রহণকারী অংশটি ঘুরে উন্মুক্ত হয়ে তৈরি করে একটি প্রবেশপথ। এরপর ট্যাংকারের সরবরাহকারী পাইপের অগ্রভাগ প্রবেশ করে সেখানে। জ্বালানি নেওয়া শেষ হলে জ্বালানি সরবরাহকারী নলটি ট্যাংকার বিমানের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিরে যায়। বি-২ বিমানের জ্বালানি গ্রহণকারী অংশটি তখন ঘুরে বিমানের ছাদ বা ওপরের অংশে পুরোপুরি মিশে যায়। বাইরে থেকে দেখলে আলাদা করে বোঝা যায় না যে এখানে কোনো ছিদ্র আছে।

আরও পড়ুন

এই বিশেষ প্রযুক্তির কারণ হলো, এটি যদি মিশে না যায়, তাহলে বিমানটি অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট সিস্টেম বা রাডারে ধরা পড়ে যেতে পারে। যেন কোনো রাডার পৃষ্ঠে বা ওপরের তলে কোনো ভিন্নতা শনাক্ত করতে না পারে, তাই এই ব্যবস্থা। আধুনিক রাডার প্রযুক্তি বেশ উন্নত। ছোট্ট একটি পোর্ট বা ছিদ্র থেকেও বিমানকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারে। মজার ব্যাপার হলো, এই পোর্টটি যখন খোলা হয়, তখন রাডারে এর সিগন্যাল তিন গুণ বেড়ে যায়।

বিশ্বে বি-২ স্পিরিট বিমান ওড়াতে সক্ষম, এমন পাইলটের সংখ্যা মাত্র ৮০ জন। এর মানে, বাস্তব জীবনে এটি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তার ওপর এটি অনেক উঁচুতে ওড়ে। রাডারে ধরা পড়ে না সে জন্যই। তবে যখন জ্বালানি সরবরাহকারী ট্যাংকার নির্দিষ্ট প্যাটার্নে এর দিকে উড়ে যায়, তখন এর অবস্থান ও গন্তব্য অনুমান করা যায়। এভাবেই গতকাল আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলো এই বিমান উড্ডয়নের সংবাদ লাইভ করেছিল।

জ্বালানি নিতে ট্যাংকারের পেছনে যুদ্ধবিমান (এ ক্ষেত্রে বি-২) ২০ মিটার দূরে চলে আসে। যত দ্রুত বিমান দুটি নির্ধারিত অবস্থানে আসে এবং যুক্ত হয়, জ্বালানি সরবরাহের প্রক্রিয়া শুরু হয় তত তাড়াতাড়ি। জ্বালানি দেওয়ার কাজ প্রায় দশ থেকে পনেরো মিনিট ধরে চলে। জ্বালানি সরবরাহের পদ্ধতি ও গ্রহণকারী বিমানের ওপর নির্ভর করে ট্যাংকার প্রতি মিনিটে গড়পড়তা হিসেবে ১ হাজার ৬০০ কেজি পর্যন্ত জ্বালানি সরবরাহ করতে পারে। এই সংখ্যাটি একদম নির্ধারিত নয়, স্বাভাবিকভাবেই। বিমান ভেদে এই পরিমাণ পরিবর্তনশীল। দেড় হাজার থেকে ১০ হাজার মিটার উচ্চতায় প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৫০০ কিলোমিটার বেগে উড়তে উড়তে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়।

আরেকটি বিকল্প পদ্ধতি আছে—একটি প্রোব এবং একটি ড্রোগ (তেল সরবরাহের জন্য পাইপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংযোগ) ব্যবহার করা। এ সময় ট্যাংকারের পেছনে থাকে সংগ্রহকারী বিমান।

পুরো প্রক্রিয়াটি একজন এয়ার রিফুয়েলিং অফিসার পর্যবেক্ষণ করেন। সরবরাহকৃত জ্বালানির পরিমাণ, আবহাওয়া ও অন্যান্য স্থানীয় অবস্থার ওপর ভিত্তি করে জ্বালানি সংগ্রহের গতি সমন্বয় করেন তিনি। বিমানগুলোর মধ্যে কম দূরত্ব বজায় রাখা এবং ধীরে ধীরে যেকোনো গতি সমন্বয় করার দায়িত্ব পালন করে অটোপাইলট। সাধারণত আকাশপথে পরিষ্কার আকাশ এবং স্থিতিশীল বাতাসের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের ইরানে হামলার এই অভিযানের মতো অপারেশনগুলো সাধারণত সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা করা হয়। সময়সূচী অনুসারে একের পর এক ট্যাংকার জ্বালানি সরবরাহের কাজে নিয়োজিত থাকে। জ্বালানি সরবরাহ করে ট্যাংকার বিমান সামরিক ঘাঁটিতে ফিরে আসে। আবহাওয়া এবং পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে একই সঙ্গে দুটি বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করাও অস্বাভাবিক নয়।

পুরো প্রক্রিয়াটি একজন এয়ার রিফুয়েলিং অফিসার পর্যবেক্ষণ করেন। সরবরাহকৃত জ্বালানির পরিমাণ, আবহাওয়া ও অন্যান্য স্থানীয় অবস্থার ওপর ভিত্তি করে জ্বালানি সংগ্রহের গতি সমন্বয় করেন তিনি।

আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহের দুটি সাধারণ পদ্ধতি আছে। যদি বুম সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, তাহলে ট্যাংকার বিমানটি গ্রহণকারী বিমানের সামনে অবস্থান করে। ট্যাংকারের পেছনের অংশে একটি ‘বুম’, মানে পাইপ থাকে। এটি অল্প নড়াচড়া করতে পারে। এটিকে গ্রহণকারী বিমানের জ্বালানি ট্যাঙ্কের সঙ্গে ডক বা যুক্ত করা হয়। বুম এবং নজল লক করার মাধ্যমে একটি বৈদ্যুতিক সার্কিট সম্পূর্ণ হয়। সার্কিট পূর্ণ হলেই চাপযুক্ত জ্বালানি পাম্প করা শুরু হয়। জ্বালানি ভরার সময় গ্রহণকারী বিমানটি ট্যাংকার বিমানের পেছনে বা নিচে অবস্থান করে ওড়ে। জ্বালানি ভরার প্রক্রিয়া শেষ হলে ভালবগুলো আটকে দেওয়ার পর বুমটি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে বি-২ বিমানে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছে।

আরেকটি বিকল্প পদ্ধতি আছে—একটি প্রোব এবং একটি ড্রোগ (তেল সরবরাহের জন্য পাইপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংযোগ) ব্যবহার করা। এ সময় ট্যাংকারের পেছনে থাকে সংগ্রহকারী বিমান। এই বিমানের পাইলট প্রোবটিকে ড্রোগের মধ্যে প্রবেশ করান। ড্রোগ প্রোবের অগ্রভাগ এবং ভালবের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে একবার লক হয়ে গেলে চাপের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

এই পদ্ধতিতে ট্যাংকারের পাইলটকে অনেক নির্ভুলভাবে উড়তে হয়। প্রোব-অ্যান্ড-ড্রোগ পদ্ধতিতে ২২ মিটার লম্বা নল বিমানকে পরস্পর থেকে দূরে রাখে। এভাবে সংঘর্ষের ঝুঁকি কমানো হয়।

আকাশপথে জ্বালানি সরবরাহ প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯২০-এর দশকে। এই পদ্ধতি কয়েক দশক ধরে পরিমার্জিত হয়েছে। শত বছরের বেশি সময়ে প্রযুক্তির অসামান্য উন্নতি ঘটেছে। আগামীতে এআই ব্যবহারের এই প্রক্রিয়া হয়তো স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: অ্যারোরিপোর্ট ও ইউরোনিউজ

আরও পড়ুন