বিমান কীভাবে ওড়ে

বিমান রানওয়েতে খানিকটা ছুটে উড়ে যায়। তারপর চমৎকারভাবে ভেসে থাকে বাতাসে। এগিয়ে যায় বাতাস কেটে নির্ধারিত গন্তব্যের পথে। কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিমান আসলে কীভাবে বাতাসে ভেসে থাকে। ওড়েই বা কীভাবে?

বিমানের ইঞ্জিন ওটাকে ছুটিয়ে নেয়, আর ডানা ভাসিয়ে রাখে!ছবি: সংগৃহীত
বিমানের ওপরে মূলত চার ধরনের বল কাজ করে। এই বলগুলোর ইংরেজি নাম হলো লিফট, ড্র্যাগ, গ্র্যাভিটি এবং থ্রাস্ট। সবগুলোর যথাযথ বাংলা নেই, সেজন্য ইংরেজিটাই আগে বলা।

আমরা দেখি, বিমান রানওয়েতে খানিকটা ছুটে উড়ে যায়। তারপর চমৎকারভাবে ভেসে থাকে বাতাসে, এগিয়ে যায় বাতাস কেটে নির্ধারিত গন্তব্যের পথে। অনেকেরই হয়তো বিমানে নিয়মিত চড়া হয় না। তবে মনে প্রশ্ন জন্ম দেয়, বিমান আসলে কীভাবে বাতাসে ভেসে থাকে। আরও সংক্ষেপে প্রশ্নটা এমন—বিমান কীভাবে ওড়ে?

এই প্রশ্নের জবাব কেউ কেউ হয়তো এক কথায়ই দিয়ে দিতে পারেন, কেন, বিমানের ইঞ্জিন ওটাকে ছুটিয়ে নেয়, আর ডানা ভাসিয়ে রাখে! কথাটা ঠিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে? আমরা যদি দুহাত বাতাসে ভাসিয়ে দিই কিংবা যেকোনো কিছুতে ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে ছুড়ে দিই বাতাসে, তাহলেই কি জিনিসটা ভেসে থাকবে? তা তো নয়! এখানেই চলে আসে বিজ্ঞান। আসলে, পদার্থবিজ্ঞান।

বিমান রানওয়েতে খানিকটা ছুটে উড়ে যায়। তারপর চমৎকারভাবে ভেসে থাকে বাতাসে
ছবি: সংগৃহীত

বিমানের ওপরে মূলত চার ধরনের বল কাজ করে। এই বলগুলোর ইংরেজি নাম হলো লিফট, ড্র্যাগ, গ্র্যাভিটি এবং থ্রাস্ট। সবগুলোর যথাযথ বাংলা নেই, সেজন্য ইংরেজিটাই আগে বলা। গ্র্যাভিটি মানে যে মহাকর্ষ, এটা আমরা জানি। এই গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ বলটা আকর্ষণমূলক। পৃথিবীর ক্ষেত্রে, পৃথিবীর মহাকর্ষ সব কিছুকে ভূপৃষ্ঠের দিকে টানে। অর্থাৎ এটা বিমানের ওড়ার প্রচেষ্টার বিপরীতে কাজ করে।

আরও পড়ুন
ড্যানিয়েল বার্নুলি ছিলেন সুইস গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী। প্রবাহী নিয়ে তিনি এই সূত্রটি দেন। প্রবাহী মানে কী? যা প্রবাহিত হয়। যেমন তরল—পানি বা জুস কিংবা বায়বীয়—বাতাস বা জলীয় বাষ্প ইত্যাদি। এগুলো স্বাভাবিকভাবেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গড়িয়ে যায়, মানে প্রবাহিত হয়।

এটাকে বাতিল করে দিতে কাজ করে লিফট বল। মানে, যে বলটা বিমানকে ওপরের দিকে তুলতে চায়। আমরা চাইলে বাংলায় এটাকে উত্তোলন বল বলতে পারি। মহাকর্ষ এবং এই উত্তোলন বল পরস্পর সমান ও বিপরীত। অর্থাৎ একে অন্যকে বাতিল করে দেয়। তাই বিমান যে উচ্চতায় রয়েছে, সে উচ্চতাতেই ভেসে থাকতে পারে। মহাকর্ষ বেশি হলে বিমান ওই উচ্চতায় থাকবে না, নিচের দিকে পড়তে থাকবে। আর উত্তোলন বল বেশি হলে বিমান অনিয়ন্ত্রিতভাবে ওপরের দিকে উঠে যেতে থাকবে। এর কোনোটাই হয় না। একটা আরেকটাকে বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ ওপরে বা নিচের দিকে প্রযুক্ত লব্ধি বলের পরিমাণ হয় শূন্য। আর কোনো কিছুর ওপর লব্ধি বল শূন্য হলে সেটা যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকে। গতিশীল বস্তু সুষম গতিতে ছোটে, স্থির বস্তু স্থির থাকে। বিমান যেহেতু নির্দিষ্ট উচ্চতায় ভেসে ছিল, তাই সে উচ্চতাতেই ভেসে থাকে।

এই লিফট বা উত্তোলন বল কীভাবে তৈরি হচ্ছে? এখানেই মাথা খাটিয়ে চালাকিটা করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বিমানের ডানাগুলো খুব যত্ন করে নকশা করেন। আর এক্ষেত্রে কাজে লাগে বার্নুলির নীতি।

ড্যানিয়েল বার্নুলি ছিলেন সুইস গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী। প্রবাহী নিয়ে তিনি এই সূত্রটি দেন। প্রবাহী মানে কী? যা প্রবাহিত হয়। যেমন তরল—পানি বা জুস কিংবা বায়বীয়—বাতাস বা জলীয় বাষ্প ইত্যাদি। এগুলো স্বাভাবিকভাবেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গড়িয়ে যায়, মানে প্রবাহিত হয়।

বার্নুলি বললেন, প্রতি একক আয়তনে সান্দ্রতাহীন, অসংকোচনীয় কোনো প্রবাহীর মোট চাপ, বিভব ও গতিশক্তি সবসময় ধ্রুবক হয়। কঠিন কঠিন শব্দগুলো বাদ দিয়ে আমরা যদি সহজভাবে বলি, তাহলে একক আয়তনে প্রবাহীর মোট চাপ, বিভব শক্তি এবং গতিশক্তি সবসময় একই থাকবে, বদলাবে না। তাই চাপ যদি বাড়ে, গতিশক্তি বা বিভবশক্তি কমে যাবে। আবার গতিশক্তি বা বেগ বেড়ে গেলে কমে যাবে চাপ।

আরও পড়ুন
শুধু ভেসে থাকলেই তো চলবে না, এগোতেও হবে। এক্ষেত্রেও সামনে-পেছনে বরাবর দুটো বল কাজ করে। একটা হলো ড্র্যাগ ফোর্স বা বাতাসের বাধা। এটা বিমানকে বাতাস কেটে সামনে এগোতে বাধা দেয়। এই বাধাকে পেরিয়ে যেতেই বিমানে ইঞ্জিন থাকে। ইঞ্জিনের কাজ হলো, জ্বালানি পুড়িয়ে উচ্চচাপের উত্তপ্ত গ্যাস পেছন দিক দিয়ে বের করে দেওয়া।
আরও পড়ুন

বিমানের পাখা বা ডানা এমনভাবে নকশা করা হয়, যেন পাখার ওপর দিয়ে বাতাস পেরোনোর সময় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বেশি দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে। বেশি দূরত্ব কম সময়ে পাড়ি দেওয়া মানে, দ্রুত পেরোনো। অর্থাৎ বিমানের পাখার ওপর দিয়ে প্রবাহিত বাতাসের বেগ বেশি হয়। তাই চাপ কমে যায়।

সে তুলনায় যে বাতাসটুকু বিমানের ডানার নিচ দিয়ে যায়, সেটাকে একই সময় কম দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়। অর্থাৎ তার বেগ হয় কম। কিন্তু বার্নুলির নীতি অনুযায়ী, দুই ক্ষেত্রেই বাতাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শক্তির মান অবশ্যই ধ্রুবক হতে হবে। এর ফলে ডানার নিচে বাতাসের চাপ হয় বেশি। মানে, বিমানের ডানার নিচে বাতাসের চাপ বেশি, আর ওপরে চাপ কম। ওপরে ও নিচে চাপের একটা পার্থক্য তৈরি হয়। এই পার্থক্যের সমান বলে বিমানের ডানাকে বাতাস ওপরের দিকে ধাক্কা দেয়। এর ফলেই তৈরি হয় সেই লিফট ফোর্স বা উত্তোলন বল, যেটা মহাকর্ষের প্রভাব নাকচ করে দেয়। ভাসিয়ে রাখে বিমানকে।

কিন্তু শুধু ভেসে থাকলেই তো চলবে না, এগোতেও হবে। এক্ষেত্রেও সামনে-পেছনে বরাবর দুটো বল কাজ করে। একটা হলো ড্র্যাগ ফোর্স বা বাতাসের বাধা। এটা বিমানকে বাতাস কেটে সামনে এগোতে বাধা দেয়। এই বাধাকে পেরিয়ে যেতেই বিমানে ইঞ্জিন থাকে। ইঞ্জিনের কাজ হলো, জ্বালানি পুড়িয়ে উচ্চচাপের উত্তপ্ত গ্যাস পেছন দিক দিয়ে বের করে দেওয়া। প্রচণ্ড বেগে বেরিয়ে আসে এই উত্তপ্ত গ্যাস। এটা বিমানের পেছনের বাতাসকে ধাক্কা দেয়। আর নিউটনের তৃতীয় সূত্রানুসারে, পেছনের বাতাস তখন বিমানকে সমান ও বিপরীত বেগে সামনের দিকে ধাক্কা দিতে বাধ্য হয়। আবার বিমানের গায়ের পুরোটা খুব মসৃণ হয়। ফলে বাতাসের বাধা পেরিয়ে বিমান এগিয়ে যায় সামনে, ছোটে গন্তব্যপানে, নিশ্চিন্তে।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: নাসা, পিএইচএল, উইকিপিডিয়া