মোবাইলের ডিসপ্লেতে ছবি তৈরি হয় কীভাবে

স্মার্টফোনের ডিসপ্লেতে দেখা ছবি আসলে একধরনের ইল্যুশনছবি: সংগৃহীত

স্মার্টফোনের ডিসপ্লেতে আমরা যে ছবি দেখি, তা আসলে একধরনের ইল্যুশন বা বিভ্রম। আমাদের মস্তিষ্ক এবং চোখের সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে এই পুরো প্রক্রিয়াটা বাস্তবায়িত হয়। বিষয়টা বোঝার জন্য আমাদের চোখের দৃষ্টিক্ষমতার কথা জানা প্রয়োজন প্রথমে।

আমাদের চোখের রেটিনায় মূলত তিন ধরনের রংসংবেদী স্নায়ু আছে। বর্ণালির ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের প্রতি সাড়া দেয় এসব সংবেদী স্নায়ু। বর্ণালির প্রতিটি তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে একেকটি রং হিসাবে আমরা দেখতে পাই। সে হিসাবে আমাদের চোখ যে তিন ধরনের রং মূলত দেখতে পায়, সেগুলো হলো লাল, সবুজ এবং নীল আলো। এই তিন ধরনের আলোর প্রতিটির মোট তীব্রতাকে বোঝার সুবিধার্থে ১০০ শতাংশ ধরে নিতে পারি। অর্থাৎ ১০০ শতাংশ তীব্র লালকেই আমরা লাল বলব। তীব্রতা কম হলে সেটা হালকা লাল বা লালের অন্য কোনো ধরন হবে। একই কথা সবুজ ও নীল আলোর জন্যও সত্যি।

১০০ শতাংশ তীব্র লাল (Red), সবুজ (Green) ও নীল (Blue) আলোর মিশ্রণকে আমাদের চোখ সাদা আলো হিসাবে দেখে। এসব আলোর তীব্রতা কমিয়ে ও বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে যেকোনো ধরনের আলো ফুটিয়ে তোলা যায়। স্মার্টফোনসহ অন্যান্য যন্ত্রে ছবি ফুটিয়ে তোলার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই তিনটি আলোকে সে হিসাবে মৌলিক আলোকরং বলে ধরা হয়। পদ্ধতিটিকে সংক্ষেপে বলা হয় আরজিবি (RGB), আলো তিনটির ইংরেজি নামের অদ্যাক্ষর অনুসারে।

আরও পড়ুন
প্রতিটি পিক্সেল আবার কিছু উপপিক্সেলে বিভিক্ত থাকে। এগুলো মৌলিক তিনটি রং—লাল, সবুজ ও নীল আলো ফুটিয়ে তোলে। আরজিবি নামের এই প্রযুক্তিগত ধারণাটি আমরা আগেই দেখেছি।

মস্তিষ্কের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি নিয়ে আমরা একটু পরে আলোচনা করব। এবারে দেখা যাক, স্মার্টফোনের ডিসপ্লের মূল উপাদান অংশগুলো এবং এগুলোতে কী হয়।

প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, স্মার্টফোনের ডিসপ্লে নিজে কোনো আলো বিকিরণ করে না। এর নিচে বসানো আলোক উৎসের ওপর নির্ভর করে। আধুনিক ফোনগুলোর ডিসপ্লেতে ব্যাকলাইট থাকে। অর্থাৎ পেছনে একটা প্যানেলে এলইডি (লাইট এমিটিং ডায়োড) বা ফ্লুরোসেন্ট টিউব বসানো থাকে। এগুলো পুরো ডিসপ্লেজুড়ে সুষমভাবে আলো বিকিরণ করে।

এ ছাড়াও ডিসপ্লেতে দুটি পোলারাইজিং ফিল্টার থাকে। এসব ফিল্টারের মধ্য দিয়ে শুধু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো অতিবাহিত হতে পারে। এই ফিল্টার দুটোর মাঝখানে থাকে একটি তরল ক্রিস্টাল বা কেলাসের স্তর, ঠিক স্যান্ডউইচের মতো। তরল কেলাস মানে এমন অণুর দল, যেগুলো তড়িৎ প্রবাহের প্রতিক্রিয়া হিসাবে সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে সজ্জিত হতে পারে। অর্থাৎ এটি বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাতলা ফিল্মের ট্রানজিস্টর (টিএফটি) বা অন্য কোনো পিক্সেল নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তির মাধ্যমে এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

আরও পড়ুন
স্মার্টফোনের ডিসপ্লে নিজে কোনো আলো বিকিরণ করে না
ছবি: সংগৃহীত

কথা হলো, পিক্সেল কী? পিক্সেল কথাটির পূর্ণরূপ পিকচার এলিমেন্ট। শব্দ দুটির শুরুর অংশ একসঙ্গে মিলে এর সংক্ষিপ্ত রূপটি এসেছে। স্মার্টফোনের ডিসপ্লে অনেকগুলো পিক্সেল দিয়ে গঠিত। প্রতিটি পিক্সেল একেকটি ক্ষুদ্র একক। সরল করে বলা যায়, ডিসপ্লের গাঠনিক একক। আরেকটু ঠিক করে বলতে হয়, নামেই যেমন আছে, যেকোনো ছবিবিষয়ক তথ্য ফুটিয়ে তোলার একক বা ক্ষুদ্রতম অংশ এই পিক্সেল। ডিসপ্লেতে প্রতিটি পিক্সেল স্বাধীনভাবে আলো বিকিরণ করতে বা বিকিরণে বাধা দিতে পারে। সাধারণত পিক্সেলগুলো গ্রিড আকারে বিন্যস্ত থাকে। এই পিক্সেলের সংখ্যাই ঠিক করে দেয় প্রদর্শিত ছবির রেজ্যুলুশন এবং স্পষ্টতা কেমন হবে।

প্রতিটি পিক্সেল আবার কিছু উপপিক্সেলে বিভিক্ত থাকে। এগুলো মৌলিক তিনটি রং—লাল, সবুজ ও নীল আলো ফুটিয়ে তোলে। আরজিবি নামের এই প্রযুক্তিগত ধারণাটি আমরা আগেই দেখেছি। তার মানে, এই উপপিক্সেলগুলো একসঙ্গে মিলে মৌলিক তিনটি আলোকে বিভিন্ন অনুপাতে মিশিয়ে মানুষের চোখে দৃশ্যমান যেকোনো রঙের আলো তৈরি করতে পারে।

এখানেই মস্তিষ্কের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার বিষয়টি চলে আসে। ১ পিক্সেল = ২৬৪.৫৮৩৩ মাইক্রোমিটার। আর ১ মাইক্রোমিটার মানে ১০-৬ মিটার। অর্থাৎ ১ পিক্সেল = ২৬৪.৫৮৩৩×১০-৬ মিটার। এত ক্ষুদ্র জিনিস আমাদের চোখ আলাদা করে দেখতে পায় না। মস্তিষ্ক আলাদা করে এগুলোকে শনাক্ত করতে পারে না। তাই পুরো জিনিসটাকে, অর্থাৎ লাখো পিক্সেলের সমন্বয়ে গঠিত কোনো ছবিকে মস্তিষ্ক একটা ছবি হিসাবেই দেখে।

এখন, আমরা বুঝেছি, ডিসপ্লেতে পিক্সেল থাকে। আর ভেতরের অংশে আছে দুটি পোলারাইজিং ফিল্টার ও এর মাঝখানে একটি তরল কেলাসের স্তর। এটা বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু এই বিদ্যুৎ কোত্থেকে, কী হিসাবে আসছে?

আরও পড়ুন
যাঁরা স্মার্টফোনের বিষয়ে একটু ভালোভাবে জানেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, রিফ্রেশ রেট বলে আরেকটা বিষয় আছে। এটার কাজ হলো, একটু পরপর ফোনের ডিসপ্লেকে রিফ্রেশ করা।

আমরা জানি, ফোনের ভেতরে প্রসেসর বা গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) থাকে। এটার কাজই ছবির তথ্য প্রক্রিয়াজাত করা। ফোনের সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশনের (অ্যাপ) মাধ্যমে এটা ছবির ডাটা বা তথ্য পায়। এসব তথ্য প্রক্রিয়াজাত করে সিগন্যালে রূপান্তর করা হয়। এই সিগন্যাল বিদ্যুতের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এই বিদ্যুৎটাই পরে ডিসপ্লের ভেতরের তরল কেলাসের স্তরে প্রয়োগ করা হয়। কীভাবে প্রয়োগ করা হবে? সেজন্য প্রতিটি পিক্সেলের সঙ্গে যুক্ত থাকে একটি করে ট্রানজিস্টর (পাতলা ফিল্মের ট্রানজিস্টর বা টিএফটি—এটা আমরা আগেই দেখেছি)। এটাই ভেতরের তরল কেলাসের স্তরটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এতে বিদ্যুৎ প্রবাহ প্রয়োগের মাধ্যমে কেলাসের অণুগুলোর বিন্যাস নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

বিদ্যুতের প্রবাহ তরল কেলাসে প্রয়োগ করা হলে সেগুলোর বিন্যাস বদলে যায় ছবি অনুসারে। সে অনুযায়ী পোলারাইজিং ফিল্টারের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ আলো যেতে পারে। ছবি অনুযায়ী এই নির্দিষ্ট পরিমাণ আলোই ঠিক করে দেয় কোন পিক্সেলের মধ্য দিয়ে আলো যাবে আর কোনটা আলোকে যেতে বাধা দেবে, অর্থাৎ অন্ধকার হয়ে থাকবে।

এসব প্রক্রিয়ার ফলে প্রতিটি পিক্সেলের নিয়ন্ত্রিত ও পরিমার্জিত নানা রঙের আলো পোলারাইজিং ফিল্টারের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে, একসঙ্গে মিলে তৈরি করে গোটা ছবিটি। এই ছবিই ডিসপ্লের স্বচ্ছ বহিরাবরণে ফুটে ওঠে দেখার জন্য।

এই পুরো প্রক্রিয়াটা প্রতিটি পিক্সেলের জন্যই ঘটে অতিদ্রুত। ফলে যে গোটা ছবিটা তৈরি হয়, তা ফোনের ডিসপ্লেতে দেখা যায়।

যাঁরা স্মার্টফোনের বিষয়ে একটু ভালোভাবে জানেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, রিফ্রেশ রেট বলে আরেকটা বিষয় আছে। এটার কাজ হলো, একটু পরপর ফোনের ডিসপ্লেকে রিফ্রেশ করা। ফলে যে ছবিটা ডিসপ্লেতে দেখা যাচ্ছে, তা এ সময় আপডেট হয়। নতুন কোনো তথ্য যুক্ত হলে বা ছবি বদলে গেলে সেটাও হয় এ সময়। এ বিষয়টাও এত ঘন ঘন হয় যে মস্তিষ্ক এত দ্রুত নড়াচড়া ধরতে পারে না। এটাকে সে ধারাবাহিক ও মসৃণভাবে অনুভব করে। দেখে চমৎকার কোনো ছবি ফুটে উঠেছে ফোনের স্ক্রিনে।

লেখক: সহসম্পাদক, বিজ্ঞানচিন্তা

সূত্র: এক্সপ্লোরেটোরিয়াম, উইকিপিডিয়া

আরও পড়ুন