প্রযুক্তি
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্ম: ভুল থেকে শেখা শুরু
কম্পিউটারকে নির্দেশনা দিয়ে কি যেকোনো কাজ করিয়ে নেওয়া যায়? এই যন্ত্রকে শেখানো হলে কি নিজ থেকে সমস্যার সমাধান করতে পারবে? কীভাবে কম্পিউটার ভুল থেকে শেখে? ভুল থেকে কম্পিউটারকে শেখানোর এই পদ্ধতিটা কে আবিষ্কার করলেন?
কম্পিউটারকে আমরা সব সময় নির্দেশনা দিয়ে কাজ করিয়ে নিই। কিন্তু সব কিছুই কি আর নির্দেশনা দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায়? এই যন্ত্রকে শেখানো সম্ভব হলেই এটি নিজ থেকেই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারবে। এই শেখানোর কাজের জন্য নির্দেশনা নয়, বরং ভুল থেকে কম্পিউটারকে শেখাতে হবে। যেভাবে আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে, অনেকটা সেভাবে। কম্পিউটার কীভাবে ভুল থেকে শিখবে? সেই মৌলিক আবিষ্কারের কাজটি করেন বিজ্ঞানী জিওফ হিন্টন।
১৯৮০-এর দশকে কম্পিউটার প্রযুক্তি উন্নয়নের ফলে কম্পিউটারকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার শুরু হলো। সেই সময়ের কাজগুলো করা হতো লজিকের মাধ্যমে। কম্পিউটারকে কিছু সুনির্দিষ্ট কোড লিখে নির্দেশনা দেওয়া হতো, কোন কাজের পর কোনটা করতে হবে। কম্পিউটার যেন আমাদের লিখিত নির্দেশনা বুঝতে পারে, সেজন্য তৈরি করা হয় কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা। প্রধান সমস্যা হলো, কম্পিউটারকে দিয়ে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রযুক্তিবিদদের কোডিং করে সুনির্দিষ্ট করে নির্দেশনা দিতেই হবে। খুঁটিনাটি নির্দেশনা ছাড়া কম্পিউটার কোনো কিছু করতে অক্ষম। এমনকি, কোডের মধ্যে সামান্য কোন ভুল থাকলে কম্পিউটার আর কাজ করে না। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কম্পিউটারকে নির্দেশনা দিয়েই কাজ করিয়ে নিতে হয়েছে।
অবশ্য তা ক্রমিক নির্দেশনা নয়, বরং কম্পিউটারকে দিয়ে সুদূরপ্রসারী কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য ভুল থেকে শেখা উচিত। মানুষ যেভাবে ছোট খাট কিছু ভুল করে, এবং সেই ভুল থেকে শিখে পরে অন্যভাবে কাজ করে, অনেকটা সেভাবে। আর এই ভুল থেকে শেখার পদ্ধতিটি কম্পিউটারে প্রয়োগের জন্য যে বিজ্ঞানী কাজ করেছেন, তাঁর নামই জিওফ হিন্টন। মানুষ তাঁকে ‘গড ফাদার অব ডিপ লার্নিং’ বা ডিপ লার্নিংয়ের জনক নামেও চেনে। তবে ডিপ লার্নিং সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগে, এই বিজ্ঞানী সম্পর্কে একটু জেনে নিই।
১৯৪৭ সাল। যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। কিন্তু বাতাসে তখনো মিশে আছে যুদ্ধের বারুদের গন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে, ৬ই ডিসেম্বর সকালে লন্ডনের উইম্বলডনে জন্ম নেয় এক শিশু। মা-বাবার স্নেহের সেই শিশুটি যে একদিন পৃথিবীর চিন্তাধারাকে বদলে দেবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কিংবদন্তি হয়ে উঠবে, তা কে জানত! তাঁর নাম রাখা হলো জিওফ্রে এভারেস্ট হিন্টন। অনেকে উচ্চারণ করেন জিউফ বা জেফ বলে।
জিওফের জন্মের বছরটি ছিল নানা কারণে অসাধারণ। ১৯৪৭ সালেই ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতা পায় ভারত এবং পাকিস্তান। পুরো বিশ্ব তখন নতুন এক যুগের সূচনা দেখছে। মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে। ইংল্যান্ডের মানুষ যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক সঙ্কটে তখনও জর্জরিত। কিন্তু সমাজে আশার আলো ফিরে আসছিল ধীরে ধীরে। লন্ডনের সেই সময়টা ছিল অন্যরকম। মানুষ রেডিওতে শুনছে নতুন গানের সুর, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছড়িয়ে আছে বেকারত্ব। তবুও চারদিকে বইছে এক নতুন আশার হাওয়া। মানুষের পোশাকে আসছে পরিবর্তন, রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বড় বড় হ্যাট পরা ভদ্রলোকেরা। মহিলাদের পোশাকে ফ্যাশনের নতুন ঢেউ। উইম্বলডনের বিখ্যাত টেনিস টুর্নামেন্টও তখন যুদ্ধের বিরতি শেষে আবার ফিরছে নতুন রূপে।
জিওফ হিন্টনের বাবা হাওয়ার্ড হিন্টন ছিলেন একজন বিখ্যাত এনটোমলজিস্ট, অর্থাৎ পোকামাকড় নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী। কীটপতঙ্গের গঠন, স্বভাব ও অভিযোজন পদ্ধতি বিশ্লেষণ করতে করতে তাঁর জীবন কেটেছে। এছাড়া তার দাদা জর্জ বুল ছিলেন গণিতবিদ। আজ আমরা যাকে বুলিয়ান অ্যালজেব্রার জনক হিসেবে জানি, সেই জর্জ বুল। আধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, সার্কিট ডিজাইন এবং লজিক গেটের ভিত্তিই গড়ে উঠেছে জর্জ বুলের হাতে। জর্জ বুল ছিলেন স্বশিক্ষিত। তিনি নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছিলেন গণিত ও যুক্তিবিজ্ঞানের একটি নতুন ধারা। তাঁর লেখা দ্য ল’স অব থট বইটি আজও যুক্তিতত্ত্ব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বুনিয়াদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
পরিবারের এই বৈজ্ঞানিক পরিবেশে বড় হতে হতে শিশু জিওফের মনে জন্ম নিতে শুরু করে পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখার আগ্রহ। সে বুঝতে পারে, আশপাশের দৃশ্যমান জগতের পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর রহস্য। জিওফ হিন্টন যখন নিউরাল নেটওয়ার্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন অনেকেই বুঝে উঠতে পারেননি, তাঁর এই গবেষণার গাঁথুনি কোথা থেকে আসছে। কিন্তু ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায়, তাঁর পূর্বপুরুষই ছিলেন সেই প্রথম মানুষ, যিনি যুক্তিকে গাণিতিক রূপ দিয়ে ডিজিটাল যুগের বীজ বপন করেছিলেন।
হাইস্কুলে পড়ার সময় হিন্টন ছিলেন মেধাবী ও চিন্তাশীল এক কিশোর। ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েরা যখন ফুটবল মাঠে ছুটছে কিংবা সঙ্গীত নিয়ে মাতোয়ারা, হিন্টন তখন বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ভাবছেন, মানুষের মন আসলে কীভাবে কাজ করে? কেন আমরা যা দেখি বা শুনি, তা আমাদের স্মৃতিতে আটকে যায়? কীভাবে ভাবনা জন্ম নেয়? এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে ১৯৬৭ সালে তিনি ভর্তি হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে। কেমব্রিজ তখন তরুণদের কাছে স্বপ্নের নাম। ব্রিটেনের সেরা মেধাগুলো এখানে জড়ো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তখন তুমুল বিতর্ক চলছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্য থেকে শুরু করে মানবমস্তিষ্কের রহস্য—সব বিষয়ে আলোচনা যেন উড়ছে বাতাসে। এই পরিবেশেই হিন্টনের মেধার প্রস্ফুটন ঘটে।
১৯৭০ সালে কেমব্রিজ থেকে এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজি বিষয়ে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন জিওফ। কিন্তু তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা যেন আরও বাড়তে থাকে। তাই তিনি ব্রিটেনের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। সেখানে শুরু করেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পিএইচডি গবেষণা। এডিনবরা তখন এআই গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেখানে মিলিত হয়েছিলেন দুনিয়ার সেরা গবেষকরা। এই গবেষকেরা মনে করতেন, কম্পিউটার হয়তো মানুষের মস্তিষ্কের মতো করেই চিন্তা করতে পারে।
মজার ব্যাপার হলো, হিন্টনের গবেষণা জীবনের শুরুতে কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তখন অনেক বিজ্ঞানী বিশ্বাস করতেন না যে, কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যন্ত্র সত্যিকারের মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করতে পারবে। কিন্তু হিন্টনের মনে ছিল অদ্ভুত দৃঢ় বিশ্বাস। মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে শেখে, যেভাবে ভুল থেকে শেখে, সেই পথ অনুসরণ করেই একদিন মেশিনকে শেখানো যাবে।
সেই সময়ের একটি মজার গল্প প্রচলিত আছে। পিএইচডি গবেষণা করতে গিয়ে একবার হিন্টন দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন তাঁর ল্যাবে। দিনের পর দিন নিরলসভাবে কাজ করে চলেছিলেন। এক রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন ল্যাবের ডেস্কেই। পরদিন সকালে প্রফেসর এসে দেখলেন, হিন্টন টেবিলের ওপর মাথা রেখে গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত। তখন হাসতে হাসতে প্রফেসর বলেছিলেন, এইতো, আমাদের তরুণ বৈজ্ঞানিকের মস্তিষ্ক এখন বিশ্রাম নিচ্ছে। পরে এই ঘটনা বন্ধুদের কাছে জনপ্রিয় এক গল্প হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৭৮ সালে যখন হিন্টন তাঁর পিএইচডি শেষ করেন, ততদিনে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, নিউরাল নেটওয়ার্ক নামে বিশেষ এক ধরনের কম্পিউটার ব্যবস্থা মানুষের মস্তিষ্কের মতোই শেখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে।
তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল দৃষ্টিশক্তি ও রিলাক্সেশন। সাধারণ মানুষের কাছে নামটি বেশ কঠিন শোনালেও বিষয়টির মূল কিন্তু খুব সহজ ও বিস্ময়কর। আমাদের চোখ যে বস্তু দেখছে, তার অর্থ মস্তিষ্ক কীভাবে বের করে? কোনো বস্তু অস্পষ্ট হলে মস্তিষ্ক কীভাবে ধীরে ধীরে তার অর্থ খুঁজে পায়? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানেই তিনি গবেষণায় ডুব দিয়েছিলেন।
১৯৭৮ সালে যখন হিন্টন তাঁর পিএইচডি শেষ করেন, ততদিনে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, নিউরাল নেটওয়ার্ক নামে বিশেষ এক ধরনের কম্পিউটার ব্যবস্থা মানুষের মস্তিষ্কের মতোই শেখার ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। যদিও সেই সময়ের বিজ্ঞানী সমাজে এই ধারণা ছিল হাস্যকর এক কল্পনা মাত্র।
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ক্রিস্টোফার লঙ্গেট-হিগিন্সের অধীনে তিনি শুরু করেন এই অসাধারণ গবেষণা। সেই সময়কার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগৎ তখনো খুব সরল, রীতিমতো শিশু পর্যায়ে। সেই সরল জগতেই হিন্টন নিয়ে এলেন এক অভিনব ধারণা—মস্তিষ্কের কাজ কোনো সরল, ক্রমিক গণনা নয়, বরং অসংখ্য নিউরনের একযোগে তথ্য বিনিময়ের এক বিস্ময়কর জাল। তিনি ভাবলেন, মানুষের মস্তিষ্ক যেমন চোখ থেকে আসা অস্পষ্ট ছবি বারবার প্রক্রিয়াকরণ করে একটি স্পষ্ট রূপ দেয়, তেমনি কম্পিউটারকেও শেখানো সম্ভব এই পদ্ধতিতে। এটিকেই তিনি বলেছিলেন ‘রিলাক্সেশন’ প্রক্রিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্টনের সুখ্যাতি ছিল তাঁর সরল আর চঞ্চল ব্যক্তিত্বের কারণে। একবার বড় একটি সেমিনারে নিজের বক্তৃতার মাঝপথে হঠাৎ খেয়াল করলেন, তিনি দুই পায়ে দুই ধরনের জুতো পরে এসেছেন! সবাই যখন হাসছিল, তখনও হিন্টন ছিলেন নির্বিকার। বরং পরে নিজেই এই গল্প বলতেন মজা করে।
শুধু কি তাই, বন্ধুদের মতে হিন্টন ছিলেন রসিক মানুষ। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে একবার তিনি হাস্যকর ভুয়া বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে আজগুবি বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে লেখা ছিল। এতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল হইচই।
১৯৭০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণার জগতটা ছিল একেবারেই নিরব। আর সেই কারণে এই সময়টিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শীতকাল বলে। এর পেছনে কারণও ছিল। গবেষণার জন্য চাই অর্থ। তখন কেউই এই খাতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেনি। কেউই মনে করতেন না যে মেশিনের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা ঢুকানো সম্ভব। এছাড়া কম্পিউটার প্রযুক্তি তেমন সক্ষম হয়ে ওঠেনি। তবে এই শীতকালেও কিছু কিছু বিজ্ঞানী অল্পস্বল্প কাজ করেছেন। সেগুলো ছিল নিয়ম বা ব্যাকরণ ভিত্তিক বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ এটি হলে ওটি করতে হবে, এ ধরনের নির্দেশনা ভিত্তিক লজিক। এছাড়া এই শীতল সময়ে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল নিয়ে অল্প কিছু কাজ হয়েছে এবং পরিসংখ্যানের সম্ভাবনার মডেল নিয়ে গাণিতবিদ্যায় কিছু কাজ হয়েছে। পরে সেগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাতে প্রয়োগ করা হয়। মেশিন লার্নিংয়ের কিছু মূলভিত্তি যেমন ডিসিশন ট্রি, বেইসিয়ান ক্লাসিফিকেশন এবং প্যাটার্ন শনাক্তের কাজ হয়েছে এই সময়ে।
আমেরিকানরা রোনাল্ড রেগানের ‘স্টার ওয়ারস প্রোগ্রাম’ নিয়ে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের চিন্তা করছে। অন্যদিকে কম্পিউটার ধীরে ধীরে ঢুকছে সাধারণ মানুষের জীবনে।
১৯৮৬ সাল। পৃথিবী তখন প্রবেশ করেছে এক নতুন যুগে। কোল্ড ওয়ার যুদ্ধ চলমান। যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলছে প্রযুক্তি ও শক্তির দম্ভ প্রতিযোগিতা। একদিকে আমেরিকানরা রোনাল্ড রেগানের ‘স্টার ওয়ারস প্রোগ্রাম’ নিয়ে মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের চিন্তা করছে। অন্যদিকে কম্পিউটার ধীরে ধীরে ঢুকছে সাধারণ মানুষের জীবনে—অফিসে, স্কুল এমনকি বাসাবাড়িতেও। প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন অনেক স্বপ্ন, আবার অনেক সংশয়ও। ওই বছরেই চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নে। বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। IBM নিয়ে আসে নতুন পার্সোনাল কম্পিউটার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রযুক্তির সংযোগ আরও সহজ হয়ে যায়।
তখন তিনজন গবেষক ডেভিড রমেলহার্ট, জিওফ হিন্টন এবং রোনাল্ড উইলিয়ামস একসঙ্গে বিখ্যাত নেচার পত্রিকাতে প্রকাশ করেন একটি গবেষণাপত্র। নাম দেওয়া হয় ‘Learning representations by back-propagating errors’। এই গবেষণাপত্রে তাঁরা তুলে ধরেন একটা গাণিতিক পদ্ধতি। এর নাম দেন ব্যাকপ্রোপাগেশন অ্যালগরিদম। এটি ছিল এমন এক পদ্ধতি, যা নিউরাল নেটওয়ার্ককে শেখাতে পারে। ধরুন, আপনি একজন শিশুকে আপেল আর কমলার পার্থক্য শেখাচ্ছেন। প্রথমে সে ভুল করবে, তারপর আপনি ভুল ধরিয়ে দেবেন। এই প্রক্রিয়ায় তার শেখা হবে। ঠিক একইভাবে, ব্যাকপ্রোপাগেশন পদ্ধতি কম্পিউটারকে তার ভুল ধরিয়ে দেয়, যাতে সে ধীরে ধীরে শেখে কীভাবে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটি ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কম্পিউটার নিজে নিজে শেখার ক্ষমতা অর্জন করতে শুরু করে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৮০-এর দশকে নিউরাল নেটওয়ার্ক ছিল অনেকটা অবহেলিত ক্ষেত্র। বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী মার্ভিন মিনস্কি ১৯৬৯ সালে তাঁর পার্সেপশন বইয়ে নিউরাল নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে অনেককে নিরুৎসাহিত করে ফেলেছিলেন। ফলে হিন্টনের কাজের প্রতি প্রথমদিকে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু হিন্টন হাল ছাড়েননি। ১৯৮৬ সালে তিনি একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। নামটা বাংলা করলে হয় ‘নিউরাল নেটওয়ার্ক মরে যায়নি, বরং এখনই তার নবজন্ম।’
ব্যাকপ্রোপাগেশন অ্যালগরিদমের বিস্তারিত
ব্যাকপ্রোপাগেশন অ্যালগরিদমের স্তর
ব্যাকপ্রোপাগেশনের পদ্ধতিটি সহজে বোঝার জন্য একটা কল্পনা করা যাক। কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলটির একটি সুন্দর নাম দিই। ধরা যাক, ওটার নাম ‘নিউরালু’। আমরা তাকে বললাম, ‘তুমি এখন থেকে নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে শেখো!’
প্রথমে ফরওয়ার্ড প্রোপাগেশনে নিউরালুকে কিছু ইনপুট দেওয়া হলো। মনেকরি তা x₁ ও x₂। এই ইনপুটগুলো তার মস্তিষ্কের প্রথম ধাপে গেল। এটাকে আমরা বলি হিডেন লেয়ার। সেখানে প্রতিটি ইনপুট ছোট ছোট গোল বলের মতো নিউরনের সঙ্গে যুক্ত হলো। তবে শুধু যুক্ত হলে হয় না, প্রতিটি সংযোগের সঙ্গে ওজন নামে একটি প্রভাবকের মান থাকে। সেটি নির্ধারণ করে দেয় এই ইনপুটটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে তথ্য এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় আউটপুটে। একে বলা হয় ফরওয়ার্ড প্রোপাগেশনে। অর্থাৎ ইনপুট থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে সিগন্যাল বা তথ্য একেকটা লেয়ার পার হয়ে যাচ্ছে আউটপুট পর্যন্ত।
এরপরে শুরু হলো প্রেডিকশন। এই পর্যায়ে মডেলটি একটা পূর্বানুমান করে। ধরি, আপনি একটা ছবি দেখিয়ে বললেন ‘এটা কি বিড়াল?’। নিউরালু বলল, ‘হ্যাঁ, এটা সম্ভবত বিড়াল!’ কিন্তু যদি সেটা আসলে কুকুর হয়, তাহলে বুঝতেই পারছেন, সে একটা ভুল করেছে।
এরপরের ধাপে হলো ভুল মাপা বা লস ফাংশন এবং লস স্কোর। এখন আপনি বললেন, ‘না রে বোকা, এটা তো কুকুর ছিল!’ এটা y হিসাবে ছবিতে চিহ্নিত করা হয়েছে। তখন নিউরালু হিসেব করে সে কতটা ভুল করল। এটাকে বলা হয় ভুল পরিমাপ করা।
এরপর হলো ব্যাকপ্রোপাগেশন বা শেখার পালা। এবার সেই ভুলের তথ্য নিউরালুর মস্তিষ্কে আবার উল্টো পথে ফিরে যায়—এই অংশকে বলে ব্যাকপ্রোপাগেশন। এই সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আসে—অপটিমাইজার। সে এসে নিউরালুর প্রতিটি ওজনের মানগুলোকে একটু একটু করে ঠিক করে দেয়, যেন নিউরালু ভবিষ্যতে কম ভুল করে।
ওপরের এই পুরো প্রক্রিয়াটি বারবার হয়—তথ্য আসে, নিউরালু অনুমান করে, ভুল হলে সে শেখে। এভাবেই একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল ধীরে ধীরে আরও বেশি বুদ্ধিমান হয়ে ওঠে। ভুলের পরিমাণা মেপে প্রতিবার নিউরালু আবার ছুটে যায় উল্টো দিকে। ভেতরের সব সংযোগগুলোতে এবং প্রতিটি ওজনকে সামান্য করে পরিবর্তন করে, যাতে নিউরালু ভবিষ্যতে কম ভুল করে। অনেকবার প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত করে শেষে আর নিউরালু ভুল করে না এবং এটি দক্ষ হয়ে উঠে। হিন্টনের আবিষ্কার হলো এই ব্যাকপ্রোপাগেশন বা শেখার পদ্ধতিটিকে একটি গাণিতিক মডেলে নিয়ে প্রয়োগ করা।
জীবনে চলার পথে আমরা প্রায়ই ভুল করি। সেই ভুলের জন্য পরে আফসোসও করি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এই ভুলের মাধ্যমেই আমাদের মস্তিষ্ক শেখে।
হিন্টন যখন তার গবেষণা প্রকাশ করেন, তখন তিনি জানতেন না যে এই ছোট্ট অ্যালগরিদম একদিন গুগল, ফেসবুক, চ্যাটজিপিটি থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় গাড়িরও মস্তিষ্ক হয়ে উঠবে। হিন্টনের সেই গবেষণা পত্রটি আজও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ওপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছে আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব। বহু বছর পর, হিন্টন নিজেই বলেছিলেন, ‘তখন আমরা বুঝতেই পারিনি, এটা এমন কিছুর শুরু। এটা একদিন পৃথিবীকে বদলে দেবে।’
জীবনে চলার পথে আমরা প্রায়ই ভুল করি। সেই ভুলের জন্য পরে আফসোসও করি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে, এই ভুলের মাধ্যমেই আমাদের মস্তিষ্ক শেখে। যত বেশি ভুল হবে, তত বেশি আমরা অন্য পথগুলো খুঁজে সফলতার কাঙ্ক্ষিত পথে যেতে পারি। এটিই আমাদের মৌলিক পদ্ধতি। কোটি কোটি বছর ধরে প্রাণিজগৎ একই কাজ করে আসছে। তাই ভুলকে অনাকাঙ্ক্ষিত নয় বরং শেখার একটি পন্থা হিসাবেই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। আর এই পদ্ধতি গ্রহণ করেই কম্পিউটারকে প্রযুক্তিবিদরা শেখাতে পারছেন। শুধু নির্দেশনা দিয়ে নয়, ভুল থেকে শিখে কম্পিউটার তার সঠিক পদ্ধতিটি বের করে। আর এই মৌলিক আবিষ্কারের কাজটি করেন জিওফ হিন্টন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি উন্নয়নে তাঁর অবদানের জন্য ২০২৪ সালে হিন্টনকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।