বিমান দুর্ঘটনায় পাইলটের জীবন রক্ষার শেষ উপায়

যুদ্ধবিমানের পাইলটদের জীবন বাঁচাতে 'ইজেকশন সিট' বা ইজেকশন পদ্ধতি একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রযুক্তি। যখন কোনো যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটি, শত্রুর হামলা বা অন্য কোনো কারণে বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে, তখন পাইলটদের নিরাপদে বিমান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো এই ইজেকশন পদ্ধতি। কীভাবে পাইলটদের জীবন বাঁচাতে পারে ইজেকশন পদ্ধতি, তা জেনে নিন সংক্ষেপে...

নিরাপদ অবতরণে ইজেকশন পদ্ধতি যেভাবে কাজ করে

দুর্ঘটনায় পড়লে ফাইটার জেটের পাইলট আসনসহ ছিটকে বেরিয়ে এসে যেন জীবন রক্ষা করতে পারেন, এ জন্য এই প্রযুক্তি বহুদিন ধরেই ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকৌশলীরা ১৯১০ সালের শুরুতে এ রকম কিছু তৈরি করতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। প্রথম জীবন রক্ষাকারী এমন প্রযুক্তির নাম ফ্লয়েড স্মিথ অ্যারিয়াল লাইফ প্যাক। আধুনিক ইজেকশন আসন পদ্ধতি ১৯২০–এর দশকের শুরুতে ব্যবহার করা হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আকাশপথে প্রচণ্ড যুদ্ধ হতে দেখা যায়। তখন ইজেকশন আসনের ব্যাপক উন্নতি হয়। জার্মান কোম্পানিগুলো এতে নেতৃত্ব দেয়। প্রথম দিকে এসব আসনে ককপিট থেকে পাইলটকে বের করতে সংকুচিত বায়ু ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্য মডেলের কোনোটায় বারুদ ব্যবহার করা হয়েছে, কোনোটায় কার্তুজ। যেগুলো শটগানে ব্যবহার করা হয়। অনেক বিমানে এখনো ইজেকশন আসন থাকে না। পাইলটদের এখনো নিজেদের মতো করে বের হয়ে আসতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিমানের প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বিমানের গতি অনেক বেড়েছে। একই সঙ্গে ইজেকশন আসনের প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে গেছে। ১৯৫৮ সালে ইজেকশন আসনে রকেট ব্যবহার করা হয়। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নতুন নতুন নকশায় চলছে। নিয়মিতই এই প্রযুক্তির আধুনিকায়ন হচ্ছে।

ইজেকশন আসন পাইলটকে বাতাসে কমপক্ষে ৩০ মিটার উচ্চতায় ছুড়ে দেয়
ছবি: হিস্টোরিনেট/ মার্টিন-বাকের

ইজেকশন কীভাবে কাজ করে

১. ছাদ খোলা

পাইলটরা বিমানের ওপরে থাকা ছাদ খোলার জন্য হাঁটুর মাঝে বা চেয়ারের পাশে থাকা একটি লিভার টানেন।

২. রকেটের শক্তি

একবার ছাদ খুলে গেলে রেল পাত দিয়ে আসন সরে গিয়ে রকেট ফায়ার করে। এ সময় পাইলট জরুরি অক্সিজেন ব্যবহার করেন।

৩. উচ্চতা

ইজেকশন আসন পাইলটকে বাতাসে কমপক্ষে ৩০ মিটার উচ্চতায় ছুড়ে দেয়। কখনো কখনো ১০০ মিটার পর্যন্ত।

৪. বিদায়

একবার পাইলট প্লেন থেকে মুক্ত হয়ে গেলে ইজেকশন সিটটি দূরে পড়ে যায়। এর কাজ শেষ।

৫. ধীরে অবতরণ

একটি প্যারাস্যুট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলে। কখনো কখনো এটি খোলে, যখন পাইলট একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় নেমে আসেন।

৬. ল্যান্ডিং স্ট্রিপ

নিরাপদ অবতরণে প্যারাস্যুট ব্যবহার করা হয়। মাটি বা সমুদ্র—যা–ই হোক না কেন, ভেতরে রাখা জীবন রক্ষাকারী ভেলা এখানে কাজ করে।

কিছু পুরোনো প্রযুক্তির ইজেকশনে পাইলটরা ২০জি চাপ অনুভব করেন। মানুষ এর বেশি সহ্য করতে পারে না।

একটি আধুনিক ইজেকশন আসনের দাম হতে পারে ১ লাখ ৪০ হাজার থেকে ৪ লাখ ডলার পর্যন্ত। এটি নির্ভর করে, কী কী সুবিধা এতে আছে।

আরও পড়ুন

ইজেকশন গতি

ইজেকশন আসন বুঝতে হবে পদার্থবিজ্ঞানের চোখে। এই আসন ২৫০ বা এর বেশি গতিতে ৩০ থেকে ১০০ মিটার দূরে সেকেন্ডের কম সময়ে ছুড়ে দেয়। বিমান এ সময় ঘণ্টায় ৭৫০ মাইল গতিতে উড়তে থাকে। এই প্রচণ্ড গতি মানুষের শরীরের ওপর চাপ দেয়। পাইলটরা সাধারণত ১৪জি (G) পর্যন্ত টান অনুভব করেন বের হওয়ার সময়। পৃথিবী আমাদের টানে ১জিতে (1G)। এর মানে একজন ৮০ কেজি ওজনের ব্যক্তি শরীরে ১ হাজার ৬৩২ কেজির সমান চাপ অনুভব করবেন। এতে শরীরে আঘাত লাগতে পারে। ইজেকশন করা পাইলটদের হাড় ভেঙে যাওয়ার কথাও শোনা যায়। তাঁদের হাত–পা ভেঙে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

ইজেকশন সিট বিস্ফোরক ও প্রচণ্ড শক্তি ব্যবহার করে। তাই প্রয়োজন সতর্কতা।

আরও পড়ুন

ইজেকশনের তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। চলুন, সংক্ষেপে সেগুলো দেখে নিই।

প্রথম পদ্ধতি

গতি ঘণ্টায় ২৮৮ মাইলের কম, উচ্চতা ৪ হাজার ৫৭৫ মিটারের কম।

একটি কম গতি ও নিম্ন উচ্চতায় ইজেকশন। এটি তুলনামূলক সহজ, এর জন্য ছোট ড্রগ প্যারাস্যুট বা সিটের গতি কমাতে ছোট একটি প্যারাস্যুট বেরিয়ে আসার প্রয়োজন নেই।

দ্বিতীয় পদ্ধতি

গতি ঘণ্টায় ২৮৮ মাইলের বেশি, উচ্চতা ৪ হাজার ৫৭৫ মিটারের কম।

এই উচ্চগতি ও কম উচ্চতায় পাইলটকে রক্ষা করতে ড্রগ প্যারাস্যুট এবং প্রতিরক্ষামূলক আসনব্যবস্থা ব্যবহার করা হয়।

তৃতীয় পদ্ধতি

যেকোনো গতি, উচ্চতা ৪ হাজার ৫৭৫ মিটারের বেশি।

অতি উচ্চতায় একটি স্বয়ংক্রিয় প্যারাস্যুট, সারভাইভাল কিটস (যার মধ্যে লাইফ জ্যাকেট, ওষুধসহ খুঁটিনাটি প্রয়োজনীয় জিনিস থাকে) এবং পানিতে জীবন রক্ষাকারী ভেলা স্থাপনের পাশাপাশি ড্রগ প্যারাস্যুট ও প্রতিরক্ষামূলক আসনব্যবস্থা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

পাইলটের ইজেকশন আসনে কী থাকে

ইজেকশন আসন জটিল। জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রগুলোর মূল প্রযুক্তি দেখা যাক

ড্রগ

ড্রগ একটি ছোট প্যারাস্যুট। মূল প্যারাস্যুট বেরিয়ে আসার আগে আগে আসনকে স্থিতিশীল করে।

প্যারাস্যুট

একটি প্যারাস্যুট স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাইলটদের ভূমি বা সমুদ্রে নিরাপদে অবতরণে সাহায্য করে।

বেঁচে থাকার উপকরণ

পাইলটের বেঁচে থাকার টুলে কী থাকে, সেটা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় টিকে থাকার টুল, পানিতে ভাসার ভেলা, ফ্লেয়ার, খাবার পানি, ছদ্মবেশ ধারণের উপকরণ থাকতে পারে।

চালু করা

পাইলটের দুই হাঁটুর মাঝখানে থাকা এই লিভার টেনে আসনটি চালু করা হয়।

পায়ের সুরক্ষা

পাইলটরা যখন প্রচণ্ড গতিতে প্লেন থেকে বের হন, এটি তাঁদের পা রক্ষা করে।

রকেট ও রেল

সিটের নিচে থাকা রকেটগুলো পাইলটকে খুব দ্রুত প্লেন থেকে বের করে দেয়। রেল বা আসনের নিচে থাকা রেললাইনের মতো পাত সিটগুলোকে মুক্ত করতে সাহায্য করে।

প্রাথমিক বিষয়

ভয়ংকর ইজেকশন পদ্ধতি পাইলটদের নিরাপদ রাখতে চেষ্টা করে, এরপরও মেরুদণ্ডে আঘাত পেতে পারেন পাইলট।

লেখক: সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস, প্রথম আলো

*লেখাটি ২০২৪ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত

আরও পড়ুন