ইতিহাসের ৭ ব্যর্থ উদ্ভাবন, যা কাজে আসেনি

ইলেকট্রিক ট্রাইসাইকেলবিবিসি সায়েন্স ফোকাস

আপনার ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, কত দারুণ সব উদ্ভাবন আমাদের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে! এই মুহূর্তে আপনি যে ডিভাইসে এই লেখা পড়ছেন, সেটাও তেমনই এক উদ্ভাবন। কিন্তু সব উদ্ভাবন কি সফল হয়? মোটেই না। কিছু উদ্ভাবন এতই খারাপ যে সেগুলো দেখলে মনে প্রশ্ন আসে, এগুলো কেন বানানো হয়েছিল! সব উদ্ভাবন মানুষের উপকারেও আসে না। কিছু উদ্ভাবন ভালো উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও তা মানুষের উপকারে না এসে বিপদই বেশি ডেকে এনেছে। আজ এমনই দশটা ব্যর্থ উদ্ভাবনের গল্প জেনে নিই।

১. প্যারাসুট কোট

ফ্রানৎস রেইশেল্ট পেশায় ছিলেন দর্জি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তাঁর মাথায় চেপেছিল ওড়ার নেশা। তখন মানুষ কেবল আকাশে উড়তে শুরু করেছে। তিনি ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়ে একটা স্যুট বানালেন। পাইলটেরা তা প্যারাসুট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে বলেই তাঁর বিশ্বাস ছিল। তিনি শুরুতে ডামি বা পুতুল দিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষা করলেন। দারুণ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ১৯১২ সালে নিজেই প্যারাসুট পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেন। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের নিচ তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিচের দিকে।

দুর্ভাগ্যবশত, তিনি সফল হননি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে তিনি মাটিতে আছড়ে পড়ে মারা যান। তবে তাঁর মতো সাহসী মানুষদের কারণেই আজ আমাদের কাছে আছে উইংসুট, আধুনিক প্যারাসুট, আর পাইলটদের জন্য ইজেক্টর সিট। যদিও তাঁর উদ্ভাবন প্রত্যক্ষভাবে কোনো কাজে লাগেনি, কিন্তু পরোক্ষভাবে কাজে লেগেছে। তাঁর ব্যর্থতা থেকে অন্যরা শিখেছেন এবং সফল হয়েছেন।

আরও পড়ুন

২. কফি পড

কফি পডের আইডিয়াটা কাগজে-কলমে দারুণ ছিল। ছোট্ট একটা ক্যাপসুল মেশিনে ঢুকিয়ে দিলেই তৈরি হবে কফি। কিন্তু বাস্তবে এটি বেশ অপচয়কারী। এমনকি এর উদ্ভাবক জন সিলভান নিজেই এটি আবিষ্কারের জন্য অনুতপ্ত। 

গবেষণা বলছে, প্রতি বছর কফি পড থেকে পাঁচ লাখ টনের বেশি বর্জ্য তৈরি হয়। কিছু বিশেষ কোম্পানি এগুলো রিসাইকেল করে, কিন্তু আপনি বাড়িতে রিসাইকেল করতে পারবেন না। আর যদি মাটিতে পুঁতে রাখা হয়, তাহলে পচতে সময় লাগবে ৫০০ বছর! একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার জন্য এ কেমন উদ্ভাবন!

৩. ইলেকট্রিক ট্রাইসাইকেল

কিছু উদ্ভাবন সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকে। সিনক্লেয়ার সি৫ ঠিক তেমনি। ১৯৮৫ সালে এটি বাজারে আসে। স্যার ক্লাইভ সিনক্লেয়ারের দারুণ সুনাম ছিল। তিনি ছিলেন সফল উদ্ভাবক এবং হোম কম্পিউটারের জনক। 

কিন্তু সি৫ ইলেক্ট্রিক ট্রাইসাইকেল ছিল এক বিপর্যয়। আইনগতভাবে যুক্তরাজ্যের রাস্তায় এটি চালানোর অনুমতি ছিল। কিন্তু এর উচ্চতা ছিল মাত্র ৮০ সেন্টিমিটার। তাই বাস চালকেরা একে দেখতেই পেতেন না। ফলে এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এর ব্যাটারি লাইফও ছিল কম, মাত্র ২০ মাইল যেতে পারত। সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় মাত্র ২৪ কিলোমিটার। তাই সেভাবে বাজার দখল করতে পারেনি। তবে এখন ব্যাটারি প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়েছে। সিনক্লেয়ার সি৫ বর্তমান সময়ে বাজারে আসলে হয়তো বেশি সফল হতো।

আরও পড়ুন

৪. হাইড্রোজেন এয়ারশিপ

জেট বিমান আসার আগে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে চাইলে জাহাজই ছিল একমাত্র উপায়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে উড়োজাহাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এয়ারশিপে চড়ে দ্রুত বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্ন দেখেন। 

অনেক কোম্পানি এয়ারশিপ তৈরি করেছিল। কিন্তু জেপেলিন কোম্পানি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের আইডিয়া ছিল চমৎকার। এয়ারশিপে বিলাসবহুল কেবিন লাগিয়ে মানুষকে দ্রুত আর আরামে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়াতে চেয়েছিল তারা। ১৯২০ আর ১৯৩০-এর দশকে এটা ইউরোপ থেকে আমেরিকা যাওয়ার জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু খারাপ আইডিয়া হলো, এই বেলুনগুলো অত্যন্ত বিস্ফোরক হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে ভরা ছিল। প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটত। কিন্তু ১৯৩৭ সালের হিন্ডেনবার্গ বিপর্যয় সব শেষ করে দেয়। অবতরণের সময় এয়ারশিপটি বিস্ফোরিত হয়ে ৩৬ জন মানুষ মারা যায়। এক নিমেষে শেষ হয়ে যায় এয়ারশিপের যুগ।

তবে এয়ারশিপ হয়তো শীঘ্রই ফিরে আসবে। ইউরো এয়ারশিপ আর ফ্লাইং হোয়েলস কোম্পানি পরিবেশবান্ধব এয়ারশিপ তৈরির পরিকল্পনা করছে। এগুলো বিমানের চেয়ে ৮০ শতাংশ কম জ্বালানি খরচ করবে। আর ওগুলোতে হাইড্রোজেনের পরিবর্তে ভরা থাকবে নিরাপদ হিলিয়াম গ্যাস।

৫. সেগা ড্রিমকাস্ট

একসময় সেগা ছিল ভিডিও গেমের দুনিয়ায় রাজা। কিন্তু ১৯৯৯ সালে যখন ‘ড্রিমকাস্ট’ কনসোল বাজারে আনে, তখন তাদের সময় ভালো যাচ্ছিল না। তাদের আগের কনসোল সেগা স্যাটার্ন সনির প্লে-স্টেশনের কাছে হেরে যায়। কারণ, সনির প্লেস্টেশন ছিল সস্তা আর ভালো।

ড্রিমকাস্ট কাগজে কলমে ভালো দেখাচ্ছিল। উদ্ভাবনী কন্ট্রোলার এবং অনলাইন গেমপ্লে ছিল। কিন্তু থার্ড পার্টি গেমের অভাব আর সনির সর্বজয়ী প্লেস্টেশন ২-এর লঞ্চ ২০০১ সালে সেগার কনসোল ব্যবসায় মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়।

আরও পড়ুন

৬. বেটাম্যাক্স ভিডিও

বেশিরভাগ বাজে উদ্ভাবন ব্যর্থ হয় কারণ সেগুলো ভালোভাবে বানানো হয় না। কিন্তু সনির ‘বেটাম্যাক্স’ ভিডিও সিস্টেমের গল্পটা ঠিক উল্টো। ১৯৭৫ সালে বাজারে আসা এই সিস্টেমটি প্রতিদ্বন্দ্বী ভিএইচএসের চেয়ে অনেক ভালো মানের ছবি দেখাত। অর্থাৎ, এটি ছিল একটি উন্নত প্রযুক্তি। তবুও এটি ব্যর্থ হলো কারণ, এর দাম ছিল বেশি। কোনো অদ্ভুত কারণে অ্যাডাল্ট ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ভিএইচএসকে বেছে নেয়, এবং এর ক্যাসেটের চাহিদা ও বিক্রি দুটোই বেড়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো, ব্যর্থ হওয়ার পরও সনি ২০১৬ সাল পর্যন্ত বেটাম্যাক্স টেপ বানানো বন্ধ করেনি!

৭. অ্যাপল নিউটন

কাগজ-কলম হলো ক্লাসিক। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে অ্যাপল ভাবল, এর একটা আধুনিক সংস্করণ দরকার। ফলাফল হলো ‘অ্যাপল নিউটন’ ট্যাবলেট। সমস্যা হলো, এই ট্যাবলেটটি ছিল খুবই দামি এবং প্রায় অকেজো। এর ‘হ্যান্ডরাইটিং রিকগনিশন’ বা হাতের লেখা চেনার ক্ষমতা এতই খারাপ ছিল যে, এটি মানুষের কাছে হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়ায়।

তখন ছিল অ্যাপলের সবচেয়ে খারাপ সময়। স্টিভ জবস তখন কোম্পানিতে ছিলেন না। ১৯৯৭ সালে তিনি যখন অ্যাপলে ফিরে আসেন, তখন তার প্রথম কাজগুলোর একটি ছিল এই ‘নিউটন’ প্রজেক্টকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া।

আবিষ্কারের জগৎ এমনই। কিছু সফল হয়, কিছু হয় ব্যর্থ। কিন্তু প্রতিটা ব্যর্থতা থেকে আমরা কিছু না কিছু শিখি। আর সেই শিক্ষা থেকেই হয়তো একদিন তৈরি হয় আরেকটা দুর্দান্ত উদ্ভাবন!

সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস