আকাশ পর্যবেক্ষকের খেরোখাতা - ৩

মহাবিশ্ব নিয়ে মানুষের বিস্ময়-আগ্রহ পুরকালের। পৌরাণিক যুগ থেকেই প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞানভান্ডার। আধুনিক যুগে এসে আমূলে বদলে গেছে মহাকাশবিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস। মানুষ এখন অনন্ত মহাবিশ্বের গভীর থেকে গভীরে ডুব দিতে চায়। কতটুকু সফল সে চেষ্টায়? ইতিহাস আর বিজ্ঞানের খেরোখাতায় চোখ রাখা যাক।

সেই কবে প্রথম পড়েছিলাম জীবনানন্দের কবিতা

নক্ষত্র যে-বেগে

ছুটিছে আকাশে

তার চেয়ে আগে চ’লে আসে

যদিও সময়,

পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!

ভাবতাম নক্ষত্র কেমন করে ছোটে আকাশে, শাই শাই শব্দ করে, আগুনের হল্কা পেছনে ফেলে। আজ বুঝি মহাকাশের শূন্যতায় শাই শাই শব্দও নেই, আর গতিজাড্য বা ইনারশিয়ার কারণে আগুনের স্ফুলিঙ্গও পেছনে পড়ে থাকবে না। কিন্তু এখন দিনেরবেলা হোক কী রাতের বেলা, আমি জানতে চাই—এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি বা বসে আছি এক মহাকাশযানের ওপর, যার নাম হলো পৃথিবী, সে আমাদের নিয়ে কোথায় চলেছে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে সেই রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। তাঁদের পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, এই মহাবিশ্বের মধ্যে পৃথিবী ও সৌর জগতের গতি বেশ জটিল। শত শত বিজ্ঞানী ১০০ বছর ধরে এই কঠিন কাজ করে চলেছেন। তাঁরা যে সব সময় একে অপরের লব্ধ সংখ্যার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন এমন নয়, কিন্তু বিজ্ঞানের ধারাই এ রকম, তর্কের মাঝে সঠিক মডেলটির দিকে আমরা এগিয়ে যাই। তাই এই লেখায় বর্ণিত গতির মান ও দিক একদম শেষ কথা নয়। তবে এর ব্যাপক সংশোধন হবে বলেও আমার মনে হয় না।

চিত্র ১: আকাশের গায়ে তারারা স্থির (আসলে ঠিক স্থির নয়)। কিন্তু পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে মনে হয় তারারাই আমাদের চারদিকে ঘুরছে
ছবি: সংগৃহীত

একটা বস্তু যত দূরে থাকবে, তার গতি আমাদের চোখে তত শ্লথ মনে হবে: ধাবমান গাড়ি বা ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায়, কাছের জিনিস অতি দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক দূরের পাহাড় বা মেঘ খুব ধীরে ধীরে দৃষ্টিপথ থেকে সরে যাচ্ছে। আকাশের নক্ষত্ররা আমাদের থেকে এতই দূরে যে আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয়, তারা একেবারেই নিশ্চল। কিন্তু তাদের গতিবেগ সেকেন্ডে ১০, ২০ কী ৩০ কিলোমিটার (বা তার বেশি)। সেই নক্ষত্ররা আমাদের থেকে এত দূরে যে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন বুঝতে হলে হাজার হাজার বছর লাগবে। আর আরও দূরের খ-গোল বস্তু যেমন গ্যালাক্সিদের গতি সরাসরি ফটোর মাধ্যমে তো একেবারেই বোঝা যাবে না। তবে কিছু নিকটবর্তী তারার অবস্থান প্রতিবছর যথেষ্ট পরিমাণে বদলায়। যেমন বারনার্ডের তারা নামে আমাদের খুব কাছের একটি তারা আকাশে প্রতিবছর প্রায় ১০ কৌণিক সেকেন্ড দূরত্ব অতিক্রম করে (লেখার শেষে টীকায় বিস্তারিত)। ভালো দুরবিন ও উন্নত প্রকৌশল ব্যবহার করে নিকটবর্তী অনেক তারাই তাত্ক্ষণিক গতিবেগ ও দূরত্ব পরিবর্তন অনুধাবন করা সম্ভব।

পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে আমাদের মনে হয় সূর্য, আকাশের নক্ষত্র এবং গ্রহগুলো আমাদের চারদিকে ঘুরছে (চিত্র ১)। পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার তার অক্ষের চারদিকে ঘোরে, তাকে আমরা বলি আহ্নিক গতি। এই গতির ফলে বিষুবরেখার যেকোনো বিন্দুর গতিবেগ সেকেন্ডে প্রায় শূন্য দশমিক পাঁচ বা আধা কিলোমিটার। বিষুবরেখা থেকে আমরা যত উত্তরে বা দক্ষিণে যাব, এই গতিবেগ তত কমতে থাকবে। উত্তর মেরুতে (বা দক্ষিণ মেরুতে) গিয়ে এই গতিবেগ হবে একেবারে শূন্য। কিন্তু আমাদের কাছে পৃথিবীর এই আবর্তন চোখে পড়ে না। আমাদের মনে হয়, পৃথিবীর বদলে আকাশই ঘুরছে। তাই পুরোনো কালে মানুষের কাছে মনে হয়েছে পৃথিবী অনড় আর তার চারদিকে ঘুরছে সূর্য, চাঁদ, তারা আর গ্রহরা।

চিত্র ২: ১৮৫১ সালে লিও ফুকোর প্যারিসের প্যানথিওনে তাঁর বিখ্যাত পেন্ডুলামের উদ্বোধন দৃশ্য।
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবী কোন দিকে ঘুরছে? পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। তাই উত্তর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ডান হাত পূর্ব দিকে তুললে পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিক নির্দেশ করবে। আমরা সেই গতি বুঝতে পারি না। কিন্তু পৃথিবী যে ঘুরছে, সেটা সরাসরি প্রমাণ করার জন্য একটি যন্ত্র আছে। যন্ত্র ঠিক নয়, আসলে এটি একটি পেন্ডুলাম, নাম হলো ফুকোর পেন্ডুলাম (Foucalt Pendulum)।

অন্যদিকে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে বছরে একবার ঘোরে: পৃথিবীর এই বার্ষিক গতির ফলে বছরের এক এক সময় পৃথিবীর রাতের আকাশ মহাবিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন অংশের দিকে মুখ করে থাকে। ফলে আজকের আকাশের নির্দিষ্ট কোনো সময়ে নক্ষত্রের অবস্থান কাল ওই সময়ে একই জায়গায় থাকবে না (চিত্র ৩)। গ্রীষ্মকালের মধ্যরাতে যে তারা আমরা দেখি মাথার ওপর, ছয় মাস পরে সেই তারা থাকবে মধ্যদিনে মাথার ওপর, দিনের আলোয় ঢাকা।

সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর গতি: বার্ষিক গতির ফলে সূর্য পরিক্রমায় পৃথিবীর গড় গতিবেগ হচ্ছে সেকেন্ডে প্রায় ৩০ কিলোমিটার। কিন্তু সূর্যের চারদিকে পৃথিবী কোনো নির্দিষ্ট একটি গতিবেগে ভ্রমণ করে না। কেপলারের সূত্র অনুযায়ী, পৃথিবী যখন সূর্যের কাছাকাছি থাকে, তার গতিবেগ সবচেয়ে বেশি হয়, সেকেন্ডে প্রায় ৩০ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সূর্যের থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী বিন্দুতে এই গতিবেগ হয় সেকেন্ডে ২৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার। সবচেয়ে কাছের বিন্দুটি জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পড়ে, আর সবচেয়ে দূরের বিন্দুটি জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। কাছের বিন্দুটির নাম অনুসূর, দূরের বিন্দুটির নাম অপসূর। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পৃথিবীর গতিবেগ দ্রুত হতে থাকে। যেহেতু এই গতির হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ খুবই কম, আমরা জাড্য বা ইনারশিয়ার কারণে এই প্রচণ্ড গতি সম্পর্কে সচেতন নই।

সূর্যের চারদিকে আমাদের গতিপথের দিক বের করার কি কোনো পদ্ধতি আছে? আছে। নিচের ছবিটি একটু ভালো করে দেখে নিলেই হবে।

চিত্র ৩: বছরের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর রাতের আকাশ আকাশের বিভিন্ন দিকে মুখ করে থাকে যার ফলে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তারাদের দেখা যায়
ছবি: সংগৃহীত
চিত্র ৪: পৃথিবীর বুকে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন, সূর্যাস্ত ও মধ্যরাতের চারটি অবস্থান দেখানো হয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত
চিত্র ৫: পৃথিবীর পিঠে দাঁড়ালে ওই চারটি সময়ে পৃথিবীর গতিমুখ ভিন্ন ভিন্ন হবে। এখানে তীরচিহ্ন দিয়ে চারটি বিভিন্ন সময়ে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর পরিভ্রমণের গতিপথ দেখানো হয়েছে
ছবি: সংগৃহীত

এখানে মনে রাখতে হবে পৃথিবীর গতিপথের দিক সূর্যের চারদিকে কক্ষপথের সঙ্গে স্পর্শক আঁকে। অর্থাত্ পৃথিবী থেকে সূর্য পর্যন্ত একটা সরলরেখা টানলে এই গতির দিক সেই সরলরেখার সঙ্গে একটা সমকোণ (৯০ ডিগ্রি কোণ) রচনা করবে। কাজেই সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের দিকে তাকিয়ে ডান বা বাঁ হাত মাথার ওপর দিকে (সুবিন্দুর দিকে) তাক করলে সেই সময়ে ওটা হবে সূর্যের কক্ষপথে পার্থিব গতির দিক। মধ্যাহ্নের সময় হাতটি পশ্চিম দিকে, সূর্যাস্তের সময় সরাসরি মাটির দিকে (কুবিন্দু?) আর মধ্যরাতের সময় পূর্ব দিকে তাক করলে পৃথিবীর গতির দিক নির্দেশ করবে। দেখা যাচ্ছে, সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময়ের সময় এই গতিবেগের দিক একে অপরের বিপরীত, আবার মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাতের সময়ও দিক বিপরীত। পৃথিবীর নিজ অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণনের জন্যই এই কাণ্ডটি ঘটছে। পাঠককে খেয়াল রাখতে হবে, সূর্যের চারদিকের এই বার্ষিক গতি পৃথিবীর আহ্নিক গতি থেকে ভিন্ন।

টীকা

বারনার্ডের তারা: এই তারা একটি লাল বামন তারা, আমাদের থেকে মাত্র ৬ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। বলতে গেলে প্রক্সিমা ও আলফা সেন্টাউরি তারাসমষ্টির পরে বারনার্ডের তারাই আমাদের নিকটবর্তী তারা। কিন্তু একে খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। এর মান হলো ৯। এই তারার গতি আমাদের তুলনায় সেকেন্ডে ১৪০ কিলোমিটার। আজ থেকে ১০ হাজার বছর পরে এটি সূর্যের ৩ দশমিক ৭৫ আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে দিয়ে যাবে। তবে সেই সময় সেন্টাউরি তারাসমষ্টি আরও কাছে থাকবে। আমাদের প্রথম আন্তনাক্ষত্রিক মহাকাশযানের একটি লক্ষ্য বারনার্ডের তারা হতে পারে। এর কোনো গ্রহ আছে কি না, সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করছেন।

লেখক: জ্যোতিঃপদার্থবিদ, ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইড কলেজের অধ্যাপক

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার জানুয়ারি ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত