ক্যান্সার সারিয়ে তুলবে রাশিয়ার নতুন ভ্যাকসিন
ক্যান্সার গবেষণায় নতুন মাইলফলক অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। সেদেশের বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন নতুন এক ক্যান্সার ভ্যাকসিন, নাম এন্টেরোমিক্স। এই ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগে শতভাগ কার্যকর এবং নিরাপদ হিসেবে দাবি করেছেন উদ্ভাবকেরা।
তাঁরা বলেছেন, এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের পর ক্যান্সার রোগীদের টিউমার ভালো হয়েছে। কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মতোই এমআরএনএ (mRNA) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে এই ভ্যাকসিন। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এই ক্যান্সারকোষ নির্মূল করতে নির্দেশ দেয়। এ পদ্ধতি প্রচলিত কেমোথেরাপির চেয়ে উন্নত এবং নিরাপদ।
ভ্যাকসিনটি প্রতিটি রোগীর জন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে। রোগীর টিউমারের গঠন অনুযায়ী বিশেষায়িত থেরাপিতে ব্যবহার করা হয়েছে এটি। এই ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে রাশিয়ায়। দেশটির ন্যাশনাল মেডিকেল রিসার্চ রেডিওলজিক্যাল সেন্টার ও এঙ্গেলহার্ড ইনস্টিটিউট অব মলিকুলার বায়োলজির সহযোগিতায় ৪৮ জন স্বেচ্ছাসেবকের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে এটি। সেন্ট পিটার্সবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ফোরামে দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী, ভ্যাকসিনটি ক্যান্সারবিদ্যায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে।
তবে রাশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এখনো পায়নি এই ভ্যাকসিন। তবে শিগগিরই পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা এই ভ্যাকসিনকে ভালোভাবে যাচাই করে দেখছেন। যদি এই ফলাফলগুলো বড় জনসংখ্যা নিয়ে ট্রায়ালে সফল হয়, তবে শুরু হতে পারে নতুন এক যুগ। কার্যকরী প্রমাণিত হলে এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেলে ক্যান্সার চিকিৎসার ধরন বদলে যাবে।
কীভাবে তৈরি করা হয়েছে এই ভ্যাকসিন
ভ্যাকসিনটি তৈরির জন্য প্রথমে প্রতিটি রোগীর টিউমারের ভেতরের গঠন পরীক্ষা করা হয়। এরপর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহার করে তৈরি করা হয় একটি বিশেষ এমআরএনএ নকশা। এই এমআরএনএ এক ধরনের বার্তা হিসেবে কাজ করে। শরীরের কোষগুলোকে বলে দেয়, কী ধরনের প্রোটিন তৈরি করতে হবে। এই প্রোটিনগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এমনভাবে তৈরি করে, যেন ক্যান্সার কোষকে চিনে দমন করতে পারে।
টিউমার পরীক্ষা থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন তৈরির পুরো কাজটা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে শেষ করা সম্ভব। দ্রুত প্রক্রিয়া হওয়ায় ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে এটিকে বড় অগ্রগতি হিসেবে ধরা হচ্ছে।
এন্টেরোমিক্স তৈরি হয়েছে রাশিয়ার ন্যাশনাল মেডিকেল রিসার্চ রেডিওলজিক্যাল সেন্টার এবং এঙ্গেলহার্ড ইনস্টিটিউট অব মলিকুলার বায়োলজির বহু বছরের সমন্বিত গবেষণার ফলে। এই ভ্যাকসিনটি এমআরএনএ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করবে। রাশিয়ায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের দ্রুত উন্নয়নে এই প্ল্যাটফর্মটিই ব্যবহৃত হয়েছিল। এন্টেরোমিক্সের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিটি ডোজ রোগীর টিউমারের জিনগত গঠন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে।
মানবদেহে পরীক্ষা
মস্কোর দুটি বড় ক্যান্সার হাসপাতালে এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হবে। রাশিয়ার চিকিৎসাব্যবস্থার অংশ হিসেবে এই ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য অগ্ন্যাশয়, কিডনি এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো কঠিন রোগগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করা।
রুশ নাগরিকেরা বিনামূল্যে ভ্যাকসিনটি পাবেন। প্রতিটি ডোজের জন্য খরচ হবে প্রায় ৩ লাখ রুবল (প্রায় ২,৮৬৯ ডলার)। এই খরচ বহন করবে রুশ সরকার।
রাশিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, রাশিয়ায় প্রায় ৪০ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ ২৫ হাজার নতুন রোগী ধরা পড়ে। তাই এমন একটি নতুন চিকিৎসার জরুরি প্রয়োজন আছে।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছিল শুধু একটি ভাইরাসকে লক্ষ্য করে। কিন্তু এই ক্যান্সার ভ্যাকসিনটি প্রতিটি রোগীর টিউমারের ভেতরে থাকা অনেকগুলো বিশেষ প্রোটিনকে লক্ষ্য করে কাজ করবে।
ক্যান্সারের অন্যান্য ভ্যাকসিন থেকে এটি কেন আলাদা
প্রচলিত ক্যান্সার ভ্যাকসিনগুলো সাধারণত সবার জন্য একই কৌশল অনুসরণ করে। এখন পর্যন্ত এসব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কম। কিন্তু এন্টেরোমিক্স দুটি মূল উদ্ভাবন নিয়ে এসেছে। প্রথমত, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে নকশা করা। প্রতিটি ভ্যাকসিন একজন ব্যক্তির টিউমারের জেনেটিক গঠনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। যেটির লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। দ্বিতীয়ত, এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে দ্রুততম সময়ে ভ্যাকসিনটি তৈরি সম্ভব। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের মতো খুব দ্রুত বহু মানুষকে এটি দেওয়া সম্ভব। অন্যান্য ক্যান্সার ভ্যাকসিনের গবেষণার সমস্যা ছিল, এতদিন এগুলো তৈরি করতে অনেক সময় লাগত।
তবে ভ্যাকসিনটি নিয়ে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। প্রাথমিক ট্রায়ালের সাফল্য সবসময় দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরী হয় না। সবার জন্য কাজ করবে এমন নিশ্চয়তাও দেয় না। প্রতিজনের জন্য আলাদা এমআরএনএ ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং বিতরণ করার জন্য কিছু কারিগরি চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন, চেইন কোল্ড স্টোরেজ এবং জিনোম প্রোফাইলিং দ্রুত সময়ে করা। তাই অনুমোদন, স্বাস্থ্যসেবা আর ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা নির্ধারণ করবে এন্টেরোমিক্সের ভবিষ্যত। তাই এন্টেরোমিক্স আশা হয়ে থাকবে নাকি ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।